বলা হয়, বাঙালি রাজনৈতিকভাবে সচেতন। দেশের এবং বিশ্বের রাজনৈতিক ভাবগতিক বুঝতে বাঙালির নাকি বুঝতে বেগ পেতে হয় না। আর বাঙালি যেহেতু শিক্ষিত এবং চিন্তাশীল, তার বামপন্থী চিন্তাভাবনা সহজাত। দক্ষিণপন্থী ধনতান্ত্রিক আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে শোষণ-অত্যাচার, বাঙালি স্বাভাবিকভাবেই তার বিরুদ্ধাচরণ করে। ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান প্রবল হওয়াতে বাঙালি কোনোরকম সমঝোতায় যেতে রাজি নয় এবং সোজা কথা সোজা বলার দরুন তাকে নানা সময়েই অনেক কঠিন মূল্য চোকাতে হয়।
কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগে। আজকের একমুখী দুনিয়ায় যখন চিন্তাশীল প্রতিরোধের ভাষা প্রায় শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে, তখন বাঙালির মনের এই ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনের কথা শুনলে গর্ববোধ হয় ঠিকই। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে পা ঠেকিয়ে যদি চোখের মণিজোড়া ঘুরিয়ে সত্যবিশ্লেষণের অবকাশ ঘটে, তখন বোঝা যায় ভারতের বাঙালির রাজনৈতিক অবস্থান আসলে কতটা অন্তঃসারশূন্য।
পরিস্থিতিটা আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিগত প্রায় সাত বছর ধরে ক্ষমতায় আসীন। পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ বামপন্থী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তার তৃণমূল কংগ্রেস গদিতে বসে ২০১১ সালে। শাসনের প্রথম পাঁচটি বছর শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজকর্মে যথেষ্ঠ অপরিপূর্ণতার চাপ দেখা যায়।
তবুও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাকে পুনর্নির্বাচিত করে ২০১৬ সালে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে মমতা বিকল্পহীন। বামপন্থীদের এবং কংগ্রেস দলের ক্রমাগত পতন এবং হিন্দুত্ববাদী বিজেপির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মাঝে মমতা এখনও পশ্চিমবঙ্গের একচ্ছত্র অধিনায়িকা। তাকে হঠানোর মতো শক্তি এখনও তার বিরোধীপক্ষ জোগাড় করে উঠতে পারেনি, আর অদূর ভবিষ্যতে পারবে বলে মনেও হয় না।
২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মমতা বোঝেন যে, বাম নয়, এবার রাম বা বিজেপিই হচ্ছে তার আসল শত্রু। এর এক নম্বর কারণ হচ্ছে ভারতের কেন্দ্রে বিজেপির ক্ষমতায় আসা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব চিরকালই কেন্দ্র সরকারকে আক্রমণ করে এসেছে সে রাজ্যকে অবহেলা করার অভিযোগে। আর কোয়ালিশন যুগের সমাপ্তি ঘটার ফলে শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায়েরও সুবিধা হয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে অনবরত আক্রমণ করার। কারণ, কেন্দ্রের কোনো সিদ্ধান্তগ্রহণে এখন আর তার দলের কোনো ভূমিকা নেই। আর দ্বিতীয় এবং আরও বড় কারণ হচ্ছে সংখ্যালঘু ভোট।
অতীতে বেশ কয়েকবার বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধলেও মমতা সেগুলো করেছিলেন বিরোধী নেত্রী হিসেবে। আজকে পরিস্হিতি বদলে গিয়েছে আমূল এবং পশ্চিমবঙ্গের ত্রিশ শতাংশ মুসলমান ভোটারের মন রাখতে তৃণমূল নেত্রীকে বিজেপি-বিরোধী অবস্থান নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তার নিজের প্রশাসনের নানাবিধ ব্যর্থতা ঢাকতে মমতাকে বিজেপির সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাত চালিয়ে যেতেই হবে। আর বিজেপি এবং তার গেরুয়া ভক্তদের কাছেও এটি একটি বড় সুযোগ মমতাকে ‘হিন্দুবিরোধী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ বলে প্রমাণ করার।
বিজেপির এই মমতাবিরোধী মিশন যে তৃণমূলকে বেশ বিব্রত করেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মুখে বিজেপিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেও তৃণমূল কংগ্রেসের নিচুতলার নেতারা ‘রাম-রাজনীতি’কে ঠেকাতে পাল্টা এক ‘হনুমান রাজনীতি’ শুরু করেছে। আর এখানেই প্রকট হচ্ছে বাঙালির রাজনৈতিক ‘সচেতনতার’ নমুনা।
আদর্শগত রাজনীতির কোনো বয়সবিধি থাকে না। পশ্চিমবঙ্গে অতীতে ডানপন্থী রাজনীতি মাথা তুলতে পারেনি, কারণ, প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে বামেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল জোরদার। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়াকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আগুন জ্বলছে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বাম মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তার রাজ্যে কোনোরকম দাঙ্গা হতে দেননি। সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন সেভাবে না হলেও, কংগ্রেস এবং বামেদের শাসনকালে যে সেকুলার ট্র্যাডিশনের পত্তন হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সমাজ এবং রাজনীতিতে, তা হিন্দুত্ববাদীদের কট্টরপন্থার থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখে সে রাজ্যের জনজীবনকে।
কিন্তু আজকে দেখা যাচ্ছে, এই ইন্টেলেকচুয়াল অবস্থানটি সম্পূর্ণরূপে ক্ষয়িষ্ণু। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুখে হিন্দুত্ববাদীতার বিরোধিতা করছেন ঠিকই, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে তারা একইরকম পাল্টা হিন্দুত্ববাদী চাল চালছেন বিজেপিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যে। আর এর পাশাপাশি চলছে সংখ্যালঘু তোষণের দেদার প্রক্রিয়া।
আগে বামেরা সম্পূর্ণ সিস্টেমটিকে নির্লজ্জ দলতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিল, আর এখন বাম-পরবর্তী নেতৃত্ব মেতেছে এক সম্পূর্ণ দিশাহীন রাজনীতির খেলায়। যদি বাঙালি সত্যিই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়, কিউবায় বৃষ্টি হলে কলকাতার ময়দানে ছাতা খুলে দাঁড়ায় সলিডারিটি প্রদর্শন করতে, তবে নিজভূমিতে বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন কদর্য রূপ কেন?
আসল সমস্যা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের আজকের যে ভয়াবহ অার্থ-সামাজিক অবস্থা, তা থেকে কীভাবে বেরুনো সম্ভব, তা যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের জানা নেই; তেমনি সেখানকার সুশীল সমাজের নেই কোনো মাথাব্যথাও। না হলে কি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে বামেদের চূড়ান্ত প্রশাসনিক গাফিলতির ফলে তৈরি হওয়া স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক প্রতিবাদকে তৎকালীন বিরোধীরা হাইজ্যাক করে ফেলার পরে পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজ রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে?
সুশীল সমাজের কাজ শাসকের মুখের সামনে যায় না ধরা, তা সে যে দলের বা রঙেরই হোক না কেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজনৈতিকভাবে সচেতন’ সুশীল সমাজ ব্যস্ত থাকে শাসকের অনুগত থাকতে, তা সে যে দলেরই হোক না কেন। সুবিধাবাদের ধরন এমনটিই হয়ে থাকে বলে আমরা জানি, আর পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু এই খোলাখুলি শিবির বদলানোর ঘটনা দেখা গেল তিন দশক পরে, তাই তা হয়তো একটু বেশি দৃষ্টিকটু লেগেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধাবাদই যদি আসল ঘটনা হয়, তবে তাহলে কীসের রাজনৈতিক ন্যায়বোধের গর্ব?
যে তিনটি ঘটনা ভারতীয় বাঙালির সমাজ–অর্থনীতি–রাজনীতিকে ফালা ফালা করেছে
আসলে ইতিহাসের তিনটি ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক জীবনকে চিরকালের জন্যে তছনছ করে দিয়েছে এবং তার বোঝা বহন করে চলেছে সেখানকার রাজনীতি। প্রথমটি হলো দেশভাগ। বাংলার মতো একটি বিরাট এবং অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় প্রদেশকে মুহূর্তে কেটে টুকরো করাতে সেখানকার অর্থনীতি এবং সমাজজীবনে নেমে আসে এক অশেষ অভিশাপ, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে। জমির আয়তন একদিকে যেমন কমে যায় ভারতের অন্তর্ভুর্ক্ত বাংলায়, তেমনি রিফিউজি সমস্যা এবং দুর্বল হয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা কখনোই সহজ কাজ ছিল না।
মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় তাও বা যেটুকু করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির জন্য, তার মৃত্যুর পরে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়ে ওঠে টালমাটাল। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭২ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনো স্থিতিশীলতা দিতে পারেনি, যার উপর ভর করে রাজ্যটি অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে মজবুত করতে পারে।
বাঙালির ‘অরাজনৈতিক‘ উদ্যোগ কোথায়?
দ্বিতীয় আঘাতটি আসে ষাটের দশকের শেষ এবং সত্তরের শুরুতে, যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জীবনে আজকে যে ইন্টেলেকচুয়াল সঙ্কট, তার জন্যে অনেকটাই দায়ী এই অশান্ত সময়টি।
আজকের পুঁতিগন্ধময় রাজনীতির যুগেও পশ্চিমবঙ্গে একটিও তরতাজা রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা যায় না দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির ধাঁচে। অথচ বাঙালি নাকি রাজনৈতিকভাবে সচেতন বলে দাবি করা হয় অহোরাত্র। সচেতনতা সত্যিই থাকলে দলতন্ত্র, সিন্ডিকেটতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে না কেন অরাজনৈতিক বাঙালি? নাকি রাজনীতি তার ন্যায়বোধকেই গিলে খেয়েছে?
বাম শাসন শেষ করেছে মনন
তৃতীয় বড় কারণ হচ্ছে ৩৪ বছরের বাম শাসন। দেশভাগ আর নকশাল আন্দোলন যদি কোমর ভেঙে দিয়ে থাকে, তাহলে এই সময়টায় বাঙালির রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটে গিয়েছে। একটি দলের হাত যখন নাগপাশের মতো একটি সমাজকে বেঁধে ফেলে, তার স্বাধীন চিন্তাভাবনার ক্ষমতাটাই নষ্ট করে দেয় সাম্যবাদী উত্থানের দোহাই দিয়ে, তখন আর বিশেষ কিছু করার থাকে না ভবিষ্যতের হাতেও। রাজনৈতিক সচেতনতা তো দূরের কথা, বামেদের সর্বগ্রাসী রাজনীতি বাঙালির সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মননটিকেই ধ্বংস করেছে তিলে তিলে।
আজকের বাম-পরবর্তী নেতৃত্বও মুখে বামেদের বাপ-বাপান্ত করলেও প্র্যাকটিস করছে কিন্তু ওই এক রাজনীতির ধারাই। শুধু তফাৎ হচ্ছে, এখন এই রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক রং লেগেছে, আর এখন একটি দলের পরিবর্তে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে একজন ব্যক্তি।
শুধু হুঙ্কার ছাড়লেই হিন্দুত্ববাদীদের মোকাবিলা হয় না- দরকার বিকল্প চিন্তার
ভারতের উচ্চাশাপূর্ণ হিন্দুত্ববাদীদের মোকাবিলা করতে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন, তা এখনকার বঙ্গীয় নেতৃত্বের বিশেষ নেই। তারা বিরোধিতা করছে বিরোধিতার জন্য, আর খুশিও হচ্ছে তলে তলে যে তাদের বিরোধী ভোট কেটে যাচ্ছে রাম এবং বামেদের মধ্যে তা নিয়ে। চিন্তার এই সীমাবদ্ধতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। জনপ্রিয়তার সস্তা রাজনীতি করে মসিহা হয়ে ওঠার মধ্যে যে আকর্ষণ আছে, তা অগ্রাহ্য করতে মধ্যমেধার নেতৃত্ব অপারগ- সব যুগেই, সব দেশেই। আর সেটাই অনবরত হয়ে চলেছে আজকের পশ্চিমবঙ্গে। কারণ, শাসক জানে যে ৩৪ বছরের দুঃশাসন যে ক্ষতি করে দিয়ে গিয়েছে, তা মেরামত করার ক্ষমতা কারোরই নেই। অতএব, নতুন শত্রু চাই, চাই লড়ার নতুন স্ক্রিপ্ট। হিন্দুত্ববাদীরা সে আশা পূরণ করে দিয়েছে, নিঃসন্দেহে।
কিন্তু রাজনীতির কথা যেখানে শেষ, সেখানে তো মেধার যাত্রার শুরু হওয়া উচিত। সেটাও তো আজকের পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে না। তার কারণ ভয় হতে পারে, হতে পারে হতাশা বা আত্মকেন্দ্রিকতাও। তা সে যা-ই হোক, মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার এই প্রবণতা শেষ পর্যন্ত বে-আব্রু করে আমাদের সবাইকেই। আর তাই অনুরোধ, এবারে শেষ হোক চণ্ডীমণ্ডপের পিদিমের নিভু নিভু আলোয় বসে রাজনৈতিক সচেতনতার গুরুগম্ভীর দাবি। ও আমাদের সাজে না।
ফিচার ইমেজ: The Quint