সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতিতে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চক্ষুশূল তিনি- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মমতার অভিযোগ, বিগত চার বছরে মোদী সরকারের যথেচ্ছাচার দেশকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে; হিন্দুত্ববাদী ‘সুড়সুড়ি’ থেকে শুরু করে নোটবন্দি, ব্যাঙ্ক ‘লুঠ’ ইত্যাদি নানা অপকর্মে ইন্ধন জুগিয়েছে বর্তমান সরকার। আর তাই আগামী দিনে যাতে এই সরকার আরও ক্ষতি না করতে পারে, সেজন্য একটি জাতীয় কোয়ালিশন গড়ে তুলতে প্রবল আগ্রহী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী। যখনই দেশের কোনো আঞ্চলিক নেতা মোদী-বিরোধী জাতীয় ফ্রন্ট তৈরি করার কথা বলছেন, মমতা সটান তাকে তার সমর্থন জানিয়ে বসছেন। যেনতেন প্রকারে মোদীকে তার হারানো চাইই চাই।
মোদীর সঙ্গে মমতার এই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথম দেখা যায় ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে। মোদী শুরুর দিকে মমতার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও, মমতা তা গ্রহণ করেননি কখনোই। উল্টো তার বিরুদ্ধে ক্রমশ বাড়তে থাকা বিষোদ্গার দেখে শেষপর্যন্ত মোদীকেও সুর চড়াতে হয় পাল্টা।
সারদা, নারদ ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে প্রতি আক্রমণে যান প্রধানমন্ত্রী সহ তার ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। অবশ্য তাতে পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিপুল বিক্রমে বিন্দুমাত্র নাড়াও দিতে পারেনি বিজেপি। তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর লক্ষ্যে অনেক গরম বুলি আওড়ালেও, মমতাকে তার ঘরে এখনো পর্যন্ত কোণঠাসা করতে পারেনি গেরুয়া বাহিনী।
কিন্তু এ তো গেল দলীয় রাজনীতির প্যাঁচ-পয়জার। মজার কথা এই যে, মোদী এবং মমতা তাদের দুজনকে একে অপরের থেকে আলাদা করে দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলেও, আসল কথা হলো, এই দুই নেতার রাজনৈতিক ধরনের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ঠ মিল। তারা নিজেরা সেটা বোঝেন কিনা জানা নেই, কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের চোখে এই মিল ধরা না পড়ে যায় না।
একজন কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করেছেন, আরেকজন কমিউনিস্টদের
প্রথমত, মোদী এবং মমতা দুই ব্যক্তিত্বই রাজনীতির ময়দানে বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করতে চূড়ান্ত সফল। একদিকে মোদী প্রথমে তার রাজ্য গুজরাটে এবং পরে জাতীয় স্তরে ভারতের প্রাচীনতম দল কংগ্রেসকে কুপোকাত করেছেন এবং সমস্ত দেশকে কংগ্রেস-মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। অন্যদিকে মমতাও পশ্চিমবঙ্গে একদা প্রবল শক্তিশালী বামপন্থীদের রাজনৈতিক সমাধিতে পাঠিয়ে এদেশের কমিউনিস্টদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন।
ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের মতো দুটি ঐতিহ্যশালী রাজনৈতিক শক্তিকে প্রায় প্রান্তিক পর্যায়ে ফেলে দিয়েছেন এই দুই রাজনীতিবিদ। ভারতে এখনও কংগ্রেস ক্ষমতায় রয়েছে মাত্র পাঁচটি প্রদেশে; বামপন্থীরা একটি।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী
দ্বিতীয়ত, মোদী এবং মমতা দুজনেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কেউই পছন্দ করেন না সমালোচনা। মোদীর উত্থানের আগে তার বিজেপির কাজের ধরন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল না। অটলবিহারি বাজপেয়ির সময়ে বিজেপিকে বলা হতো ‘এ পার্টি উইথ এ ডিফারেন্স’, যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত নয় কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে। মোদীর জমানায় সেই পরিস্থিতি বদলেছে আমূল। বিজেপি এখন মোদী এবং তার সেনাপতি অমিত শাহের নেতৃত্বেই চলে; বাকিরা অনেকটাই স্তিমিত।
মমতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কিংবা বলা চলে, মমতার ক্ষেত্রে অন্যথা আশা করাই বৃথা, কেননা তার দলের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই স্বয়ং। সেখানে দ্বিতীয় কোনো মতামতের গুরুত্ব না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা ব্যবহারে বিশ্বাসী নেতা-নেত্রীর বৈশিষ্ট্য হলো, তারা একাই নিজ নিজ দলকে সামনের থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিপক্ষকে কোণঠাসা করেছেন সফলভাবে।
জনভিত্তি, ক্যারিশমা, গ্রহণযোগ্যতা যাই বলা যাক না কেন, মোদী এবং মমতার নিজস্ব অবস্থানে গিয়ে তাদের কর্তৃত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন শক্তি কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। আর সেই কারণেই হয়তো তাদের নিজেদের সংঘাতটি আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে দিন দিন।
দলের রাজনীতির ধরন
তৃতীয় মিলটি হচ্ছে তাদের দলের রাজনীতির ধরন। মোদীর বিজেপি যে আগাগোড়াই একটি দক্ষিণপন্থী দল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, কিন্তু মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিকে সোজাসাপ্টা দক্ষিণপন্থী না বলা গেলেও তাতে দক্ষিণপন্থী নিদর্শন বেশ কিছু রয়েছে অবশ্যই। মমতা মুখে বলেন যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা করলেও বামপন্থায় তার বিশ্বাস অটুট। তাকে অনেকে জনদরদী নেত্রী হিসেবেও দেখে থাকেন। তবে আসল ঘটনা হচ্ছে, মমতার বামপন্থী রাজনীতি একদিকে যেমন কৌশলগত, তেমনই বামপন্থীদের রাজনৈতিক জমি সম্পূর্ণ কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি জনপ্রিয়তাবাদের ভিত্তির উপরে রচিত আর এসবই দক্ষিণপন্থী রাজনীতিরই পরিচায়ক।
সম্প্রতি মমতাদেবীর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ‘সমকামিতা বাঙালি সংস্কৃতির পরিপন্থী’ বলে যে মন্তব্যটি করেছেন, তাতেও পরিষ্কার হয় দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সাবধানবাণী। আবার বিজেপির মতো তৃণমূল কংগ্রেসও ব্যাক্তিস্বাধীনতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ, যা অতীতে দেখা গেছে বেশ কয়েকবার। অধ্যাপক থেকে চাষী কিংবা ছাত্রী থেকে সাধারণ মহিলা- সবাই বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে চক্ষুশূল হয়েছেন দলের নেত্রীর। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে এটাই দস্তুর, আর পশ্চিমবঙ্গে তার অন্যথা হয়নি।
আবার অন্যদিকে, বিজেপি যেমন পরিপক্ক দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ধারক এবং বাহক হিসাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে সোচ্চার হয়েছে ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’কে উৎসাহ দিতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দেখা গেছে তার রাজ্যে একধরনের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার খেলায় মাততে। ভাষা থেকে শুরু করে মনীষীদের জন্মদিন পালন এবং পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গকে ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা বা নিজের রাজ্যের জন্যে ‘বিশ্ববাংলা’ প্রতীক তৈরি করা- এসবই তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পরিচায়ক।
মমতা চপশিল্পকে শ্রদ্ধা করেন, মোদী পাকোড়া ভাজাকে
পরবর্তী মিলটি অর্থনৈতিক। এই দুই নেতা-নেত্রীই ক্ষমতায় এসেছিলেন একটি বিশাল প্রত্যাশার ফানুসের উপরে ভর করে। ২০১১ সালে মমতা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসেন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে, আর ২০১৪তে মোদী দিল্লির তখতে বসেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। দুই রাজনীতিবিদের উপরেই চরম প্রত্যাশা তৈরি হয় নানাবিধ সমস্যার সমাধান করার। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের পর মমতা এবং স্বাধীনতার পরে আজ পর্যন্ত কংগ্রেসের একতরফা কর্তৃত্বের পর মোদী সব সমস্যার আশু সমাধান করবেন বলে আশান্বিত হয় মানুষ। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই যেন সেই ফানুস দুমড়ে যায় নিমেষে। মমতাদেবী প্রথমে দাবি জানান, তার সরকার এই পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ চাকরির সংস্থান করেছে; আগের সরকারের অপশাসনের পরে অনেক কষ্টে তারা এই সফলতা লাভ করেছেন। কিন্তু যখন আর চিঁড়া ভেজেনি, তখন নেত্রী সদর্পে ঘোষণা করেছেন যে, কোনো কাজই ছোট নয়, অতএব চপ বিক্রিও সমান সম্মানদায়ক পেশা।
বিজেপির সমর্থকরা মমতার এই দৃষ্টিভঙ্গি শুনে হাসাহাসি করলেও, পরে মোদীও হেঁটেছেন সেই একই পথে। বলেছেন, পাকোড়া বিক্রি করাও তো একটা কাজ। প্রধানমন্ত্রীর মুখে এই মন্তব্য শোনা গেছে যখন তার বিরোধীরা তার বিপুল কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতিকে আক্রমণ করেছে। আর চপ, পাকোড়ার গল্প শুনে তারা তাদের আক্রমণের শান আরও বাড়িয়েছে।
মোদী এবং মমতা দুজনেই পপুলিস্ট নেতা-নেত্রী। তারা তাদের রাজনৈতিক আবেদনকে কাজে লাগিয়ে যে অনেক সফলতা হাসিল করতে সক্ষম, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দক্ষ প্রশাসক হিসেবে, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলার যে গুণ একজন রাষ্ট্রনায়কের থাকা প্রয়োজন, তা তাদের নেই। বিভাজনের মধ্যে দিয়ে (মোদীর ক্ষেত্রে ধর্ম-সম্প্রদায় এবং মমতার ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি) নিজস্ব কর্তৃত্বকে কায়েম রাখার কৌশলে দৃঢ় বিশ্বাসী দুজনেই, আর সেটাই তাদের মধ্যে বোধহয় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মিল।
Featured Image Source: Firstpost