স্রষ্টা যার একটি অনুভূতি কেড়ে নেন তাকে আরও হাজারো অনুভূতির সাথে সখ্যতা তৈরি করিয়ে দেন। হয়তো দুর্বোধ্যকে দুর্নিবার শক্তি দিয়ে পরাস্ত্র করার ক্ষমতাই তাদের বন্ধুর পথ পাড়ি দেবার সঙ্গী। যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, দৃষ্টিহীন হয়েও এভারেস্ট জয় করা সম্ভব কি না তাহলে আপনার উত্তর কী হবে? ভ্রু-জোড়া সংকুচিত হয়ে কপালে ঈষৎ ভাঁজের সৃষ্টি হবে। হয়তো বলবেন সম্ভব না। কিন্তু এরিক ওয়েহেনমায়ার তা সম্ভব করেছেন।
গল্পের শুরু
গল্পের শুরুটা ১৯৬৮ সালে নায়কের জন্ম থেকেই। ১৫ মাস বয়সে তার জুভেনাইল রেটিনোসকাইসিস নামক বিরল রোগে আক্রান্ত হবার কথা জানা যায়। ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি ফিকে হতে হতে ১৪ বছর বয়সে এসে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায় সে। সাধারণ গল্পে কী হতো? বালকটি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়বে, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই বালকের ক্ষেত্রে গল্পটি উল্টো। সে প্রচন্ড মানসিক শক্তি নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকে।
ধীরে ধীরে তার আগ্রহ জন্মে রেসলিং এর প্রতি। সেখান থেকে হাই স্কুলের সেরা রেসলার প্লেয়ার হয়ে ওঠা, দলের ক্যাপ্টেন হওয়া এবং এভাবেই খেলাধুলায় সাফল্য আসতে থাকে। এর পাশাপাশি আরেকটি আগ্রহ তার ভেতরে জন্ম নেয় রক ক্লাইম্বিং বা পর্বতারোহণ। অনুশীলন চলতে থাকে সেটিরও।
গল্পের এই নায়কের নাম এরিক ওয়েহেনমায়ার। গল্পে না হয় সংক্ষেপে তাকে এরিক বলেই সম্বোধন করা যাক।
প্রথম সুযোগ
দৃষ্টি হারানোর বেশ কিছুদিন পরে ব্রেইলে একটি নিউজ-লেটার পান এরিক। সেখান থেকে জানতে পারেন একটি দল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে রক ক্লাইম্বিং এ যাবে। এরিক যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। এমন সুযোগ কি আর হাত ছাড়া করা যায়! নিজের নামটি নিবন্ধন করে ফেললেন তিনি। যাত্রা শুরুর প্রথম ধাপ বলা চলে। শুধুমাত্র খেলাধুলা আর অ্যাডভেঞ্চার নিয়েই জীবন যায়নি এরিকের। ‘ডবল মেজর’ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিনি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি আবার সেই স্কুলের রেসলিং কোচও হয়েছিলেন। টিকিয়ে রেখেছেন পর্বতারোহণের অনুশীলনও। সেই সুবাদে তিনি অ্যারিজোনা পর্বতারোহী ক্লাবের সাথে যুক্ত থেকে অনুশীলন করতে থাকেন অবসর সময়ে।
প্রথম শৃঙ্গ জয়
সালটা ১৯৯৫। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০, ৩১০ ফুট উঁচু উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ডিনালি পর্বত। পৃথিবীর সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে ডিনালির অবস্থান তৃতীয়। আলাক্সা পর্বতশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এ পর্বতে নিঃসন্দেহে এক নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছিলেন এরিক। যখন তিনি এর সর্বোচ্চ চূড়ায় পদচিহ্ন অঙ্কন করতে সক্ষম হন।
আর্কটিক চক্রের খুব কাছে অবস্থান হওয়ায় ডিনালিতে প্রায় সবসময়ই ভারি তুষারপাত, তীব্র ঠান্ডা হাওয়ার ঝটকা এবং জমে যাওয়ার মতো আবহাওয়া থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে ২৪ দিনের বিরতি শেষে যখন সহযাত্রীরা হাল ছেড়ে দিতে চাইল তখন এরিকের জেদ আর দুঃসাহসিক মনোবল তাকে চূড়ায় ওঠার প্রেরণা জুগিয়েছিল। মাঝপথে সহযাত্রী একজনের ঠান্ডায় মৃত্যু ঘটা এবং বরফে মৃতদেহ ঢাকা পড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও তাকে পিছপা করতে পারেনি। ফলাফল? দুঃসাহসিক দৃষ্টিহীন যাত্রীর দৃষ্টিহীন পর্বতের চূড়ার সাথে সখ্যতা। এরিক ওয়েহেনমায়ার জয় করেন উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ডিনালি।
মিশন মাউন্ট এভারেস্ট
অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাছে সর্বকালের সেরা আকর্ষণের নাম এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গ। এ আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি লুফে নেওয়াও। এখানে পদে পদে যেন বিপদ ওঁতপেতে থাকে। একটু এদিক ওদিক হলেই নির্ঘাত মৃত্যু। যদিও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা এসব মৃত্যুকে পরোয়া করেন না। এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে ১৯৫৩ সালে প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার পর এভারেস্ট নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল যা হয়তো পরবর্তী আরোহীদের ক্ষেত্রে পায়নি। কিন্তু এ গল্পের নায়ক এরিকের এভারেস্ট চূড়ায় পদক্ষেপ হয়তো এভারেস্টের কাছেই এক বিস্ময়।
দৃষ্টিহীনতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে মানসিক শক্তি এবং কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে এভারেস্ট জয়ের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন এরিক। ২০০১ সাল। এরিক ওয়েহেনমায়ার সহযাত্রীদলের সাথে এভারেস্টের পথে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে কাঠমান্ডু যাত্রা। কাঠমান্ডুতে মানুষকে বিশ্বাস করাতে তাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল যে তিনি সত্যিই এভারেস্ট জয়ে যাচ্ছেন। কটু কথা, তাচ্ছিল্য সবকিছুই নিরবে মেনে নিয়েছেন। শেরপা পেতে খুবই কষ্ট হয়েছিল এরিকের। অনেক কষ্টে যখন তাদের বোঝানো গেল তিনি দৃষ্টিহীন কিন্তু শারীরিকভাবে পুরোপুরি সক্ষম তখন শেরপার দল এরিককে তাদের সাথে নিতে রাজি হলেন।
সহযাত্রী প্রত্যেকের মনে এত বেশি দ্বন্দ্ব ছিল তাকে নিয়ে যে তিনি মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। অনেকেই বলেছেন তিনি আবহাওয়া, তুষারপাত বা বায়ুপ্রবাহের রকম-সকম নির্ণয় করতে পারবেন না কেননা তিনি দেখতে পান না! কিন্তু এরিক জানতেন তার অনুভূতি ক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের থেকেও বেশি।
সবকিছু পেরিয়ে এরিক যখন চূড়ার প্রায় কাছাকাছি সেই সময়টা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়ংকর সময়! একে তো নিজের ভেতরে দুরু দুরু ভাব, তার উপর সহযাত্রীদের দিকনির্দেশনা। একজন বলছে এইদিক দিয়ে দুই পা গেলেই শৃঙ্গ, আরেকজন বলছে আর দশ পা। তবে এরিক সম্পূর্ণ মনোযোগকে একবিন্দুতে এনে নিজের পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এভারেস্টে সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রাখেন। দিনটা মে মাসের ২৫ তারিখ। এর মাধ্যমে ইতিহাস গড়েন এরিক ওয়েহেনমায়ার। প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এভারেস্ট জয়ী। এই জয় নিজের ইচ্ছাশক্তির জয়, এ জয় সমালোচকদের অবিশ্বাসকে বিশ্বাসে পরিণত করতে পারার জয়, এ জয় প্রতিবন্ধীতাকে অতিক্রম করার জয়।
সপ্ত শীর্ষ জয়
এভারেস্ট জয়ে করেই থেমে থাকেননি গল্পের এই নির্ভীক নায়ক। ডিনালি এবং এভারেস্ট জয় ছাড়াও সাত মহাদেশের বাকি ৫টি সর্বোচ্চ পর্বতও তিনি জয় করেন ২০০৪ সালের মধ্যে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কায়াকেড জয় ছিল তার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
নো ব্যারিয়ারস
দৃষ্টিহীন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী শৃঙ্গারোহী এরিক ওয়েহেনমায়ার বেশ ভালো করেই বুঝেছিলেন বাধা আছে এবং থাকবে। সবসময় অনুধাবন করা যায় না। কিন্তু সেগুলোই জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই বাধাকে কীভাবে অতিক্রম করতে হয় তা এরিকের চেয়ে ভালো আর কেই বা জানেন! যারা তার মতো বাধাকে বাধা হিসেবে না নিয়ে জীবনযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দিতে চান তাদেরকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন ‘নো ব্যারিয়ারস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানের ট্যাগলাইনটি বেশ অনুপ্রেরণা দেয়:
তোমার চলার পথের চেয়ে তুমি শক্তিশালী।
ঝুঁকি নেওয়া, দলগতভাবে কাজ করা এবং স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে নো ব্যারিয়ারস। এরিকের অনুপ্রেরণায় দৃষ্টিহীন, শ্রবণ প্রতিবন্ধী এমনকি অঙ্গহীন এমন অনেকেই পর্বতারোহণ করেছেন।
বক্তা এবং লেখক এরিক
মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে এরিক ওয়েহেনমায়ার খুবই জনপ্রিয়। তার পোষা কুকুর সঙ্গীটিও তার সাথেই থাকে। নিজের অভিজ্ঞতা এবং অন্যকে অনুপ্রেরণা প্রদানে এরিক বইও প্রকাশ করেছেন। রয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইটও। নিজের ইচ্ছাশক্তির কাছে যে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কোনো বাধাই না তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এরিক ওয়েহেনমায়ার। মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পড়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখাই জয়ের অন্যতম পন্থা। যদিও সামাজিক সহযোগিতাও এক্ষেত্রে খুব জরুরি।