বয়সের সাথে সাথে একটি শিশুর আচার আচরণে নানারকম পরিবর্তন আসতে থাকে। সে নিজেই তার শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করে এবং নিজের ভেতর গুটিয়ে যায়। শিশুটি তখন কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, সে কী চায় তা বোঝা মুশকিল। আসলে এরকম একটি অবস্থায় পড়ে শিশু সবসময়ই খুব বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে থাকে এবং অনেক রকম ভুল করে ফেলে। বাবা-বা মাকে তখন কেবল অভিভাবক নয়, বরং বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়াতে হয়। এমন বন্ধু, যাকে শিশুটি সবকিছু মন খুলে বলতে পারবে। যেহেতু এমন সময় ওরা নিজেকে নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে এবং হঠাৎ করেই পরিবারের সঙ্গ তাদের আর ভাল লাগে না, তাই বাবা-মাকে হতে হবে কৌশলী।
১। জানতে চেষ্টা করুন আপনার সন্তানের কী রকম সমস্যা হচ্ছে
অনেক কারণই হতে পারে। এ সময় শিশুরা মাদকাসক্তি, বন্ধুত্ব ও স্বাধীনচেতা জীবনে আগ্রহী হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কোনরকম বাঁধা পেলে শিশুটি হয়ে উঠতে পারে একরোখা এবং জেদি, যার ফলাফল হতে পারে ভয়ানক।
২। নজর রাখুন তার বিভিন্ন পরিবর্তনে
শিশু যদি কোন খারাপ আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তার বিভিন্ন আচরণে সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। খাওয়া-ঘুমে অনিয়ম, রাত জাগা, স্কুলে রেজাল্ট খারাপ করা, খেলাধুলা কমিয়ে দেয়া ইত্যাদি এর কিছু নমুনা।
৩। যোগাযোগ রাখুন তার বন্ধুদের সাথে
এক্ষেত্রে সন্তানের বন্ধুরা আপনাকে সাহায্য করতে পারে। কারণ এ সময়ে তারাই শিশুটির সবচেয়ে কাছের। তাদের কাছ থেকে আপনি জেনে নিতে পারেন আপনার অনুপস্থিতিতে শিশুটির প্রাত্যাহিক চলাফেরা সম্পর্কে।
৪। জানুন তারুণ্যের স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো
এ বয়সে শিশুদের ফ্যাশনের দিকে ঝোঁক বাড়ে। তারা নিজেকে সবসময়ই আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে চায়। বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুর প্রতি আগ্রহ জন্মে। অনেক বেশি মুড সুইং হয়।
৫। মনে রাখুন- এটা বয়ঃসন্ধিকাল
আপনার ছেলেটি কি হঠাৎ করে বড়দের মাঝে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে? মেয়েটি কি প্রায়ই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বাহ্যিক পরিবর্তনগুলো দেখছে? ছেলেটির কি কণ্ঠস্বর পালটে গেছে? তাহলে জেনে রাখুন, এগুলো আপনার সন্তানের অস্বাভাবিকতা নয়, বরং এগুলো বয়ঃসন্ধিকালের খুব স্বাভাবিক কিছু লক্ষণ।
অনেক বাবা-মা এ ধরণের পরিবর্তনগুলো মেনে নিতে পারেন না এবং সন্তানের ইচ্ছের বিরূদ্ধে তাদেরকে স্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য করেন। এতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আপনার সন্তানের কোনো ভুল দেখলে এ সময়ে তাকে খুব কৌশলে ভুলগুলো দেখিয়ে দিন।
কিছু বাবা-মা মনে করেন তার বন্ধু-বান্ধব কিংবা সবার সামনে ভুলগুলো দেখিয়ে দিলে হয়ত জেদবশত তাদের সন্তান ভালো কিছু করবে। কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল। এরকম ব্যবহার পেলে শিশু আরও বেশি একরোখা ও জেদি হয়ে ওঠে এবং কেউ কেউ খুব ভয়ানক পথ বেছে নেয়। অতএব এ সময়ে তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করুন এবং তাকে অনুভব করান যে এ বয়সটিও বিগত সময়গুলোর মতই সুন্দর।
এমন সময় আপনার যা করণীয়
১। সাপোর্ট করুন
সন্তানের পাশে থাকুন। তাকে এই ভরসা দিন যে, যেকোনো বিপদে আপনি তার পাশে আছেন। তার যেকোনো ভাল কাজে উৎসাহ দিন। বোঝান, আপনি তার সাফল্যে অনেক বেশি খুশি। মাঝে মাঝে নিজের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাকে পাশে রাখুন যেন সে আপনার জীবনে নিজের গুরুত্বটা অনুভব করে।
২। অদৃশ্য দেয়াল দিন
শিশুটির যেন কখনই মনে না হয় যে, আপনি তাকে আটকে রাখতে চাইছেন। আপনি তাকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিন। তাকে ভাল এবং খারাপ দিকগুলো দেখান। তার বন্ধু হন। দেখবেন, শিশু নিজে থেকেই আপনার উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে।
৩। শিশুর শিক্ষকের সাথে ভাল যোগাযোগ রাখুন
শিশুটিকে যিনি পড়াচ্ছেন তার সাথে যোগাযোগ রাখুন। দেখুন আপনার শিশুটি ঠিকমত পড়াশুনায় মনোযোগ দিচ্ছে কিনা। শিক্ষকও এক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারেন একজন ভালো পরামর্শদাতা।
৪। ছাড় দিন
আপনার সন্তানকে কিছুটা জায়গা করে দিন যেন সে নিজের মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে পারে। এতে করে সে নিজের উপর বিশ্বাস হারাবে না এবং অন্ধভাবে কারো উপর নির্ভরশীলও হবে না। তার রুম সাজিয়ে দিতে পারেন বিভিন্ন সুন্দর ডেকোরেশনে। তাকে উপহার দিন ডায়েরি। পড়ার টেবিল এবং রুমের দেয়ালে ঝোলানো থাকতে পারে দৈনন্দিন কিছু শিক্ষামূলক কথাবার্তা। এতে করে শিশু উৎসাহ পাবে এবং এ বিষয়গুলো তার উপর কোনো নেতিবাচকপ্রভাবও ফেলবে না।
৫। সন্তানের সাফল্যে খুশি হন
আপনার সন্তানের যেকোনো রকম সাফল্যে খুশি হন। তাকে এটা বুঝিয়ে দিন আপনার বিভিন্ন আচরণে। বিভিন্ন সাফল্যে দিতে পারেন ছোটখাটো কিছু উপহার। সেটা হতে পারে সন্তানের খুব প্রিয় কিছু অথবা এমন কোনো উপহার যা তাকে আরও সৃজনশীল করে তুলবে। যেমন- আপনার সন্তান যদি খুব ভালো আঁকিয়ে হয়, তাহলে তার হাতে তুলে দিতে পারেন সুন্দর রঙ তুলির বাক্স। এতে করে সে আরও আগ্রহী এবং উৎসাহী হয়ে আঁকাআঁকি চালিয়ে যাবে।
৬। দায়িত্ব দিন
আপনি আপনার সন্তানকে ঘরের ছোটখাটো কিছু দায়িত্ব দিতে পারেন। এতে সে নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মনে করবে এবং পরিবারের প্রতি তার আগ্রহ জন্মাবে। সেসব দায়িত্ব হতে পারে আপনাকে কোনো কাজে নিয়মিত সহায়তা করা অথবা গাছে পানি দেয়া বা রুম গুছিয়ে রাখা, হতে পারে আপনাকে রান্নায় সাহায্য করা কিংবা দু-একটা গল্প পড়ে শোনানো।
কিছু কাজ যা নিতান্তই আপনার
১) নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। শিশুর অনেক ব্যবহার আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। এই অবস্থায় রেগে না গিয়ে শান্তভাবে বোঝাতে হবে। নিজের রাগ এবং ধৈর্যের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন।
২) শান্ত হবার জন্য সময় নিন। অনেক সময় এমন কিছু ঘটে যেতে পারে, যা হয়ত কোনমতেই আপনি মেনে নিতে পারছেন না। ঐ সময়েই পরিস্থিতি ঠিক করার চেষ্টা না করে বরং একটু একা হন। নিজেকে শান্ত করুন।
৩) ইতিবাচক মনোভাব রাখুন। এতে করে সন্তানের বিভিন্ন সমস্যা আপনি খুব সহজেই সমাধান করতে পারবেন। নতুবা আপনি নিজেই বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন, যা আপনাদের কারোর জন্যই সুফল বয়ে আনবে না।
৪) প্রাণ খুলে হাসুন এবং কথা বলুন। মনে রাখবেন, আপনার অজান্তে শিশুটি হয়ত আপনাকেই অনুসরণ করছে। তাই আপনার সুন্দর আচরণই শিশুর ভবিষ্যতের ভিত্তি।
বাবা-মা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক একটি নিয়ম। পাশাপাশি এটি সৃষ্টিকর্তার একটি আশীর্বাদও বটে। কিন্তু শুধুমাত্র ভালো অভিভাবক না হতে পারার দরুন অনেক বাবা-মা অকালে তাদের সন্তানকে হারাচ্ছেন। কোনো সন্তান বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, কেউবা নিজের বাসায় থাকার চেয়ে হোস্টেলে থাকা বেশি নিরাপদ মনে করছে। এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনা আমরা রোজই পত্রিকায় দেখতে পাই।
সন্তান গর্ভে আসার সময় থেকেই ভবিষ্যৎ বাবা-মাকে মনে মনে প্রস্তুত হওয়া উচিৎ। অনাগত সন্তানকে সুন্দর পরিবেশ দিতে বদ্ধ পরিকর হওয়া উচিৎ। তবেই শিশুটি বেড়ে উঠবে আদর্শে, তার মুখের প্রথম হাসিটি থাকবে অমলিন। আসুন, আদর্শ সন্তান গড়ে তোলার আগে নিজেকে আদর্শ অভিভাবক হিসেবে গড়ে তুলি।