উদ্যোক্তা মানেই নতুন নতুন আইডিয়া আর উদ্যমী এক মানুষ। মাথায় নতুন আইডিয়া আসামাত্রই তা বাস্তবে পরিণত করতে বদ্ধ পরিকর এক মানুষ। তবে বেশি বেশি আইডিয়া মাথায় আসা এবং তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়াকে মনোবিজ্ঞানীরা একটি নাম দিয়েছেন- শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম (Shiny Object Syndrome)। এটি এক ধরণের মানসিক রোগ। এই সিনড্রোমটির জন্য অনেক নব্য প্রতিভাবান উদ্যোক্তাই সফলতার মুখ দেখতে পান না। মাথায় অনেক আইডিয়ার বসত এমন অনেক প্রতিভাই এর জন্য ঝরে পড়ে। বিশেষত আমাদের দেশে এই সমস্যাটি বেশি প্রকট। বিষয়টি একটু খোলাসা করেই বলা যাক।
ধরুন, আপনি একটি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। হঠাৎ দেখলেন অদূরেই একটি জিনিস চকচক করছে। খুব স্বাভাবিক কৌতূহল বশে জিনিসটা কী দেখার জন্য কয়েক কদম এগিয়ে যাবেন। হয়তো আপনি ভাবছেন দামী কিছুই হবে মনে হয়। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলেন সেটি একটা কাঁচের ভাঙ্গা টুকরা। অতি আইডিয়াপ্রবণ উদ্যোক্তারাও তাদের সব আইডিয়ার একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পান। ফলে অতি উত্তেজনার বশে বিশেষ চিন্তা-ভাবনা বাদেই কাজে লেগে পড়েন। কিছু দূর এগোনোর পর বুঝতে পারেন কল্পনা আর বাস্তবতার ফারাক। আবার নতুন কোনো আইডিয়া মাথায় আসে এবং পুনরায় একই কাজ করেন। এতে করে অনেক উদ্যোক্তাই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে পারেন না। এই যে অতি উত্তেজনা এবং ক্ষণে ক্ষণে কাজের ধারা বদলানো একেই শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম বলা হয়।
মনোবিজ্ঞানী স্যাবিন কেস্টনারের মতে, যাদের মস্তিষ্ক খুব বেশি উদ্দীপ্ত (Stimuli) থাকে অথবা বেশি উত্তেজিত থাকে, তারা একটি নির্দিষ্ট বিষয় ধৈর্য ধরে এবং মনোযোগ দিয়ে করতে পারেন না, যার ফলে এই সিনড্রোমটি দেখা দেয়। এখন দেখা যাক শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের ফলে আপনি কী কী ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
অসমাপ্ত কাজ
ধরুন, আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। আপনার প্রতিষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই রয়েছে। ইংরেজিতে মিশন এবং ভিশন যাকে বলে। সেই লক্ষ্যে এগোতে গিয়ে আপনার মাথায় দারুণ সব আইডিয়া এলো। আইডিয়াগুলো যতক্ষণ না প্রয়োগ করতে পারছেন, ততক্ষণ আপনার শান্তি নেই। তাই নতুন আইডিয়া পাবার উত্তেজনায় এবং তার উজ্জ্বল একটি ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় আপনি বিশেষ চিন্তা-ভাবনা না করেই আইডিয়াটি বাস্তবে কাজে লাগাতে বসে গেলেন। এতে আপনার আগের কাজটি যেমন অসমাপ্ত রয়ে গেল, তেমনি নতুন কাজটিও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক না হওয়ায় ভেস্তে গেল। আপনিও হতাশ হয়ে পড়বেন।
সুপরিকল্পিত উদ্যোগের অভাব
কোনো একটি আইডিয়াকে বাস্তবে পরিণত করতে গেলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হয়। পরিকল্পনার পাশাপাশি খুব ঠান্ডা মাথায় সে বিষয়টির বর্তমান প্রেক্ষাপট চিন্তা করতে হয়। আর শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমে আক্রান্ত মস্তিষ্ক কখনোই ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারে না। তাই একজন উদ্যোক্তা অতি উত্তেজনায় মোটামুটি দাঁড় করানো একটি প্ল্যানের উপর ভিত্তি করে কাজ শুরু করে দেন।
অর্থ সংকট
আইডিয়াকে বাস্তব করতে যেমন শ্রম দিতে হয় তেমন অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। নতুন নতুন আইডিয়া মানেই নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম। আর সেই নতুন প্ল্যাটফর্মে আপনাকে পূর্বের মতোই অর্থ খরচ বা বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগ তখনই বৃথা যাবে যখন আপনার আইডিয়ার ট্রেনটি কিছু দূর গিয়ে থেমে যাবে।
কর্মচারীদের মাঝে বিভ্রান্তি
আপনার কোম্পানির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো আপনার কর্মচারীরা। কোম্পানির যেকোনো সাফল্যের মূলে রয়েছে তাদের সহৃদয় চেষ্টা এবং ভালবাসা। আপনার নতুন নতুন আইডিয়া এবং খুব দ্রুত ব্যবসার মোড় পরিবর্তন তাদেরকে খুবই অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। তাদের সেগুলো বুঝে উঠতে যেমন দেরি হয়, তেমনি কাজে লাগাতেও বেশ সময় লাগে। ততদিনে দেখা গেল আপনি আরো নতুন নতুন আইডিয়া বের করলেন। এতে করে আপনার আইডিয়ার জ্বালায় কর্মচারীরা যেমন অতিষ্ঠ হয়ে যাবেন, তেমনি হতাশও হয়ে পড়বেন।
চলুন এখন জেনে নিই শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম থেকে বের হয়ে আসার উপায়গুলো।
আইডিয়ার জন্য আলাদা সময় রাখুন
শত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবার আর নিজের জন্য আপনি যেমন সময় বের করেন, তেমনি আইডিয়াগুলোকে নিয়ে ভাবার জন্য আলাদা একটা সময় বের করুন। হতে পারে সেটা শুক্রবার রাতের খাবারের পর। আর সাথে একটি নোটবুক বা ডায়েরি রাখতে পারেন যাতে হাঁটতে-চলতে মাথায় আসা আইডিয়াগুলো লিখে রাখতে পারেন। পরে অবসরে সেসব নিয়ে বিস্তারিত চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন কোনটা কাজে লাগানো যায়। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে আপনি চাইলে গুগলের সাহায্যও নিতে পারেন।
একজন ড্রিমকিলার রাখুন
ড্রিমকিলার হলেন ফিল্টারের মতো, যিনি আপনার মস্তিষ্কপ্রসূত কিছু অনাবশ্যক আইডিয়াকে এক নিমিষেই বাতিল করে দিতে পারেন। ড্রিম কিলার হতে পারে আপনার জীবনসঙ্গী কিংবা কাছের কোনো ভালো বন্ধু। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন। ড্রিমকিলার যদি হয় আপনারই প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে তো কথাই নেই। সে আপনার অসাধারণ কোনো আইডিয়াকে খুব সহজেই গলা টিপে হত্যা করতে পারে।
সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করুন
ডায়েরীতে টুকে রাখা আইডিয়াগুলো নিয়ে বন্ধুদের সাথে কিংবা সহকর্মী বা দলের অন্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করুন। ছুটির দিনে বিকেলবেলা কিংবা অবসরে চা পান করতে করতে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করুন। এতে সবার মতামত জানতে পারবেন, আবার আইডিয়াটিকে আরো সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে পারবেন। আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করলে দেখবেন বন্ধুদের সাথে কিংবা সহকর্মীদের সাথে আপনার সম্পর্ক আরো গভীর হচ্ছে। দেখা গেল তাদের কোনো পরিচিত মানুষ রয়েছে যে আপনাকে আপনার আইডিয়া বাস্তবে পরিণত করতে সাহায্য করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা এটা জেনে খুশি হবে যে আপনি তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ভয়কে জয় করুন
শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমে আক্রান্ত উদ্যোক্তাগণ সবসময় তাদের আইডিয়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পান। আর সেই উজ্জলতার চমকে মাঝের উত্থান-পতন কিংবা কাঁটাময় পথটাও দেখতে পান না। ফলে যা হবার তাই হয়। মাঝ পথে গিয়ে চারপাশে অন্ধকার দেখেন এবং হতাশ হয়ে পড়েন কিংবা ভয় পান। কী করবেন ভেবে না পেয়ে অগত্যা কাজটা অসম্পূর্ণ রেখে দেন। আবার কখনো কখনো দেখা যায়, সব কিছু প্ল্যানমাফিক করছেন, কিন্তু যতই সামনে আগাচ্ছেন ততই দেখতে পাচ্ছেন আরো নতুন নতুন আইডিয়া আপনার সম্পূর্ণ পরিকল্পনাকে আমূলে বদলে দিচ্ছে কিংবা আপনাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করছে। কোনো অবস্থাতেই সেসব চকচকে মোহময় সম্ভাবনার দিকে এগোবেন না। মনে রাখবেন ‘চকচক করলেই সোনা হয় না’।
যা-ই করুন, শেষ করুন
এ কথাটি শুধু উদ্যোক্তা নন, সকলের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের মাঝে ধৈর্যের খুব অভাব। যেমন- আপনাকে ডাক্তার ১২ দিনের একটি অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স দিল। দেখা গেল দু’দিনের মাথায় আপনি একদম সুস্থ হয়ে গেলেন। তাই অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সটি শেষ করলেন না। আবার দেখা গেল, আপনাকে টানা ৭/৮/১২ সপ্তাহ ব্যায়াম করতে বলা হলো। আপনি ৩-৪ দিন যথাযথ উদ্দীপনা আর উদ্যমের সাথে ব্যায়াম করে তারপর ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন এবং পুরো কাজটা শেষ করলেন না। এতে লাভের লাভ কিছুই তো হলোই না, বরং মাঝ থেকে পুরো সময়টা নষ্ট হলো। বরং নিজেকে একটু স্থির করুন। ধীরে ধীরে হলেও কোনো কাজ সম্পূর্ণ করুন।
আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনাই হারিয়ে যায় সঠিক পরিচর্যা এবং দিক নির্দেশনার অভাবে। যারা সব কিছুকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের মাঝেও যেন শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম দেখা না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। তাহলেই হয়তো আপনার স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে ধরা দিতে শুরু করবে।
ফিচার ইমেজঃ tes.com