ছেলেমেয়েরা ভালো কিছু করলে বাবা-মা খুশী হয়, গর্ব করে, দশটা মানুষের কাছে গল্প করে। “জানেন, আমার ছেলে/মেয়েটা না…”। আর ছেলেমেয়েরা? বাবা-মাকে নিয়ে বন্ধুদের কাছে হাসিমুখে কথা বলতে কত ভালোই না লাগে। “আমার বাবা সব পারে” আর “আমার মা অলরাউন্ডার”- কথাগুলো বলতে গেলে ছোট্ট মানুষগুলোর মন যেন ভরে যায়, খুশীতে ছটফট করে ওরা বাবা-মাকে মনে করে। কিন্তু সব ছেলেমেয়ের ভাগ্যে কী এই ভালোলাগা থাকে? সন্ত্রাসী আর খুনী বাবা-মাকে নিয়ে কী-ই বা বলা যায়? কার কাছেই বা বলা যায়? আর যদি কারো বাবা-মা হয় সিরিয়াল কিলার? কল্পনা করতে পারছেন? কাজটা কঠিন। যেটা কল্পনা করাটাই কঠিন সেই সত্যের ভেতর দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে অনেক শিশু। কেমন ছিলো তাদের জীবন? কেমন ছিলো তাদের শৈশব আর বড়বেলা?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ইতিহাসে বেশীরভাগ সন্ত্রাসী আর খুনীর ছেলে-মেয়েই বড় হয়ে বেছে নিয়েছে বাবা-মায়ের দেখানো পথ। সিরিয়াল কিলারের সন্তান হয়ে গিয়েছে আরেকজন সিরিয়াল কিলার। তবে মেলিসা মুরের গল্পটা একটু অন্যরকম।
বাবা সাথে থাকতো না। মায়ের সাথে অনেকদিন ধরেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো। তবু বাবাকে দেখলে বাচ্চার মতন খুশী হয়ে উঠতো মেলিসা। বাবা মেলিসা আর মেলিসার ভাইকে নিয়ে বাইরে খেতে যেত, ঘুরে বেড়াতো। আর সেরকম এক দিনের কথা…
“১৯৯৪ সালের এক শরৎকাল ছিল সেটা। আমি আর আমার ভাই বোনেরা বাবার সাথে করে তার ট্রাকে চড়ে বসেছিলাম। আমাদেরকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল বাবা সকালের খাবারের জন্যে। আমার বাবা কেইথ জ্যাসপারসন। পেশায় একজন সাধারণ ট্রাক চালক (অন্তত তখনো অব্দি আমরা তাই জানতাম) ছিল বাবা। মায়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে বাবার সাথে খুব কমই দেখা করা হত আমাদের। তাই সেদিন বাইরে সবাই মিলে বের হবার পর বেশ ভালো লাগছিল। খুশি ছিল আমার আর দুই ভাইবোনও। কিন্তু রাস্তার মাঝখানেই দরকারী কিছু কাজের জন্যে নেমে যায় ওরা। গাড়িতে করে বাবার সাথে খেতে যাই কেবল আমি।
বাবা সবসময়ই সিগারেট খাওয়ার খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে বলতো আমাদেরকে। মানা করত সিগারেট খেতে। নিজেও অপছন্দ করত ওটাকে। কিন্তু সেদিন সকালে বাবার ট্রাকে এক প্যাকেট সিগারেট দেখতে পায় আমার ছোট ভাই। বাবাকে বলে, বাবা সিগারেট খাচ্ছে কিনা? বাবা স্রেফ ‘না’ বলে। আমার বন্ধুদের জন্য ওটা নিয়েছি, বলেছিল বাবা। সেসময় বাবার ট্রাকের একটা কোনায় একটা টেপও দেখতে পাই আমি। বাবা ট্রাকে টেপ দিয়ে কী করে?” বলে মেলিসা। তবে সেটা বর্তমানের কথা। বাবার সাথে সেই সময়গুলোতে খটকা লাগলেও মুখ ফুটে প্রকাশ করেনি মেলিসা। বাবার সাথে কাটানো সময়গুলোকে মনে করে এখনও শিউরে ওঠে সে। বাবাকে বড্ড ভালোবাসতো সে। তবে বাবার আগ্রহ এসবে ছিলো না।
সারাক্ষণ রাস্তার ধার ঘেঁষে হেটে চলা মেয়েদের কুৎসিত ইঙ্গিত দিয়ে যেতেন কেইথ জেসপারসন আর সেগুলোকে অসম্ভব কষ্ট করে হজম করতো পনেরো বছর বয়সী মেলিসা। অবশ্য যে দিনটার কথা বলছিলো মেলিসা সেটা আর দশটা দিনের মতন ছিলো না। ট্রাকে ঐ জিনিসপাতিগুলো দেখে ফেলার পর কেমন যেন থমকে গিয়েছিলেন মেলিসার বাবা। খাওয়ার সময় মেয়েকে জানিয়েছিলেন কিছু জরুরী কথার ব্যাপারে। মেলিসা অবশ্য জানতে চায়নি সেসব। খুব ভয়ংকর কোনো আভাস পাচ্ছিলো যেন সে। সেদিনের মতন শেষ হয় বাবা-সন্তানের ঘোরাঘুরি। ঘরে ফিরে সব ভুলে গিয়েছিলো মেলিসা। তবে সেটা কয়েকদিনের জন্য। কিছুদিন বাদেই হঠাৎ করে জানতে পারে মেলিসা- তার বাবা একজন খুনী! একজন সিরিয়াল কিলার!
১৯৯৫ সালের এক আলো ঝলমলে সকাল। খুব সাধারণ এক মেয়েকে সেদিন ভয়ংকর এক সিরিয়াল কিলারের মেয়ে হিসেবে দেখতে শুরু করলো সবাই। সবাই এড়িয়ে যেতে শুরু করলো, যেন খুব বাজে অপরাধ করেছে মেয়েটি। স্কুলের বন্ধুরা সরে গেল পাশ থেকে। সমাজ থেকে অনেকটা একঘরে হয়ে গেল সে। সবাই বলতে লাগলো, বাবা কেইথ জেসপারসন আসলে একটা খুনী! তবু কেন যেন বারবার মনে হত মেলিসার, বাবা এমন কাজ করতে পারে না! একেবারেই পারে না!
“ছোটবেলার কথা মনে হত তখন বারবার। আমার বয়স পাঁচ ছিলো। বাবা তখন আমাদের সাথেই থাকত। একবার অনেকগুলো বিড়ালের বাচ্চাকে পেয়েছিলাম আমরা বাসার কোনায়। বাবা সেগুলোকে নিয়ে তারে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। পরদিন সকালে সেগুলোর লাশ আমি দেখতে পেয়েছিলাম বাসার পেছনে। আরেকদিনের কথা। একটা বেড়ালকে পুষব বলে ঠিক করেছিলাম আমরা ভাই-বোনেরা। বাবা সেটাকে এক হাতে পিন দিয়ে খোঁচা মারছিল আর অন্য হাতে গলা মুচড়ে ধরেছিল। মারা গিয়েছিল সেটাও। ওদেরকে মারার সময় অন্যরকম একটা আনন্দ ফুটে উঠত বাবার চোখে-মুখে। জানতাম বাবা নিষ্ঠুর। তাই বলে এতটা জানতাম না। বাবা আমাদের ভালোবাসতো।“
মেলিসার ভাবনা ভুল ছিলো না। মেলিসার বাবা কেইথ জেসপারসন তার মেয়েকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। তবে নিজের বান্ধবী জুলি সহ আরো কয়েকজনকে খুন করেন এই নিরীহ ভালোমানুষ বাবা। মোট আটজন নারীকে হত্যা এবং ধর্ষণ করেন তিনি। এছাড়া প্রমাণ নেই এমন মোট ১৫০টি খুনের জন্য দায়ী করা হয় তাকে। মিডিয়ায় তার পরিচিতি হয় “হ্যাপি ফেস কিলার” বা “সুখী মানুষের মুখোশ পরা খুনী” হিসেবে। খুন করার সময় স্মাইলি মুখোশ পরতেন কেইথ জেসপারসন।
বাইরের সবার কাছে এ গল্পটি ছিলো শুধুই সিরিয়াল কিলার কেইথ জেসপারসনের। তার নানারকম খবর আসতো রোজ পত্রিকার কাগজে। তবে এই পুরো ঘটনা মেলিসা নামের আরেকটি ছোট্ট মেয়ের জীবনকেও যে কতটা ওলটপালট করে দিয়েছিলো সেই খবর রাখার মতন কেউ ছিলো না তখন। হতাশ হয়ে কয়েকবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করে মেলিসা।
তবে লাভ হয়নি কখনোই। এত কষ্টের ভেতরে হঠাৎ কোথা থেকে একজন সঙ্গী জুটে যায় মেলিসার জীবনে। পরবর্তীতে বিয়ে করে সে জীবনের একমাত্র বন্ধুকে, সন্তান জন্ম নেয় মেলিসার।
তবু কোথাও একটি যেন কাঁটা খচখচ করছিলো। মনে হচ্ছিলো, কিছু একটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। এই সময় সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে নিজের জায়গা থেকে অপরাহ উইনফ্রের শো-তে আসার পরিকল্পনা করে মেলিসা। নিজের জীবন নিয়ে, নিজের বাবাকে নিয়ে কথা বলে সবার সামনে। বিবিসিতেও নিজের অভিজ্ঞতাগুলো জানিয়ে শুরু করে সম্পূর্ণ নতুন একটি উদ্যোগ, তার মতন আর সব মানুষকে সাহায্য করার উদ্যোগ।
সত্যিই তো, একজন সিরিয়াল কিলার নাহয় দোষী, কিন্তু তার পরিবারের মানুষগুলো তো কোনো দোষ করেনি। তারা কেন শাস্তি পাবে? এই চিন্তা থেকে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে এমন সিরিয়াল কিলারের সাথে যুক্ত পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করে মেলিসা। তাদের কাছে গিয়ে ভালোভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়া- এটুকুই তার লক্ষ্য। মেলিসা হয়তো আত্মহত্যা করতে গিয়েও বেঁচে ফিরেছে। কিন্তু যদি কেউ সত্যিই মারা যায় মানসিক যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে? টেলিভিশনে নিজের কথাগুলো বলার পর প্রায় ৩০০টি পরিবার যোগাযোগ করে মেলিসার সাথে। তাদের সবাই ঠিক মেলিসারই মতন। ছুটে যায় মেলিসা মুর তাদের কাছে। তবে এটুকু করেও যেন মন ভরছিলো না মেলিসার।
বাবার কারণে আজ যাদের পরিবার কষ্টে আছে তাদের সাথে যোগাযোগ করে মেলিসা। ক্ষমা চায় বাবার পক্ষ থেকে। এতকিছুর পরেও বাবাকে ভুলতে পারেনি মেলিসা। মনের কোথাও না কোথাও বাবার জন্য একটু ভালোবাসা যেন তখনো জমে ছিলো তার। হাজার হোক, বাবা তো! তবে ২০১৫ সালে দাদীর কাছ থেকে জানতে পারে বাবা চাচ্ছিলো মেলিসাকেও খুন করতে। কেবল সময় আর সুযোগের অভাবেই পারেন নি। কথাগুলো শোনার পরপরই বাবার সাথে মানসিক সব সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মেলিসা। দানব, সে সবক্ষেত্রেই দানব। তবে নিজের কাজ থামায়নি মেলিসা মুর।
নিজের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে “শ্যাটার্ড সাইলেন্স: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব সিরিয়াল কিলার’স ডটার” বইয়ে নিজের লড়াই করার কথা লেখে মেলিসা। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। এলএমএন-এ “মনস্টার ইন মাই ফ্যামিলি” নামে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এখনও নিজেদের পরিবারের সন্ত্রাসীর কারণে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া মানুষগুলোকে সহায়তা করে যাচ্ছে সে। এ বছর অনুষ্ঠানটির দ্বিতীয় সিজন শুরু হয়েছে। মানুষ হয়তো পারে। বাবা-মা যেমনটাই হোক, নিজেকে সেখান থেকে বের করে এনে ভালো একটা জীবন হয়তো যাপন করতে পারে কেউ কেউ। কিন্তু নিজের সাথে আরো কয়েক হাজার মানুষের জীবনে খুশী এনে দেওয়া- সেটা কয়জন মানুষ পারে? একজন সিরিয়াল কিলারের সন্তান হয়েও আলোকিত মানুষ হতে, মানুষের জন্য নিজের জীবনকে সাঁজাতে কয়জন পারে? মেলিসা মুর পেরেছে। ভালোবাসা রইলো মেলিসা মুরের জন্য।