ব্যর্থতা জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও ব্যর্থতাই আমাদেরকে সাফল্যের পথ দেখায়। প্রতিটি মানুষই জীবনে কোনো না কোনো পর্যায়ে ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু সেই ব্যর্থতার প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া এবং তা থেকে তারা কতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, সে ব্যাপারটিই তাদের জীবনে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
যেমন এই ছয়জন সফল উদ্যোক্তার কথাই ধরা যাক। তাদের প্রত্যেকের গল্পই শেষ হয়েছে পাহাড়সম সাফল্যে, অথচ তাদের গল্পের শুরুতে কিন্তু ব্যর্থতাই ছিল। নিজের জীবনের ব্যর্থতাকে কীভাবে মোকাবেলা করবেন, তা বোঝার জন্য তাদের ব্যর্থতার গল্প আমাদের সবার জন্য অনেক শিক্ষণীয় হতে পারে-
১। বিল গেটসের প্রথম কোম্পানি তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছিল
বিল গেটস এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, কিন্তু তার এই সাফল্যের পথ কিন্তু সোনায় খোদাই করা ছিল না। উদ্যোক্তা হিসেবে গেটসের প্রথম কোম্পানি ছিল ‘ট্রাফ-ও-ডাটা’, যে কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল ট্রাফিক ভিডিও থেকে ডাটার প্রসেস এবং অ্যানালাইজ করা। এর জন্য তারা একটা হার্ডওয়্যার ডিভাইসও তৈরি করেন।
তিনি তার ব্যবসায়িক অংশীদার পল অ্যালেনকে সাথে নিয়ে এই আইডিয়াটি যখন বিকানোর চেষ্টা করলেন, তাদের ডিভাইস কাজই করলো না। কোম্পানি ধসে পড়লো শুরু হবার আগেই। কিন্তু এই ব্যর্থতায় বিল গেটস দমে যাননি, এর কয়েক বছর পরই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফট। আর তার পরের গল্প তো আমাদের সবারই জানা!
২। টেলিভিশন জগতের অন্যতম কিংবদন্তি অপরাহ উইনফ্রের শুরুটাও হয়েছিল ব্যর্থতায়
শৈশব থেকেই অপরাহ উইনফ্রের জীবনটা ছিল সংগ্রামের। শৈশবে একাধিক পারিবারিক সদস্যের দ্বারা তিনি হয়েছিলেন যৌন নির্যাতনের শিকার। ১৪ বছর বয়সে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে শেষ পর্যন্ত সে সন্তানও হারাতে হয়েছিল। তারপরও তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেন। অনেক বাধা ডিঙিয়ে তিনি যখন বাল্টিমোরে একটি স্থানীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্কে যোগ দিলেন উপস্থাপিকা হিসেবে, তখনও খারাপ সময় তার পিছু ছাড়লো না। কিছুদিনের মাথায়ই তাকে বহিষ্কার করা হলো, কারণ তিনি নাকি টেলিভিশনের জন্য ‘উপযুক্ত’ নন।
কিন্তু পরবর্তীতে তিনিই ইতিহাসের সফলতম টক শো ‘দ্য অপরাহ উইনফ্রে শো’ এর উপস্থাপিকা হন, প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রোডাকশন হাউজ হারপো প্রোডাকশন্স। এখন হলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী এই নারীকে সম্বোধন করা হয় ‘কুইন অফ অল মিডিয়া’ হিসেবে। সবকিছুর নেপথ্যে কিন্তু ছিল তার সেই হাল না ছাড়ার গল্পই।
৩। বিশ্বের সফলতম ব্লগ ‘হাফপোস্ট’ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন ছত্রিশবার
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্লগগুলোর মধ্যে ‘হাফপোস্ট’ অন্যতম, যার পূর্ব নাম ছিল ‘দ্য হাফিংটন পোস্ট’। ভাবলে অবাক হতে হয়, এর প্রতিষ্ঠাতা আরিয়ানা হাফিংটন, যিনি কিনা অনলাইন লেখক জগতের এখনকার উজ্জ্বল নক্ষত্র, তিনি একসময় তিন ডজন প্রকাশকের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। হাফিংটনের দ্বিতীয় বই, যেটি তার এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, সেটা প্রকাশ হবার আগে একবার নয়, দু’বার নয়, ছত্রিশ বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল!
হাফিংটন পোস্টও কিন্তু শুরুতে এরকম সফল ছিল না। প্রথম যখন ব্লগটি চালু করা হয়, নেতিবাচক রিভিউ দিয়ে একে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল, এর মান এবং কার্যকারিতা নিয়ে শোনা গিয়েছিল অনেক নেতিবাচক মন্তব্য। কিন্তু হাফিংটন সেসব ব্যর্থতাকে ছাপিয়েই হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সফল একটি ব্লগের মালিক।
৪। স্টিভ জবসকে একসময় তার নিজের কোম্পানি থেকেই বের করে দেয়া হয়
উদ্যোক্তা হিসেবে স্টিভ জবস পরিচিত তার উদ্ভাবনী মননের জন্য। একের পর এক নতুন চিন্তা করে তিনি প্রযুক্তির জগতটাকেই বদলে দিয়েছেন। তবে তার জীবনেও একবার এসেছিল কালো অধ্যায়। সেই ব্যর্থতার সময়কেও তিনি মোকাবেলা করেছিলেন বলিষ্ঠভাবে।
বয়স ত্রিশের কোঠায় যাবার আগেই জবস সাফল্য খুঁজে পেয়েছিলেন, যখন ‘অ্যাপল’ একটি বড়সড় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এই সাফল্যই জবসের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যখন ‘অ্যাপল’-এর বোর্ড অফ ডিরেক্টরস তাকে বের করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ তারা ভেবেছিলেন অ্যাপলের মতো অর্থনৈতিকভাবে সফল কোম্পানি চালাবার জন্য জবস উপযুক্ত নন।
কিন্তু এই ব্যর্থতা জবসকে বিচলিত করলো না, বরং তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নেক্সট’ নামক এক নতুন কোম্পানি, যেটি পরে অ্যাপলই কিনে নিতে বাধ্য হলো। অ্যাপলে ফিরে এসে জবস কোম্পানিটিকে পুরো নতুন রূপ দিলেন, এবং সে রূপেই আমরা এখন অ্যাপলকে চিনি।
৫। ওয়াল্ট ডিজনিকে “সৃজনশীলতার অভাব আছে” বলা হয়েছিল!
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব ওয়াল্ট ডিজনিকে একসময় এক খবরের কাগজের চাকরি থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল তার সৃজনশীলতার ‘অভাব’ থাকার কারণে। তখন অভাবে পড়েই ডিজনি চেষ্টা করেন নিজের কিছু দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন, শুধু বই পড়ে একা একাই আয়ত্ত করে ফেলেন অ্যানিমেশনের খুঁটিনাটি। তার প্রথম চেষ্টা ছিল নিজস্ব অ্যানিমেশন কোম্পানি- ‘লাফ-ও-গ্রাম ফিল্মস’, এলাকায় জনপ্রিয়তাও পায় তার অ্যানিমেশনের কাজগুলো। কিন্তু সেই কোম্পানিও একসময় অর্থাভাবে বন্ধ করে দিতে হয় তাকে।
তারপর তিনি পথ খুঁজতে যান হলিউডে, সেখানেও মুখোমুখি হন তিরস্কারের। তারপর হঠাৎই তার কিছু চলচ্চিত্র জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে; তার সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, নৈপুণ্য দিয়ে মন জয় করে নেন বিশ্ববাসীর। এরপর তো তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন ডিজনি সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ফিল্ম স্টুডিও।
৬। ‘হার্শি’স চকোলেট’-এর মিল্টন হার্শি তিন-তিনবার কোম্পানি খুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন
কফির দোকানে দাঁড়ালেই আমাদের চোখে পড়ে ‘হার্শি’স চকোলেট’-এর কৌটা। বিশ্বব্যাপী এর জয়জয়কার। কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন হার্শি যখন ক্যান্ডি প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্যারিয়ার শুরু করেন, তখন তার কিছুই ছিল না। কিছুদিন আগেই এক ছাপাখানা থেকে বহিস্কৃত হয়ে তিনি শুরু করেছিলেন ক্যান্ডির কোম্পানি, একবার নয় দুবার ন, তিন তিনবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি তার কোম্পানি নিয়ে।
এরপর যখন ভাবছিলেন হাল ছেড়ে দেবার কথা, শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি শুরু করেছিলেন ল্যানকেস্টার ক্যারামেল কোম্পানি, এবং সেখান থেকে কিছুটা সফলতা পাওয়া শুরু করেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন, যে সাধারণ মানুষের মাঝে চাহিদা আছে দুধেল চকোলেটের। সেই ভাবনা থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দা হার্শি কোম্পানি’, যেটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় চকোলেট প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানির মধ্যে একটি। বিশ্বের ৬০টি দেশে এখন এর প্রসার রয়েছে।
তাই পরবর্তীতে যখন জীবনে ব্যর্থতার সম্মুখীন হবেন, অনুপ্রেরণা নেবেন এই গল্পগুলো থেকে। হ্যাঁ, জীবনে কোনো এক পর্যায়ে হয়তো বড় কোনো ব্যর্থতা আসবে, মনে হবে এখানেই বুঝি আপনার পথের শেষ; কিন্তু মনে রাখবেন, বিশ্বে এখন ছড়িয়ে আছে অগণিত সফল মানুষ, যারা ব্যর্থতার সময়ে হাল ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন বলেই আজ সফল হয়েছেন। এসব মানুষগুলোই হতে পারে আপনার প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা।
তাই প্রতি ব্যর্থতায় ভুল থেকে শিক্ষা নিন, আর নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকুন যত বড় বাধাই আসুক না কেন।
ফিচার ইমেজঃ vfix365.us