Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জীবনযুদ্ধে জয়ী দুঃসাহসী এক নারী অভিযাত্রিকের গল্প

জীবন সংগ্রামে প্রতিকূলতা আসবেই। কখনো কখনো তা আপনার স্থিতিশীলতাকে নাড়িয়ে দেবে, এমনকি ফেলেও দিতে পারে। কিন্তু নেতিবাচকতার উদ্দেশ্যে ক্রুর হাসি হেসে সদর্পে শিরদাঁড়া সোজা রেখে আবার উঠে দাঁড়াতে পারবেন? নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে হা-হুতাশ না করে নতুন উদ্যমে এগোতে পারবেন? সব বাধা ডিঙিয়ে জীবন সায়াহ্নে তৃপ্তির হাসি নিয়ে মরবার মতো কিছু স্মৃতি তৈরি করতে পারবেন? অবশ্যই পারবেন। যদি ফিবি পারেন, আপনি কেন পারবেন না? তবে ফিবির কথাই বা আলাদা করে বলছি কেন, তাই জানবেন এই লেখায়।

ফিবির শুরুর ভাঙনের গল্প

ফিবি হাওলেট; যুক্তরাজ্যের এক প্রাণচঞ্চল তরুণী। পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন, জাতীয় মেধাতালিকায় নামও লিখিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে পড়তে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়, ২০১২ সালের ঘটনা। গিয়েই অল্প দিনের মাথায় ডেঙ্গুর শিকার হয়ে কঙ্কালসার হয়ে ফিরলেন ব্রিটেনে। মালয়েশিয়ায় একটি খণ্ডকালীন চাকরি করতেন তিনি। অসুস্থতার কারণে চাকরিক্ষেত্রে বিনা জবাবদিহিতে অনুপস্থিতির সাথে জমে গিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় কোর্সের একগাদা রিটেক। শরীর সায় না দিলেও তিনি ফিরে গেলেন মালয়েশিয়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে বিষন্নতা পেয়ে বসলো তাকে। আসন্ন রোগের অজানা সব আলামত আর বিষন্নতার দাওয়াই হিসেবে তার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেলো ঘুমের বড়ি। কয়েক কাপ কফি ছাড়া মাথা তুলে দাঁড়াতে যেন পারতেন না। জড়িয়ে গেলেন নেশার সাথেও।

Source: planetd.com

গ্র্যাজুয়েশন শেষে ২০১৪ সালের অক্টোবরে চাকরি নেন লন্ডনের এক ইনভেস্টমেন্ট ফার্মে। সেখানেও ঠিক যেন কুলোতে পারছিলেন না ফিবি। শরীর ভেঙে পড়ছিলো, অজানা কারণে কাঁপতে থাকতো হাত, মাথায় ছিলো অসহ্য যন্ত্রণা, আর হৃদযন্ত্রে অস্বাভাবিক স্পন্দন। মক্কেলদের সাথে ফোন তুলে কথা বলতেই দম বের হবার যোগাড় হতো। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এসে অনেকদিনের সম্পর্কটাও বাজেভাবে ভেঙে যায়। ধরা পড়ে মায়ের ক্যান্সার, ওদিকে তার মাথায় কোম্পানির ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সেলস টার্গেটের বোঝা! চূড়ান্ত ভঙ্গুর মানুষটির জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত মোড় আসে এরপরেই। ২০১৪ সালে একদিন হুট করেই সেন্ট্রাল লন্ডনের পাতাল স্টেশনে মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি।

ভাঙনের কফিনে চূড়ান্ত পেরেক

ছয় মাস পর মে মাসে তার দুইটি বিশেষ রোগ ধরা পড়লো। একটি পোস্টিউরাল ট্যাকাইকার্ডিয়া সিনড্রোম (PoTS); অনৈচ্ছিক স্নায়ুসমূহের কার্যকরী অস্বাভাবিকতা। হৃদস্পন্দনও তাতে বেড়ে গিয়েছিলো অস্বাভাবিক রকম, বিশেষ করে দাঁড়াতে গেলেই তা বাঁধ ভাঙতো। অপর রোগটির নাম মায়ালজিক এনসেফালোমাইলিটিস (M.E), দীর্ঘস্থায়ী এ স্নায়বিক দুর্বিপাকে স্নায়ু ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভেবেছিলেন ব্যথাগুলো কোনোরকম সয়ে যেতে পারবেন, কেবল ভবিষ্যতে রোগটা সেরে গেলেই হয়। আশার প্রদীপটাও দপ করে নিভে গেলো, যখন জানলেন এই রোগদ্বয় আসলে সারবার নয়। তাকে রোগ সারাবার চিকিৎসার বদলে রোগের সাথে মানিয়ে স্থিতিশীল থাকার থেরাপি দেওয়ার প্রস্তাব করলেন ডাক্তাররা। এর মাঝেই তার বুকে, সাইনাসে, চোখে ও মূত্রথলিতে ঘা দেখা দেয়।

আচমকা এক উপলব্ধি পাল্টে দিলো গল্পের মোড়

এতসব জটিলতার মাঝে প্রায় বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়া ফিবি হঠাতই উপলব্ধি করলেন যে, M.E  রোগটির কারণেই হয়তো, তিনি আর তেমন একটা ব্যথা অনুভব করছেন না। চিন্তার মোড় ঘুরে গেলো তখনই। চরম ইতিবাচকতায় তার মাথায় তখন খেলতে লাগলো এই জীবনে তিনি কী কী করেননি, কিন্তু করতে চান; কোথায় যাননি, কিন্তু যেতে চান! ভাবলেন যথেষ্ট হয়েছে, আর না!

Source: thechanceofchooice.com

ব্যস, বেরিয়ে পড়লেন ফিবি। প্রথমেই সাড়ে আটটায় অফিস গেলেন। নয়টা নাগাদ চাকরি থেকে অব্যাহতি ও কিছু টাকাপয়সা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ফিরে গেলেন নিজের গ্রামে, বাবা-মায়ের কাছে। রবিনহুডের এলাকাখ্যাত শেরউড বনের ছায়াঘেরা পরিবেশে আর দরিদ্র মা-বাবার সংসারে তিনি শিখছিলেন কীভাবে জীবন সংগ্রামে লড়াই করতে হয়, মনকে শান্ত রাখতে হয়। তখন থেকেই পরিমিত খাদ্যাভ্যাস আর ধ্যান, যোগ ব্যায়ামে অভ্যস্ত হলেন ফিবি। সেই সাথে চিকিৎসকদের পরামর্শমতো চলতে লাগলো বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি গ্রহণ, ম্যাসাজ ও চাইনিজ ভেষজ সেবন। তার এই দিনগুলোর সমস্ত বিবরণ ও প্রাত্যহিক কার্যতালিকা তিনি তার ওয়েবসাইটে রেখেছেন, যাতে সেখান থেকে ধারণা ও অনুপ্রেরণা নিতে পারেন অন্যরা। ডাক্তাররা বলেছিলেন তিনি নাকি আর কোনোদিনই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না, ‘আরোগ্যবিহীন’ অদৃশ্য-অজানা ব্যধি থেকে অদৃষ্টের নাটকীয়তার সাথে চরম ইতিবাচকতা ও যাপিত জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে এভাবে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকলেন ফিবি।

অবশেষে সুস্থতা ও নতুন আরেক উপলব্ধি

ভ্রমণের ইচ্ছা এই বেপরোয়া মেয়েটির সবসময়েই ছিলো। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন দু’বছর চাকরির পর ভ্রমণ নিয়ে ভাবতে। কিন্তু অসুস্থ হবার পর ভ্রমণের সুযোগ যখন নিজ চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখছিলেন, তখনই তিনি জীবনে প্রায়োরিটাইজেশন বা অগ্রাধিকার দেবার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেন। ভালোমতোই চিনলেন নিজের অগ্রাধিকার কী হওয়া চাই- ভ্রমণ!

Source: instagram.com

আশির দশকে বাবা-মায়ের কাছে ছোট্ট ফিবি আটলান্টিকের ৪০ ফুট উঁচু ঢেউয়ের গল্প শুনতো, কঙ্গোর উপজাতিরা প্রথম ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গ দেখে তাকে কীভাবে ‘শুভ্র দেবদূত’ ভেবেছিলো, তা শুনতেন। শুনতেন ইন্দোনেশিয়ার গহীন রেইনফরেস্টের গুপ্তধনের গল্প। তখন থেকেই অন্যদের দেখাদেখি জীবনের ক্লিশে ইঁদুর দৌড়ে না ছুটে ভ্রমণকে বেছে নিতে চেয়েছিলেন কর্পোরেট জগতের প্রতি বিতৃষিত ফিবি। অসুস্থতার বিরুদ্ধে নিঃসঙ্গ এক লড়াই শেষে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে তার ডাক্তার তাকে জানান, তিনি সুস্থ! ব্যস, অদম্য ফিবিকে পায় কে তখন? এবার ঠিকই জীবনের দেওয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অগ্রাধিকার বেছে নিতে ভুল করলেন না ফিবি। বেরিয়ে পড়লেন, তবে সংগঠিত উপায়েই, একটি মহতী উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়েই।

স্কুবা ডাইভিং; Source: instagram.com

অনুপ্রেরণার নাম ফিবি

সুস্থ হয়েই ফিবি খুললেন নিজের ওয়েবসাইট। সেখানে অনুদান সংগ্রহ করছেন এমন ‘ইনিভিজিবল’/’ক্রনিক্যাল ইলনেস’-এর সাথে লড়াই করাদের সাহায্যের জন্য, এ সম্পর্কে সচেতনতা বিস্তারে তরুণদের নিয়ে কমিউনিটি তৈরির জন্য। এ ধরনের অসুস্থতায় রোগীদের ৩০ ভাগই মানসিক সমস্যায় ভোগেন, ফিবিও ভুগেছেন। তাদের জন্য বিপুল অনুপ্রেরণার আধার হিসেবে কাজ করছে তার ওয়েবসাইটের প্রতিটি শব্দ। জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, স্বাস্থ্য বটিকার সাথে নিজের ভ্রমণের রোজনামচা ও ভ্রমণবিষয়ক পরামর্শ প্রদানের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তিনি সাজিয়েছেন নিজের ওয়েবসাইট। সেই সঙ্গে ভ্রমণের আকর্ষণীয় সব অভিজ্ঞতা বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীসহ বিশ্ববাসীর সাথে তিনি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইউটিউব চ্যানেলে ভাগ করে নেন।

কলম্বিয়ার গুয়াতাপে-তে; Source: planetd.com

এই মানুষটির অনেক দূর যাবার স্বপ্ন। ইতোমধ্যে প্রথম তালিকাভুক্ত নারী হিসেবে বিশ্বের সব কয়টি দেশ ভ্রমণের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের ২৭ বছর বয়সী তন্বী-তরুণী ক্যাসেন্ড্রো ডি পিকুল, ১৮ মাসে ১৯৬টি দেশ ঘুরে ফেলেছেন তিনি। আর আমাদের গল্পের নায়িকা ফিবি চান ক্যাসেন্ড্রোর পর দ্বিতীয় ও ‘ক্রনিক্যাল ইলনেস’ এর মেডিকেল ইতিহাস সম্পন্ন নারীদের মধ্যে প্রথম হিসেবে বিশ্বের সবকয়টি দেশে পা রাখতে। শুধু দেশ আবিষ্কার বা ঘোরার নেশাকে উপশম দেওয়াই নয়, তিনি চান দেশে দেশে ফিবির এই ফিনিক্সতুল্য পুনর্জীবনের গল্পকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। টাকা জমিয়ে, আমন্ত্রণে বা অনুদানে সম্পূর্ণ একা এই মেয়েটিই বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, ঘুরছেন অসংখ্য দেশ।

পেরুর ইকায়, যেখানে মিশেছে মরু আর সমুদ্র; Source: instagram.com

নিকারাগুয়ার শৈলচূড়া থেকে শৈলধারা দর্শন; Source: instagram.com

একাকী সমুদ্রবিলাস; Source: instagram.com

কতটা মনের জোর থাকলে চরম ভঙ্গুর এক দশা থেকে এভাবে একটি মানুষ এমন সটান দাঁড়িয়ে পড়তে পারে, প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রঙিন চশমা চোখে নিয়ে নতুন গন্তব্যে ব্যাকপ্যাক কাঁধে ছুটে যেতে পারে? এই মানুষটির একটি বার্তা আছে সকলের জন্য-

আমরা যারা সুস্থ-স্বাভাবিক আছি, আমরা ভাগ্যবান, আমাদের হাতে ‘চয়েজ’ আছে। আজই বেরিয়ে পড়ুন, আর যে কাজটা মন থেকে করতে ভালোবাসেন, তা-ই করুন, কারণ সেই ‘চয়েজ’ ব্যবহারের সুযোগটা হয়তো কাল না-ও থাকতে পারে।

সত্যিই তো। অন্তরে কান পাতুন, শুনুন তার কথা এবং অন্যদের অনুকরণ না করে তা-ই করুন, যা করতে ভালোবাসেন। ফিবি পেরেছেন। আপনি কেন পারবেন না?

ফিচার ইমেজ: Newark Advertiser

Related Articles