Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিচ্ছেদের যন্ত্রণাকে পরিণত করুন শক্তিতে

“কলেজ ছেড়ে দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের স্বাদ অন্বেষণ করতে গিয়ে আমাকে আমার পরিবার, বন্ধু এবং শিক্ষকদের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছিল। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, সেই দিনগুলোর কষ্ট এতটাই তীব্র ছিল যে আমার পক্ষে ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব না।”

– ওঙ্কার কিশান খুল্লার, I Impact India এর প্রতিষ্ঠাতা।

নিজের স্বপ্ন পূরণের সাথী নিজেকেই হতে হয়

তিন তিনবার কলেজ ড্রপ আউট করা এই মানুষটি জীবনের নানা অধ্যায় দেখেছেন একদম কাছ থেকে। মুদ্রার দুই পিঠ দেখে হয়েছেন বাস্তববাদী। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো আই.আই.এল.এম লোদী রোডের একটি বেসরকারি কলেজ থেকে তিনি ড্রপ আউট হন। এরপর ২০১১ সালে খালসা থেকে বেরিয়ে আসেন। ২০১৩ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব দিল্লীর শহীদ সুখদেব কলেজ অব বিজনেস স্টাডিজ থেকে তৃতীয়বারের মতো ড্রপ আউট হন। ড্রপ আউটের বিষয়ে ওঙ্কার বলেন,

“প্রথম দুটি কলেজ থেকে আমার ড্রপ আউটের কারণ- কলেজ আমার স্বপ্ন পূরণের পথে সহায়ক ছিল না। আমার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা সম্পর্কিত যেসব প্রশ্ন ছিল তার উত্তর কলেজ আমাকে দিতে পারছিল না। এর ফলাফল হিসেবে আমি কলেজ ছেড়ে দিয়ে স্টক মার্কেটে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি আর তার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার দেখভাল করতে থাকি। Make-A-Wish নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথে আমি কাজ শুরু করি এবং এই কাজের সূত্রে সেখানে আমার পরিচয় হয় একটি ৮ বছর বয়সী মেয়ের সাথে যে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিল। মেয়েটির নাম ছিল রাধিকা। ছয় মাস পর মেয়েটির কেমোথেরাপির জন্য ওষুধের প্রয়োজন হয় যার মূল্যমান ছিল ১.৫ লক্ষ রুপি। তার মা অসংখ্য অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের দ্বারে হন্য হয়ে ঘুরেছেন, কিন্তু যারা আক্ষরিক অর্থেই এ ধরনের উদ্দেশ্যে মাঠে নেমেছিলেন তাদের কারও এই পরিমাণ অর্থ ছিল না অথবা সংগঠনগুলো নিজেরাই অর্থ সংকটে ছিল। এ ব্যপারে তার সাথে আমার কথা হলে আমি রীতিমত অবাক হয়ে যাই, কারণ তখন স্টক মার্কেটে কাজ করার সুবাদে আমার আয় ছিল যথেষ্ট। কিন্তু এটাও আমার অজানা ছিল না যে শুধু টাকা দিতে পারাটাই ভাল কোনো সমাধান হতে পারে না। রাধিকা একাই এরকম অবস্থায় ছিল না, তার মত আরও অনেকেই ঠিক একই পরিস্থিতির সম্মুখীন।

রামানুজন কলেজ টেড টকে ওঙ্কার; Source: youtube.com

শুরুর গল্প

পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তিনি উন্নয়নের পথে যেসব বিষয় বাধা হিসেবে কাজ করে সেগুলো নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। তার অনুধাবন ছিল এরকম যে, টাকা প্রধান সমস্যা না, বরং দক্ষতার অভাব হলো মূল সমস্যা, বিশেষত যোগাযোগ দক্ষতার অভাব। সৃজনশীলতাকে তিনি দেখেন নিজ জীবনের প্যাশন হিসেবে। এরপর তার মনে প্রশ্ন জাগে, টাকার মাধ্যমে সমাজে প্রভাব তৈরী করা আর প্রভাব তৈরী করার মাধ্যমে টাকা উপার্জন করা, এই দুয়ের মাঝে কোনটা বেছে নেয়া উচিৎ?

ওঙ্কারের বই 5 Year Old Billionaire; Source: onkar.world

তার উদ্দেশ্য ছিল অভিজ্ঞদের নিয়ে এমন একটি দল তৈরী করা যাতে করে যোগাযোগ দক্ষতার অভাব উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই অন্তরায় হতে না পারে। এতে করে নিজেদের যেমন অর্থোপার্জন করা সম্ভব হবে, তেমনি সমাজে প্রভাব তৈরী হবে সুদূরপ্রসারী।

নিজের আইডিয়া বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওঙ্কার বিভিন্ন জায়গায় অর্থায়নের জন্য আবেদন করতে শুরু করেন। তবে একমাত্র ভয় ছিল যে, তিনি একজন স্নাতক ছিলেন না। তাই এবারে তাকে যুদ্ধে নামতে হয় পড়ালেখায় ভাল করার জন্য। শহীদ সুখদেব কলেজ অব বিজনেস স্টাডিজে তিনি মাত্র ছয় মাসের জন্য টিকতে পেরেছিলেন। এই ছয় মাসে তিনি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বেশ কিছু ব্যবসাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশ্রগ্রহণ করে প্রায় ৫০,০০০ রুপির মতো জিতে নেন।

২০১৩ সালের ১৪ ফ্রেব্রুয়ারিতে তিনি আর তার বেশ কয়েকজন ভাল বন্ধু মিলে তাদের প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ‘One packet per view’  নামক একটি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তারা কাজ শুরু করেন এবং প্রথমেই ক্লায়েন্ট হিসেবে পেয়ে যান রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ব্লাইন্ড এবং ডিএলএফ এর মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তবে এবারও ভাগ্য পুরোপুরি তার সাথে ছিল না, কারণ মাত্র চার মাসের মাথায় তার দুই বন্ধু এমবিএ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যবসা ছেড়ে চলে যান। তার অসংখ্য অনুরোধের পরও তার বন্ধুদেরকে তিনি পাশে পান নি এবং ফলাফল হিসেবে তাকে আবারও কলেজ ছাড়তে হয়, কারণ সদ্য শুরু হওয়া ব্যবসা আর কলেজের পড়ালেখা দুটো একসাথে চালিয়ে যাওয়া তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কোনো কিছুই যখন আর হারানোর থাকে না তখনই শুরু হয় প্রাপ্তির উৎসব; Source: youtube.com

প্রেম, ভালবাসা, বিচ্ছেদ ও জীবন

রামানুজন কলেজে অনুষ্ঠিত একটি টেড টকে ওঙ্কার তার বক্তব্যে অসাধারণ কিছু কথা বলে গেছেন। জীবন সম্পর্কে নিজের ভাবনা, ভালবাসা, প্রেম, শোক, প্রেরণার উৎস এসব বিষয় নিয়ে। প্রেম এবং বিচ্ছেদ নিয়ে তার অসাধারণ এই বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন,

“বলিউডের কল্যাণে আমরা সবাই মিলনার্থক চলচ্চিত্র দেখেই অভ্যস্ত। নায়ক এবং নায়িকার কোনো না কোনোভাবে দেখা হবে, তারা একে অপরের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন, তাদের মাঝে প্রেম হবে এবং বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করে সবশেষে ছবির মূল কথা এটাই হবে যে তারপর তারা সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগল। সবাই মিলন, প্রেম বা ভালবাসার কথা বলে। অর্থাৎ আমাদের কাছে একটি সম্পর্কের চূড়ান্ত রূপ অথবা একটি আদর্শ গল্পের শেষটা সবসময়ই মধুর হওয়া চাই। কিন্তু প্রণয় থেকে পরিণয় হওয়াটাই কি একটি সম্পর্কের একমাত্র সম্ভাব্য ফলাফল? কেউ এটা কেন বলে না যে গল্পটা সুখের হল না শেষ অবধি? শেষটা যদি কষ্টের হয় তাহলে কেমন হত পুরো ব্যাপারটা? বিচ্ছেদের পর জীবনে আর কী অপেক্ষা করে থাকে? অমিত সম্ভাবনা নাকি হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া?”

বিচ্ছেদ থেকেও শুরু করা যায় নতুন করে; Source: parents.com

ভালবাসা আর বিচ্ছেদ কতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেন। অসাধারণ এক গল্প দিয়ে শুরু করা কথাগুলোর শেষটা ছিল মনোমুগ্ধকর। তিনি বলেছিলেন,

“আজ থেকে এক সহস্রাব্দ আগে মানুষের ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল। একটা পর্যায়ে এসে মানুষ এই অভাবনীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করা শুরু করে। তখন সৃষ্টিকর্তা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই অতিরিক্ত শক্তিকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। তাঁর প্রথম উপদেষ্টা তাঁকে বলেছিলেন, আপনি একে মাটির তলায় পুঁতে রাখুন, তাহলে মানুষ আর পাবে না। দ্বিতীয় উপদেষ্টার মতে একে সমুদ্রের নীচে রেখে দিলে সেটা বরং ভাল হত। তৃতীয় উপদেষ্টার পরামর্শ ছিল একে পাহাড়ের চূড়ায় রেখে দেওয়ার। তবে এদের কারো পরামর্শই ঈশ্বরের ঠিক পছন্দ হয় নি। আর তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, স্বয়ং মানব হৃদয়ই হবে এই শক্তির গোপন ঠিকানা। আর তখন থেকেই মানুষ এই হারানো শক্তির খোঁজে দিবারাত্রি রত। এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা, যা কিনা লুকিয়ে আছে মানুষের নিজেরই মাঝে, তাকে অধিকৃত করতে চাইলে দরকার ভালবাসা অথবা বিচ্ছেদ।”

প্রথমবারের মতো হৃদয় ভাঙার ফলাফল; Source: youtube.com

শোককে শক্তিতে পরিণত করার মন্ত্র

“ভালবাসা মানুষকে সাহসী করে তোলে। পৃথিবীর প্রতিটি মা ঠিক যে আবেগ দিয়ে সন্তানের জন্য রান্না করেন, ঠিক সেই একই আবেগ তিনি অন্য কারও জন্য অনুভব করতে পারেন না। প্রেমিক যে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রেমিকার হাতে চাঁদ এনে দেওয়ার শপথ করতে পারে সেই একই দৃঢ় মনোভাব অন্য কারও ক্ষেত্রে সম্ভব না। মানুষের স্বভাবটাই এরকম যে সে তার ভেতরে গোপনে রয়ে যাওয়া ভালবাসাকে, প্রিয় মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে পছন্দ করে।

গ্রীকদের মাঝে একটি কথা প্রচলিত আছে, মেরাকি (Meraki) যার অর্থ হলো পূর্ণ হৃদয় দিয়ে কিছু করা। ঠিক একইভাবে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাও মানুষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিতে পারে। বিচ্ছেদ মানে শুধুই বিচ্ছেদ নয়। বিচ্ছেদ মানে অনেকটা নিজেকে খাদের কিনারে আবিষ্কার করা, যেখান থেকে দিগন্তে উড়ে যাওয়া এবং নীচে গড়িয়ে পড়ে যাওয়া, দুই-ই সম্ভব। সিদ্ধান্ত নিতে হবে নিজেকে যে জীবনকে কীভাবে দেখা উচিৎ।

কবির একটা কবিতা শুধুই শব্দগুচ্ছ নয়। অসংখ্য বেদনার্ত রাত পার করে নিজের কষ্টকে লালন করেছেন তিনি সন্তানের মতোই। কবিতা বেদনার্ত কবির কষ্ট সহিষ্ণু সৃষ্টি। একজন গায়কের গান শুধুই গলা ছেড়ে আওয়াজ বের করা নয় কখনোই। অনেক বিরহের পর সাধনা করে তবেই নিজের ভেতরের সব অনুভূতি উজাড় করে গান গাওয়া যায়। নিজের স্ত্রী মুমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত তাজ মহল, সম্রাট শাহজাহানের কষ্ট থেকেই আগত। পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ শিল্পীরাই আজকের অবস্থানে এসেছেন কষ্টের কারণেই। অ্যামি ওয়াইনহাউজ, শেক্সপিয়ার অথবা অ্যাডেলে- যার কথাই বলা হোক না কেন, তাঁরা শো অফ করেছেন তাদের কষ্টগুলো। নিজেদের অর্থ, বৈভব কখনও দেখানোর মতো কিছু না। কষ্টই তাঁদের শক্তি, যার মাধ্যমে তাঁরা পেয়েছেন অনুপ্রেরণা।

নিজের ভুবন কখনও কোনো বাবা, গুরু, স্বামীর মাধ্যমে বদলানো যায় না। বিচ্ছেদের পর নিজের মধ্যে আত্মিক শক্তিকে অনুভব করতে হবে, যার মাধ্যমে একজন পারেন তার নিজেকে আর সাথে সাথে চারপাশকে বদলে দিতে। বিচ্ছেদ পরবর্তী সময় হচ্ছে সেই সময়টা, যখন শুধু আপনিই পারবেন আপনার পাশে থাকতে। জীবনে একটিবার যে মানুষ নিজের পাশে নিজে উপস্থিত থেকে নিজেকে সাহস দিতে পেরেছেন, তার আর কিছুই দরকার নেই। হয়তো সমাজের মাঝে সবচেয়ে ব্যস্ত হবেন আপনি, তবুও দিন শেষে আপনাকে একাকীত্ব ঘিরে ধরবে না। সারাদিন একের পর এক কাজ করার পরও আপনি মনের মাঝে নিজের জন্য জায়গা খুঁজে পাবেন, যেখান থেকে ক্ষণে ক্ষণে প্রতিধ্বনিত হবে যে, আপনি সুখে আছেন!”,

বিচ্ছেদ বা প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট (ভালবাসার মানুষের না বলা, প্রতারণা অথবা মৃত্যু) কীভাবে মানুষকে জীবনে আরও এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে যায় সেই মন্ত্রই এভাবে বলেছেন ওঙ্কার কিশান খুল্লার। 

ফিচার ইমেজ: twitter-kiwami.com

Related Articles