গত মাসেই সম্পন্ন হয়েছে দুই কোরিয়ার নেতাদের এক ঐতিহাসিক সম্মেলন। এই সম্মেলন উপলক্ষ্যে কোরীয় যুদ্ধের পরে এই প্রথম উত্তর কোরিয়া থেকে কোনো নেতা দক্ষিণ কোরিয়ায় যাত্রা করেছেন। কথা ছিল, এরপরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সম্মেলন করবেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। সেই সম্মেলনটি আগামী ১২ জুন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ১২ জুন এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে কেন হঠাৎ এই সম্মেলন নিয়ে সংশয় দেখা দিল? সম্মেলনটি কেনই বা গুরুত্বপূর্ণ? আদৌ কি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই সম্মেলন? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
সম্মেলন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে কেন?
সম্মেলনের পূর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার জন্য কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছেন। হোয়াইট হাউজে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইনকে স্বাগতম জানিয়ে তিনি জানান, সম্মেলনটি হওয়ার জন্য উত্তর কোরিয়াকে অবশ্যই কিছু শর্ত পালন করতে হবে। শর্ত পালন করলে এই সম্মেলন হবে, নতুবা হবে না।
এদিকে উত্তর কোরিয়া জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি একতরফাভাবে তাদেরকে পারমাণবিক অস্ত্র বর্জন করার জন্য জোরাজুরি করে, তাহলে তারা এই সম্মেলন বাতিলও করতে পারে। ট্রাম্প যদিও জানাননি তিনি কী শর্ত দিয়েছেন বা দেবেন, তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, অবশ্যই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে।
সম্মেলন নিয়ে ট্রাম্প কী বলেছেন?
সম্মেলনটি আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিত হবে কিনা সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে ট্রাম্প বলেন, “এটি খুব ভালোভাবেই হতে পারে। তবে যা-ই হোক না কেন, আমরা আগামী সপ্তাহে সিঙ্গাপুর সম্পর্কে জানতে পারব। আমরা যদি এ ব্যাপারে এগোই তাহলে সেটি উত্তর কোরিয়ার জন্য বেশ ভালো হবে বলে মনে করি।” তবে শেষে তিনি যোগ করেন,“দেখা যাবে।” অর্থাৎ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা আগামী সপ্তাহেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, “কিছু নির্দিষ্ট শর্ত আছে যেগুলো আমরাই চাই। আমার ধারণা এগুলো পূরণ হবে। যদি না হয় তাহলে আমরা এই সাক্ষাতটি করব না।”
তিনি আরও বলেন, “কিছু চুক্তি ১০০% পূরণ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না। আবার কিছু চুক্তি একেবারেই হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও তা পূরণ হয়, অনেক সময় খুব সহজেই হয়।”
সম্মেলন নিয়ে দুই নেতার সুর পাল্টে গেল কীভাবে?
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক অনুশীলনকে ‘প্ররোচনা’ বলে অভিহিত করে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা বাতিল করেছে উত্তর কোরিয়া।
ট্রাম্পের মতে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে কিম জং উনের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ তাকে এই সম্মেলনের ব্যাপারে আরও শক্ত অবস্থানে যেতে প্রভাবিত করেছে। তবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, চীন কোরীয় উপদ্বীপের ক্ষেত্রে সবসময় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
পিয়ংইয়ং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জন বোল্টনের মন্তব্যকেও বেপরোয়া হিসেবে অভিযোগ করেছে। পারমাণবিক তৎপরতা বন্ধের ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া লিবিয়ার মডেল অনুসরণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন জন বোল্টন। লিবিয়ার মডেল বলতে তিনি লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির কথা বুঝিয়েছেন। গাদ্দাফি ২০০৩ সালে পারমাণবিক অস্ত্র পরিহার করতে চেয়েছিলেন।
ট্রাম্প পরবর্তীতে জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়ার সাথে কোনো চুক্তিতে আসলে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কিছু করবে না। তিনি বলেন, “সেই মডেলটি সংঘটিত হতে পারে যদি আমরা কোনো চুক্তি না করি। তবে আমরা যদি কোনো চুক্তি করি, আমার ধারণা কিম জং উন খুব খুশি হবেন।”
সম্মেলনটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর কোরিয়া বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। দেশটি অনেক দূরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সফল হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভূখণ্ডেও আঘাত আনতে সক্ষম বলে দাবি করেছে।
উত্তর কোরিয়ার এই পারমাণবিক তৎপরতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ আগে থেকেই চিন্তিত। এর আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার কোনো নেতার সাথে সম্মেলন করেননি। সে কারণে আসন্ন সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলে তা ঐতিহাসিক একটি সম্মেলন হতে যাচ্ছে।
প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার মতো সম্ভাবনার পরে উত্তর কোরিয়ার দেওয়া সরাসরি কথা বলার আমন্ত্রণে ট্রাম্প রাজি হয়ে যান। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সম্মেলন করা উচিত কিনা সে সম্পর্কে ট্রাম্প সহযোগী ও উপদেষ্টাদের পরামর্শ চাচ্ছেন।
মুন জায়-ইনের সাথে ট্রাম্পের দেখা করার পূর্বেই অনেক পর্যবেক্ষক জানান, সিঙ্গাপুরের এই সম্মেলনে অগ্রসর না হওয়ার কারণ হিসেবে ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ংয়ের অনেক সঙ্কট রয়েছে। তবে পিয়ংইয়ংয়ের দেওয়া পারমাণবিক তৎপরতা বন্ধের প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অর্থাৎ ‘ব্যাপক, যাচাইযোগ্য ও অপরিবর্তনীয়’-এ ধরনের না-ও হতে পারে।
এদিকে উত্তর কোরিয়ার পাঙ্গাই-রি পরমাণু কেন্দ্রটি ভেঙে ফেলার ঘটনা অবলোকন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো একদল পশ্চিমা, রুশ ও চীনা সাংবাদিক দেশটিতে অবস্থান করছেন। তবে বৈরি আবহাওয়ার কারণে পরমাণু কেন্দ্রটিতে তাদের যাত্রা আপাতত স্থগিত রয়েছে।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দুই নেতার একে অপরের প্রতি কটু বাক্য ছুঁড়ে দেওয়া ও ভীতি প্রদর্শনের কারণেই হোক আর বিশ্বশান্তির জন্যই হোক, তাদের এই সম্মেলনটি নিয়ে অনেকেই আশাবাদী। তবে এটি অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে। কেননা, যদি কোনো সমাধানই না হয় তবে সেই সম্মেলন করে লাভটিই বা কী? তাই হয়তো দুই দেশের পক্ষ থেকেই আবার ভাবতে বসেছে, সম্মেলনে যে শর্ত দেওয়া হবে তা মেনে নিয়ে সমাধানে আসা সম্ভব কিনা।
Featured Image Source: REUTERS/Kevin Lamarque and Korea Summit Press Pool