মিকদাদ ভার্সি একজন ব্রিটিশ সংবাদ-সমালোচক। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও সংবাদ প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানের প্রচারিত সংবাদের সত্যতা নিয়ে তিনি বহুবার প্রশ্ন তুলেছেন। সংবাদে উল্লেখিত বিভিন্ন শব্দের যথাযথ ব্যবহার নিয়েও তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন। মিকদাদ ভার্সি সাংবাদিক বা সাংবাদিকতার ছাত্র না হয়েও বিভিন্ন সময়ে আপত্তি ও অভিযোগ তুলেছেন সংবাদ প্রচারের নীতি ও নৈতিকতা নিয়ে। এমনকি তার যুক্তিসঙ্গত দাবি ও অভিযোগের তোপে প্রভাবশালী সংবাদ সংস্থাগুলো তাদের প্রচারিত ভুল সংবাদগুলো সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি মূলত ‘মুসলিম’ ও ‘ইসলাম’ এই দুটি কিওয়ার্ড নিয়ে কাজ করেন। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত সংবাদগুলোর দিকে তিনি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখেন। ‘মুসলিম’ ও ‘ইসলাম’ নিয়ে কোনো সংবাদ প্রচার হলেই তিনি সেটিকে যাচাই বাছাই করা শুরু করেন। সংবাদ প্রকাশে অসততা এবং শব্দ ব্যবহারেে অসঙ্গতি লক্ষ্য করলেই তিনি অভিযোগ ঠুকে দেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, সংবাদপত্রে তথ্যের সত্যতা নিয়ে কেউ অভিযোগ করে না। তাই তিনিই এর প্রচলন শুরু করলেন।
যেভাবে শুরু
২০১৬ সালে ‘দ্য সানডে টাইমস’ পত্রিকা যুক্তরাজ্যের নাগরিক বিষয়ক একটি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রতিবেদন করেছিল। প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয় ‘যুক্তরাজ্যের ৭৫% মুসলিম নাগরিক যুক্তরাজ্যকে মুসলিমদের ছিটমহল মনে করে’। প্রতিবেদনটির বিভ্রান্তিকর তথ্যের জন্য অভিযোগ দায়ের করেন মিকদাদ ভার্সি। তার প্রতিবাদে পত্রিকাটি তাদের সংবাদ সংশোধন করতে বাধ্য হয়। পত্রিকাটি স্বীকার করে নেয় তাদের ভুল হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল এশিয়ান ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলের একটি জরিপ, যার ছাত্ররা মনে করে ব্রিটেনের জনসংখ্যার ৫০-৯০% জনই এশিয়ান। পত্রিকাটি এরকমভাবে তথ্যের বিভ্রান্তি দ্বারা মুসলিমদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিল। এ ঘটনার পর থেকেই মিকদাদ চলা শুরু করেন তার নতুন আন্দোলনের পথে। এবং এভাবে তিনি বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টিগোচরে আসেন।
শুধুমাত্র ২০১৬ সালের ডিসেম্বরেই যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা তার করা আপত্তির ভিত্তিতে আটটির বেশি সংবাদ সংশোধন করতে বাধ্য হয়। ২০১৬ সালে ‘মেইল অনলাইন’ ওয়েবসাইটে এক নারীর হত্যাকাণ্ডকে ‘ইসলামিক অনার কিলিং’ (সম্মান বাঁচাতে পরিবারের সদস্যকে হত্যা করা) বলে প্রচার করা হয়। মিকদাদ তখন অভিযোগ আনেন। তিনি প্রমাণ করেন ‘অনার কিলিং’ নামের কোনো টার্ম ইসলাম ধর্মে নেই। ইসলাম ধর্ম এমন হত্যা সমর্থন করে না। পরে ‘মেইল অনলাইন’ সংবাদ থেকে ‘ইসলামিক’ শব্দটি তুলে নিয়ে সংশোধন করে নেয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে।
সে বছর ডিসেম্বরে ‘দ্য সান’ পত্রিকাটি দুজন মুসলিম কৃষ্ণাঙ্গের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার করে। দুজনের মধ্যে একজন চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং আরেকজন চরমপন্থী হিসাবে অভিযুক্ত। অথচ ‘দ্য সান’ দুই ব্যক্তিকে এক করে ফেলে। যিনি চরমপন্থার ঘোর বিরোধী তাকে চরমপন্থী হিসাবে উল্লেখ করে খবর প্রচার করা হয়। মিকদাদ এই বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ ঠুকে দিলে ‘দ্য সান’ ক্ষমা প্রার্থনা করে সংবাদটি সংশোধন করে নেয়।
গত বছরের জানুয়ারিতে ‘মেইল অনলাইন’ একটি স্প্যানিশ সুপার মার্কেটে হামলার খবর প্রকাশ করে। ওই খবরের শিরোনামে দাবি করা হয়, বন্দুকধারী ব্যক্তিটি আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার করেছিল। মিকদাদ বিষয়টি অনুসন্ধানে স্থানীয় পুলিশ ও সুপার মার্কেটের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে কারও চিৎকার করার দাবি সত্য নয়। শেষ পর্যন্ত দ্য সানকে ওই খবর থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দদ্বয় তুলে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়।
গত বছর ২২ শে সেপ্টেম্বর ‘মেইল অনলাইন’ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। ইয়াহিয়া ফারুক নামের এক ব্যক্তিকে ‘টিউব বোম্বার’ বলে আখ্যায়িত করে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় নিবন্ধনটিতে। যদিও ব্যক্তিটি কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ছিলেন না। মিকদাদ ভার্সি এই মিথ্যা অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে ব্যক্তিটি অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি পেয়ে যান। একইসাথে পত্রিকাটি তাদের ভুল স্বীকার করে নেয়।
২০১৬ সালে ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকাটি ভোটার জালিয়াতি বিষয়ক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধনটিতে জাল ভোটারদের নথিভুক্তি বন্ধ করার জন্য মুসলমানদের ব্যাপারে সরকারকে সচেতন থাকতে বলা হয়। সেখানে ‘মুসলিম’ শব্দটি ‘জালিয়াতের’ শব্দটির পাশাপাশি বসিয়ে মুসলিমদের সম্পর্কে নেতিবাচকতার আবহ সৃষ্টি করা হয়, এবং তাতে তথ্যগত ভুলও ছিল। জাল ভোটারের সাথে মুসলিমদের আদতে কোনোই সম্পর্ক ছিলো না। মিকদাদ ভার্সি এই সংবাদ প্রচার নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলে ‘এক্সপ্রেস’ তাদের ভুল স্বীকার করে এবং শিরোনামটি পরিবর্তন করে দেয়।
ফিনসবারি পার্কের সন্ত্রাসী হামলার পর, ‘মেইল অনলাইন’ পত্রিকাটি ‘ফিনসবারি পার্ক মসজিদের’ ইমামকে সে হামলার জন্য দায়ী করে খবর প্রচার করে। মসজিদটি ছিলো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার স্থান থেকে দুই মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। অভিযুক্ত ইমাম সে এলাকা থেকে দশ বছর আগেই অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। মিকদাদ ভার্সি এই খবর সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে ‘মেইল অনলাইন’ পত্রিকাটি তাদের শিরোনাম সংশোধন করে এবং তাদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
গত বছর মে মাসে যখন বিবিসি সৌদি আরবে ট্রাম্পের সফর নিয়ে রিপোর্ট করছিল, তখন তারা ‘ইসলামিস্ট’ এবং ‘ইসলামিক’ শব্দগুলোর সংজ্ঞা প্রকাশ করেছিল। বিবিসির সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ইসলামিক’ শব্দটি ব্যবহার করা হবে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত সবকিছুকে বোঝাতে। আর ‘ইসলামিস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করা হবে মুসলিমদের ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ বুঝাতে। মিকদাদ এই সংজ্ঞায়নকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীতে বিবিসি তাদের এরকম অযাচিত সংজ্ঞায়ন থেকে সরে এসে সংশোধন করে নিয়েছে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি মিকদাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিবিসি তাদের আরো একটি ভুল সংশোধন করে নিয়েছে।বিবিসি নারীর নম্রতাকে ইসলামের মূল স্তম্ভ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল। মিকদাদ ভার্সির অভিযোগের ফলে তারা সেটাকে পরিবর্তন করে দেয়।
গত দু’বছর ধরে মিকদাদ ভার্সি এমন বিভিন্ন অভিযোগ এনেছেন ‘দ্য সান’, ‘এক্সপ্রেস’ ‘মেইল অনলাইন’ ‘বিবিসি’ ইত্যাদি সংবাদ মাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে। তাদের প্রচারিত সংবাদ, সংবাদে ব্যবহৃত অসঙ্গত শব্দ, তথ্যের অসত্যতা নিয়ে মিকদাদের আরোপিত অভিযোগগুলোর কিছু কিছু স্বীকার করে নিয়েছে সংবাদ মাধ্যমগুলো। এবং তার সিংহভাগ অভিযোগ এখনও রয়েছে প্রক্রিয়াধীন অবস্থায়।
তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন,
“বিশ্বময় ইসলাম এবং মুসলিম নিয়ে অহরহই সংবাদ হচ্ছে। যার অনেক সংবাদ আগাগোড়া ভুলে ভরা, অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর। এই সংবাদগুলো ছড়িয়ে গেলে মুসলিম সংবাদমাধ্যমগুলোও তা নিয়েই মেতে থাকে। বলার মতো কেউ নেই যে সংবাদগুলো সত্য নয়। এবং এগুলো সংশোধন করার আপত্তি কেউ তুলে না। তাই এই কাজটি যেন আমিই শুরু করলাম।“।
তিনি আরো বলেন, “বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থাপিত সম্পর্কগুলোকে আরও উন্নত করতে চাই।” ভুল সংবাদ প্রচারের খারাপ ফলাফলের ভয়াবহতার কথা ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “ভুল খবর একবার প্রচারিত হয়ে গেলে তা মানুষ ব্যাপকভাবে জানতে পারে, কিন্তু পরে সংশোধন হলে সেই পরিমাণ মানুষ সংশোধিত খবরটি আর জানতে পারে না।” তার মতে, “মুসলিমদের এমন অনেক ভুল রয়েছে যা নিয়ে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু তাই বলে মুসলিমদের নিয়ে অথবা অন্য যেকোনো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে যাচ্ছেতাই খবর প্রচার করা নীতিবহির্ভূত এবং অপরাধ। এ ধরনের সাংবাদিকতার ব্যাপারে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।”
তাকে নিয়ে তৈরি বিবিসির ডকুমেন্টারিটি দেখুন এখানে।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
মিকদাদ ভার্সি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের স্নাতক। কর্মজীবনে তিনি ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসাবে কাজ করছেন। তিনি বিষয়-সম্পত্তি, ভ্রমণ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি বর্তমানে একটি ভ্রমণ কোম্পানির আর্থিক পরিচালক। একই সাথে লন্ডনের মুসলিম কাউন্সিলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে কর্মরত আছেন। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এর উপসম্পাকীয় বিভাগে এবং ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ এ তিনি নিয়মিত লিখে থাকেন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক কিছু যোগাযোগ মাধ্যম দেশটিতে ইসলামের ব্যাপারে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, যা সেখান থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বব্যাপী। এমনটাই মনে করছে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’সহ সেখানকার মূলধারার যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। তথ্যসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করায় তারা মিকদাদ ভার্সিকে সাধুবাদ জানিয়েছে।
Featured image credit: CNN