একটি পরিপূর্ণ সাফল্যে যদি একটু ব্যর্থতার ছিটেফোঁটা না থাকে, তাহলে পুরো সফলতাটাই একটু ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায়। তাই বলে ব্যর্থ হবার আশায় বসে থাকাটাও আপনার বোকামির একটা অন্যতম অংশ বলেই বিবেচিত হবে। তবে ব্যর্থ হলেই যে আপনি সফল হবেন, তা-ও কিন্তু বলা হয়নি। সফলতার মাত্রা তখনই প্রকাশ পায়, যখন আপনি আপনার ব্যর্থতা থেকে কতটুকু শিক্ষা নিয়ে সেটিকে আপনার জীবনের উপর প্রয়োগ করছেন সেটা বোঝা যায়। কথা না বাড়িয়ে আজ এমনই দুজন মানুষের সাথে পরিচিত হবো, যারা ব্যর্থ হওয়া কিংবা নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করতে কখনো পিছপা হতেন না এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার গুণটি তারা আমূলে অর্জন করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের একটি অন্যতম উপন্যাস ‘পন্ডিতমশাই’-এর নায়িকা কুসুমের বাল্য ইতিহাস সম্পর্কে একনিষ্ঠ তথা পড়ুয়া পাঠকগণ হয়তো অবগত আছেন। সেই কুসুমের জীবনটি খুব অল্প বয়সেই দুটি বিয়ে, বিচ্ছেদ, দারিদ্র এবং সামাজিক নিগ্রহ দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আমেরিকার এই বিখ্যাত সেলিব্রেটি অপরাহ উইনফ্রের বাল্যকালের গল্পটাও ঠিক সেই কুসুমের মতোই।
বলাবাহুল্য, শরৎবাবুর কুসুম শেষমেশ হয়েছিলেন সন্ন্যাসী আর অপরাহ হয়েছেন সেলিব্রেটি। তবে আমেরিকার পঞ্চাশের দশকে জন্ম নেওয়া একটি কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ের জন্য এই আলো করা সফলতা নিয়ে আসার পথটা অনেকটাই বন্ধুর ছিলো। চলুন ঘুরে আসি, অপরাহ উইনফ্রের ভাগ্য বদলে যাওয়ার সফর থেকে।
অপরাহ উইনফ্রে
অপরাহ উইনফ্রের জন্ম হয় আমেরিকার সবচেয়ে দরিদ্রতম শ্রেণীর একটি আফ্রো-আমেরিকান পরিবারে। আর সেই সূত্রে তার শৈশবটাও কেটেছে প্রচন্ড দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে। দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ জীবনে নরকের পূর্ণতা দিতে নয় বছর বয়সেই তার উপর আসে যৌন নির্যাতনের আঘাত। যৌন নির্যাতন সয়েও কিছুদিন ছিলেন মায়ের ঘরে। বয়স যখন ১৩ বছর, তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু বিধিবাম, আবার সেই দরিদ্র আফ্রো-আমেরিকানদের বিরূপ পরিবেশ, আবার সেই যৌন নিপীড়নের শিকার হলেন ঘর পালানো এই কিশোরী। ১৪-তে মা হলেন, আবার সেই সন্তানটিও মারা গেল। জীবন যেন হয়ে উঠল আরও চরম মাত্রায় দুর্বিষহ।
এরপর একটি অসাধারণ মোড় আসলো এই কিশোরী অপরাহের জীবনে, আমেরিকার অঙ্গরাজ্য টেনেসিতে তার বাবার সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন অপরাহ। বাবার তত্ত্বাবধানে লেখাপড়াতে কৃতিত্বের পাশাপাশি স্কুল কলেজে বক্তৃতা এবং বিতর্কেও খুব স্পষ্ট ও সাবলীল ছিলেন তিনি। এরই বদৌলতে স্থানীয় একটি রেডিওতে খন্ডকালীন চাকরি জুটে যায় তার।
এরপর মিডিয়ায় প্রতি অগাধ আগ্রহ থেকেই, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশীপ জিতে গণযোগাযোগ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেন। তখনকার দিনে খুব বিখ্যাত একটা টেলিভিশন শো’তে সংবাদ উপস্থাপনায় সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ হাতে চলে আসে পড়াশোনা শেষ হতে না হতেই। ঐ সংবাদ অনুষ্ঠানটির প্রধান সঞ্চালক ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক জেরি টার্নার। সংবাদ অনুষ্ঠানটিতে একপাশে বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ জেরি টার্নার আর অন্যদিকে উঠতি তরুণী কৃষ্ণাঙ্গ অপরাহ উইনফ্রে। তখনকার হাল আমলে বর্ণবাদ তথা আফ্রো-আমেরিকান যাবতীয় সকল পরিস্থিতি মিলিয়ে মিডিয়ায় ভালো একটা শোরগোল তৈরি হলো। সবদিকে বেশ একটা পরিচিতি তৈরি হলো অপরাহ উইনফ্রের। তিনি ভাবলেন জীবনের এই লগ্নে এসে বোধহয় কিছুটা স্বস্তি মিললো।
কিন্তু যার জীবনের গন্তব্য নির্ধারিত হয়ে আছে আরও অনেক বড় কিছুর জন্য, তার কি আর হোঁচট না খেলে চলে? তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া মিডিয়ার উত্তেজনা ঠিক সামলাতে পারলেন না অপরাহ। সহ-উপস্থাপক জেরি টার্নারও বিরূপ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে অপরাহ ছাঁটাই হলেন বিখ্যাত সংবাদ অনুষ্ঠানটির সহকারী সংবাদ উপস্থাপনার পদ থেকে। উঠতি তারকার খেতাব পেতে যাওয়া অপরাহকে দেওয়া হল নগন্য স্ট্রিট রিপোর্টিং আর কপি রাইটিং এর কাজ। কপি রাইটিং এ তেমন একটা দক্ষতা না থাকায় এখানেও হোঁচট খেলেন অপরাহ। ফলাফল এখান থেকেও ছাঁটাই।
কিন্তু মানুষ যেটাকে বললেন অপরাহর দুর্বলতা, সেটাকে তিনি করে নিলেন নিজের শক্তির জায়গা। কিন্তু আমরা কী করি, নিজের যেটা দুর্বলতার জায়গা সেটাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তিনি দেখলেন টেলিভিশন মিডিয়াই তার ভালো লাগার জায়গা। তিনি শুনতে ভালোবাসেন মানুষের গল্প, একটু অনুভূতিপ্রবণ হয়ে পড়া। তিনি দেখলেন এটাও একটা শক্তি, এরও দর্শক আছে টেলিভিশনে।
এই শক্তিকে পুঁজি করে তিনি শুরু করলেন নতুন একটি টেলিভিশন শো। দিলেন তার নিজের নামে দি ‘অপরাহ উইনফ্রে শো’। জনপ্রিয় হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। যুগান্তরকারী এই শো ভেঙ্গে দিল বিগত টেলিভিশন শোয়ের সবক’টি ইতিহাস। বিগত ২৫ বছরে এই টেলিভিশন শো সারা দুনিয়ায় কোটি কোটি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় এক নাম।
ওয়ারেন বাফেট
তরুণ এক বিনিয়োগকারী শেয়ার মার্কেট থেকে কিনলেন বার্কশায়ার হাথাওয়ে নামের কোম্পানির কিছু শেয়ার। ভাগ্যক্রমে বেশ কম মূল্যেই তিনি শেয়ারগুলো পেলেন। তৎকালীন মুদ্রায় প্রতি শেয়ারের দর মাত্র সাড়ে সাত ডলার। তখনকার বাজারেও ওই শেয়ারের দাম কম করে হলেও ২০ ডলার করে ওঠানামার মধ্যে ছিল। বিনিয়োগকারী বেশ বড়সড় লাভের আশা করেই বসে ছিলেন। আশার পালে হাওয়া লাগতেও দেরি হলো না। স্বয়ং কোম্পানির প্রেসিডেন্ট তাকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। প্রেসিডেন্ট সিব্যারি স্ট্যানটন কোম্পানিতে নিজের শেয়ার আরো বাড়ানোর জন্যই তার শেয়ারগুলো কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ভালো লাভও দিতে চাইলেন, কেনা দরের চেয়ে ৪ ডলার বাড়িয়ে ১১.৫০ ডলার করে দাম বলে দিলেন। সানন্দে রাজি হয়ে হাসিমুখেই কোম্পানির প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন তরুণ ওই বিনিয়োগকারী। মুখের হাসিতে ফুটে উঠলো একটি তৃপ্তির রেখা। কিন্তু সেই হাসি মুছে যেতেও সময় লাগলো না বেশি।
বার্কশায়ার হাথাওয়ে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট যখন তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে শেয়ার কেনার প্রস্তাব পাঠালেন, সেখানে দরটা সামান্য একটু কমিয়ে ১১.৫০ এর জায়গায় ১১.৩৭ করে দিলেন। খুব বেশি হেরফের নয়। কিন্তু তরুণ এই বিনিয়োগকারীর মনে হলো তাকে অপমান করেছেন স্ট্যানটন। ব্যস আর যায় কোথায়! প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন রেগেমেগে। আর মনে মনে করে বসলেন এক অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি। এরপর শুরু করে দিলেন ওই কোম্পানির শেয়ার কেনা। যত টাকা লাগে লাগুক। একসময় তিনিই হলেন কোম্পানির মেজর শেয়ার হোল্ডার। বার্কশায়ার হাথাওয়ে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হয়ে হঠিয়ে দিলেন স্ট্যানটনকে। নিলেন দারুণ প্রতিশোধ। কিন্তু সেটা তো ব্যক্তিগত অপমানের। কিন্তু আসল যে উদ্দেশ্য সেই ব্যবসার কিন্তু অবস্থা তেমন একটা ভালো না।
ততদিনে ব্যবসায় মন্দাভাব লেগেছে কোম্পানিতে। তখনকার দিনে বার্কশায়ার হাথাওয়ে ছিল একটি টেক্সটাইল কোম্পানী। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে তুলা আমদানি করে কাপড় তৈরি করে বাজারজাত করতো তারা। দক্ষিণাঞ্চলে কাঁচামাল ও সস্তা শ্রম মিললেও সেখানে অধিক আর্দ্রতা ও গরম আবহাওয়ার কারণে কারখানা তৈরি সম্ভব ছিল না। আর তখনও এয়ারকন্ডিশনিং প্রযুক্তির বিকাশ হয়নি। ফলে তুলা আমদানি করে কাপড় তৈরির ব্যবসাটাও বেশ লাভজনক ছিল। কিন্তু এই জেদি বিনিয়োগকারী যতদিনে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, ততদিনে এয়ারকন্ডিশনিং প্রযুক্ত সহজলভ্য হওয়ার ফলে দক্ষিণে অনেকেই কাপড়ের কারখানা তৈরি করতে লাগলেন। সেখানে শ্রম সস্তা আর কাঁচামাল স্থানীয়। ফলে মার খেতে লাগলো বার্কশায়ার হাথাওয়ের মতো আরও এসব কোম্পানি।
এত জেদ করে কোম্পানির শেয়ার কিনে প্রেসিডেন্ট হয়ে শেষে এই হাল হওয়ায় কিছুটা হতাশ হলেন ওই বিনিয়োগকারী। কিন্তু দমে গেলেন না। খুঁজতে লাগলেন বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র। এদিকে কাপড়ের ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে ১৯৮৫ সালে বার্কশায়ার হাথাওয়ে তাদের সর্বশেষ কাপড়ের কারখানাটিও বন্ধ করে দেয়। তখনকার দিনে আমেরিকায় ইনস্যুরেন্স ব্যবসা সবে বিকশিত হবার পথে। কোম্পানির বিনিয়োগের ক্ষেত্র তিনি ঘুরিয়ে দিলেন। কাপড়ের ব্যবসা থেকে বীমার ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে লাগলেন। কিন্তু শুধু যে বীমাখাতেই বিনিয়োগ করেছেন বাফেট তা নয়। বার্কশায়ার হাথাওয়ে কোম্পানির বিনিয়োগের ক্ষেত্র তিনি বিস্তৃত করেছেন আরও অনেক দিকেই। যার ফলে গত পঞ্চাশ বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যমানের একটি বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে বার্কশায়ার হাথাওয়ের নামে। আর এই সবকিছুর পেছনে যে বিনিয়োগকারীর অবদান তার নাম হচ্ছে ওয়ারেন বাফেট। অন্যতম ধনী হিসেবে সারা বিশ্বের মধ্যে আজ তার একক পরিচিতি রয়েছে।
অথচ এর সূচনা ছিল একটি ভুল, অনেকখানি জেদ আর অমীমাংসিত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবার মতো ব্যর্থতা দিয়ে। ওয়ারেন বাফেট নিজেও স্বীকার করেছিলেন, বার্কশায়ার হাথাওয়েতে বিনিয়োগ করা তার মস্ত একটি ভুল ছিল। তিনি পরে ঠিকই ভেবেছেন, “আমি যদি জীবনে কখনো বার্কশায়ার হাথায়ের নাম না শুনতাম, তাহলে আমি হয়তো আরও ভালো করতাম।” তাই যা-ই বলা হোক না কেন, এত সম্পদ ওয়ারেন বাফেট অর্জন করতে পেরেছিলেন তার পেছনে কারণ ছিল তিনি ব্যর্থতা স্বীকার করতে কখনও ভয় পেতেন না এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার গুণটি তিনি অর্জন করেছিলেন।