বর্তমানে যে বিষয়টি নিয়ে তরুণদের মাঝে অনেক আলোচনা হচ্ছে, তা হলো উদ্যোগ বা স্টার্টআপ। এখানে রয়েছে একটি নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি, আইডিয়া ও পণ্যের সমন্বয়, আছে প্রচুর শ্রম-মেধা, সময় এবং সর্বোপরি একটি প্রাথমিক ঝুঁকির আশঙ্কা। মূলত স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান শুরু করার অন্যতম সময় হলো পড়াশোনা শেষের কিংবা পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মাঝখানের সময়টি। অনেক সফল স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান আছে যাদের উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরুনোর আগেই একটি অবস্থান তৈরি করে ফেলে। তবে এক্ষেত্রে ত্যাগ-তিতিক্ষা তো অবশ্যই লাগবে। আপনার মূলধন ঠিক কতটুকু, আপনার সিজিপিএর হাল হাকিকত কী, বাসায় আপনার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব আছে কিনা- এমন সবকিছুই একটি নতুন উদ্যোগ সফল হবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দেখুন, এই মাইক্রোসফট, ফেসবুক, গুগল এসব কোম্পানিগুলো কিন্তু ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাট পেরুনো এবং না পেরুনো তরুণদের উদ্যোগেরই ফসল। আমাদের দেশেও এমন অসংখ্য উদ্যোক্তা আছে এবং তৈরি হচ্ছে যারা নিজের ভাগ্যের সাথে সাথে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বদলানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, স্টার্টআপ বিষয়টি বর্তমান সময়ে আমাদের চাকরির বাজারের সাথে তুলনা করলে ধোপে টিকে না। সেক্ষেত্রে বর্তমান দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, স্টার্টআপ ব্যাপারটি একটু পিছিয়ে যায়, যদিও আমাদের দেশের উন্নতির জন্য স্টার্টআপের বিকল্প কিছু নেই। সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরির চোখ ধাঁধানো লাইফস্টাইল বা নতুন কিছু শুরু করার সিদ্ধান্তহীনতাই স্টার্টআপের বিষয়টিকে অনেকাংশে মানসিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বস্তুত আমাদের একেকজনের চাহিদা কিংবা অবস্থা একেক রকম। হয়তোবা সে কারণেই আমরা বিভিন্ন রকম সিস্টেমের আওতাধীন হয়ে পড়ি এবং আমাদের চিন্তাধারাও সেভাবে চালিত হতে থাকে। হলফ করে বলা যায়, এখানে যারা টিকে থাকতে পারে তারাই মূলত সফল।
একটা বিষয় মনে রাখবেন অবশ্যই, আপনার একনিষ্ঠ পরিশ্রম হছে আপনার একমাত্র পুঁজি এবং এই পরিশ্রমই আপনার মাধ্যমে স্টার্টআপ সফল করার আসল হাতিয়ারে রূপ নেবে। হয়তোবা কে জানে, এর মাধ্যমেই ঘুরে যেতে পারে আপনার বাধাধরা জীবনের মোড়। একটু ভেবে দেখুন, আপনার নিজের প্রতিষ্ঠানে আপনার পছন্দের কাজ করার সুযোগ, সাথে বোনাস হিসেবে অর্থ উপার্জনের সৎ উপায় তো রয়েছেই। আর জীবনের এতো সব চাহিদা পূরণ হতে পারে আপনার কর্মজীবনের শুরুতে পরীক্ষামূলক কিছু ঝুঁকি নেয়ার মাধ্যমে।
প্রথমে আসা যাক মূলধনের ব্যাপারে। একজন নতুন উদ্যোক্তার ব্যবসা শুরু করতে সবার আগে প্রয়োজন হয় মূলধনের। বেশির ভাগ সময় তাই উদ্যোক্তাদের দৃষ্টি থাকে বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করার দিকে। নতুনদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, তারা কোনোরকমে একজন বিনিয়োগকারী পেলেই মূলধন গুছিয়ে নিয়ে নেমে পড়ে ব্যবসায়িক দুনিয়ার কঠিন এক ইঁদুরদৌড়ে। আপনিও ভাবতে পারেন, আপনার ব্যবসায়িক উদ্যোগে সম্ভাবনা অনেক, সুতরাং একজন বিনিয়োগকারীকে প্রভাবিত করলেই আপনি দরকারি টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নেই। আপনি নিশ্চিত তো? আসলেই কি সমস্যা নেই?
উপযুক্ত একজন বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া অনেকটা ড্রেনে পড়ে যাওয়া মুদ্রা ঘেঁটে বের করার মতোই কঠিন। একজন আদর্শ বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিভঙ্গি হবে আপনার অনুরূপ। তিনি অবশ্যই আপনার সামনের বাধাগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখবেন এবং তার ব্যবসাবুদ্ধি হবে প্রখর, যার মাধ্যমে তিনি আপনাকে পরিচালিত করতে পারবেন আপনার সাফল্যের দিকে।
1776 নামক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা Donna Harris এর মতে, “সবচাইতে দক্ষ বিনিয়োগকারী তিনি, যিনি আপনাকে কখনোই এই প্রশ্ন করবেন না যে সবচেয়ে কত কম খরচে আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারবেন।” তার প্রশ্ন হবে “এখানে সম্ভাবনা কেমন, আর সেটা পূরণ হবে কীভাবে?” অর্থাৎ আপনার জন্য টাকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একজন অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ বিনিয়োগকারী। একজন আদর্শ বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করার জন্যে আপনি নিন্মোক্ত এই চারটি প্রাথমিক পরামর্শ কাজে লাগাতে পারেন।
১. আপনার সম্ভাব্য পন্থাগুলো বুঝতে হবে
বেশি যোগাযোগ, বেশি অভিজ্ঞতা আর বেশি তহবিল- তিনটিই আপনার প্রয়োজন। বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর কাছে আপনি বিভিন্ন রকম সহায়তা পেতে পারেন। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে আপনার প্রয়োজন হবে তাদেরকে, প্রযুক্তি বিশ্বে যাদেরকে ব্যবসায়িক পরিভাষায় দায়িত্ব ও শর্ত ভেদে এঞ্জেল ইনভেস্টর ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ইনভেস্টর বলা হয়। তাদের কাছ থেকে আপনি প্রচুর অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন, কিন্তু ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিষয়ে তেমন সহায়তা না-ও পেতে পারেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে এঞ্জেল ইনভেস্টরদের (Angel investors) চাইতে VC বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রদানকারী অনেক বেশি নিরেট তথ্য দাবি করে থাকেন। আপনার ব্যবসার পরিকল্পনা যদি যথেষ্ট আঁটসাঁট এবং সম্ভাবনাময় না হয়, তাদের সমর্থন আপনি পাবেন না। তাই অনেক উদ্যোক্তা প্রাথমিক পর্যায়ে এঞ্জেল ইনভেস্টরদের (Angel Investors) সহায়তা নিয়ে থাকেন এবং ভেঞ্চার ইনভেস্টরদের সাথে যোগাযোগ করেন পরবর্তীতে তহবিল সংগ্রহের সময়।
২. জেনে নিন কী ধরনের সহায়তা আপনি পেতে পারেন
মনে রাখবেন, একজন ইনভেস্টর একটি চলমান চেকবইয়ের মতো। আপনার যখন টাকা লাগবে, টুক করে চেকে টাকার পরিমাণটা লিখে আপনাকে ছিঁড়ে দিয়ে দেবে কোনো প্রকার সংকোচ চাড়াই। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, আপনাকে দেখে আপনার বিনিয়োগকারীরা ভয়ে চেকবই লুকিয়েও রাখতে পারে। সরাসরি বলা যায়, মনে রাখবেন, বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা-সংক্রান্ত যেকোনো ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন এবং সেটি আপনার থেকেও দুই ডিগ্রী উপরে। যখন সে আপনাকে টাকা দিচ্ছে তখন সে বুঝেই দিচ্ছে, এতে কেমন পরিমাণ আয় কিংবা ব্যয় হবে।
এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে শুরুতেই। আপনার বোর্ড সদস্য হিসাবে বেছে নিন তাদেরকে, যারা আপনার সব সিদ্ধান্তকে বাধাগ্রস্ত করবেন না। এছাড়া অনেক বৃহৎ VC প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের নিজস্ব বিপণন বিভাগ আছে। তাদের পক্ষে বাইরে বার্তা পাঠানো অথবা নিজস্ব পোর্টফোলিও ব্যবহার সম্ভব। উদ্যোক্তারা তাই এক্ষেত্রে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে নিজেদের প্রচারণার সুবিধা পেতে পারেন।
৩. কোথায় চোখ রাখবেন জানেন কী?
উপযুক্ত বিনিয়োগকারী খুঁজে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যখন আপনি আপনার দৃষ্টিসীমা জানবেন। তবে আপনার এটাও জেনে নেওয়া দরকার যে, আপনি কীভাবে যোগাযোগ বজায় রাখবেন। এঞ্জেল ইনভেস্টরদের কাছে থাকে উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে ব্যাপক পরিমাণ তথ্যাদি। Angels Den অথবা Angel List নতুন সিইওদের সুযোগ দিচ্ছে বিনিয়োগকারীদের খোঁজা এবং তাদের সাথে যোগাযোগের।
৪. বিনিয়োগকারীদের সাথে আপনার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক নিশ্চিত করুন
প্রাথমিক পর্যায়ে অসাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিই একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আপনাকে জেনে নিতে হবে বিনিয়োগকারী আপনার প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ এবং সংস্কৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন কিনা। উদাহরণ হিসেবে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে প্রথমেই; যেমন তিনি কি নিয়মিত ব্যবসায়িক কাজে সরাসরি যুক্ত থাকবেন নাকি নিষ্ক্রিয় থাকবেন। অথবা তার ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে আপনার থেকে ভিন্ন। সাধারণত উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতাদেরই এককভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রশ্ন করুন আপনার বিনিয়োগকারীর কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা সম্পর্কে। তারা কীভাবে বা কোন মাত্রায় যুক্ত থাকতে চান, এটা আগেই নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব রোধ করা সম্ভব।
সর্বোপরি, মনে রাখবেন, একজন বিনিয়োগকারী অথবা অর্থলগ্নিকারীও আপনার-আমার মতোই মানুষ। আপনিও একটি লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য তার কাছে এসেছেন এবং তিনিও সে অনুযায়ী আপনার সম্ভাব্য লক্ষ্যটিকে সামনে রেখেই বাকি বিষয় নিয়ে বিবেচনা করবেন। কেবল আর্থিক মুনাফা ছাড়া আপনি তার কাছে আর কী চান, সেটা বুঝে নিতে হবে আপনাকেই। তাই নিজে খোঁজ নিন, গবেষণা করুন কী ধরণের বিনিয়োগকারী আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। এমন ব্যক্তি খুঁজে নিন যিনি আর্থিক বা অন্যান্য সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি আপনার জন্য অসাধারণ পরামর্শদাতা, এমনকি আপনার ব্যবসায়িক জগতে একজন শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। পরিশেষে আপনার ব্যবসায়ের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
ফিচার ইমেজ- mashupcorner.com