আসিফা: সাম্প্রদায়িকতা ও বর্বরতার এক নির্মম শিকার

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের কাথুয়ায় ৮ বছর বয়সী শিশু আসিফা বানুকে গণধর্ষণের পরে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় বিমূঢ় বিশ্বের মানুষ। বর্বর এই ঘটনার সাথে আবার যুক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নমুনাও। ঘটনার প্রায় তিন মাস পরে বিস্তারিত প্রকাশিত হলে সারা ভারতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আসলে কী ঘটেছিল আসিফার সাথে? মাত্র ৮ বছর বয়সী এক শিশুর উপর কেন এমন ভয়ঙ্কর নির্যাতন? কীভাবেই বা এই ঘটনা জনসম্মুখে এলো?

আসিফার পরিচয় কী?

আসিফা বানু ভারতের অন্তর্গত জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্গত কাথুয়া জেলার রাসানা গ্রামের বাসিন্দা ছিল। তার বাবা মোহাম্মদ ইউসুফ পুজওয়ালা একজন পশুপালক। তার মায়ের নাম নাসিমা বিবি। তারা মুসলিম এবং যাযাবর বাকেরওয়াল গোত্রের অন্তর্গত। কয়েক বছর  আগে এক দুর্ঘটনায় মোহাম্মদ পুজাওয়ালার দুই মেয়ে নিহত হলে তার স্ত্রীর অনুরোধে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে তারা আসিফাকে দত্তক নেন।

প্রতিবাদে মানুষ; Source: newsato.com

আসিফা কীভাবে নিখোঁজ হয়েছিল?

আসিফা নিখোঁজ হয় গত ১০ জানুয়ারি। এ সময় তার পরিবার জম্মু শহর থেকে প্রায় ৭২ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে অবস্থান করছিল। সেদিন বিকেলে তার মার মনে পড়ে, আসিফা তাদের ঘোড়াগুলো ফিরিয়ে আনতে বনে গিয়েছিল। ঘোড়াগুলো ফিরেছে কিন্তু আসিফা ঘরে ফেরেনি।

নাসিমা বিবি আসিফার বাবাকে এ কথা জানালে তিনি প্রতিবেশীদের সাথে তাকে খুঁজতে বের হন। তারা লণ্ঠন, ফ্ল্যাশ লাইট ও কুড়াল নিয়ে বনের অনেক গভীরে গিয়েও খুঁজেন, কিন্তু কোথাও আসিফার সন্ধান মেলেনি।

দুদিন পরে অর্থ্যাৎ ১২ জানুয়ারি আসিফার পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানায়। কিন্তু আসিফার বাবার মতে, পুলিশ সহায়ক ছিলেন না। তিনি জানান, একজন পুলিশ নাকি এও বলে যে, আসিফা কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে।

এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ জানায় এবং সড়ক অবরোধ করে। এর ফলে পুলিশ দুইজন অফিসারকে আসিফার অনুসন্ধানের কাজে নিয়োগ করতে বাধ্য হয়। তাদের মাঝেই একজন অফিসার, দীপক খাজুরিয়া, এই অপরাধের সাথে জড়িত থাকার দায়ে পরর্তীতে গ্রেফতার হন।

৫ দিন পরে, ১৫ জানুয়ারি একজন প্রতিবেশী এসে আসিফার বাবাকে জানায়, তারা বনের মাঝে ঝোপঝাড়ের আড়ালে আসিফার মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে। আসিফার বাবা-মা সাথে সাথেই বনের মাঝে ছুটে যায়। তার মায়ের কাছ থেকে জানা যায়, আসিফার পাগুলো ভাঙা ছিল, নখ কালো হয়ে গিয়েছিল। তার হাতে ও আঙুলে নীল-লাল দাগ ছিল।

কী ঘটেছিল আসিফার সাথে?

আসিফার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার ৬ দিন পর, ২৩ জানুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি অপরাধ শাখাকে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। এটি হলো প্রাদেশিক পুলিশের একটি বিশেষ শাখা।

অনুসন্ধানকারীদের মতে, আসিফাকে একটি স্থানীয় মন্দিরে কয়েকদিন ধরে আটক করে রাখা হয় এবং অজ্ঞান রাখার জন্য তাকে ঘুমের ওষুধ সেবন করানো হয়। মামলার চার্জশিটে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাকে কয়েকদিন ধরে ধর্ষণ, নির্যাতন ও অবশেষে হত্যা করা হয়।

আসিফা; Source: atimes.com

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী সানজি রাম পুলিশ সদস্য সুরেন্দর ভার্মা, আনন্দ দত্ত, তিলক রাজ এবং দীপক খাজুরিয়ার সহায়তায় এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে এবং এ সংক্রান্ত অপরাধগুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। সানজি রামের ছেলে বিশাল এবং ভাগ্নে ও তার এক বন্ধু মান্নুও আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে অভিযুক্ত।

সানজি রাম তার ভাগ্নে ও তার বন্ধুকে এই বর্বর কাজের জন্য ডেকে পাঠায়। তার ভাগ্নে আসিফাকে বনের মধ্যেই ধর্ষণ করে। এরপর তারা তাকে সানজি রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে এবং ঘুমের ওষুধ দিতে থাকে। এদিকে দীপক খাজুরিয়ার উপর আসিফাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পড়ে, যেখানে সে নিজেই জড়িত ছিল। অনুসন্ধানের ফলে ঘটনা জেনে যাওয়ায় পুলিশ সদস্য তিলক রাজ ও আনন্দ দত্তকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রায় দেড় লাখ রুপি ঘুষ দেওয়া হয়।

টানা তিনদিন নির্যাতনের পরে যখন তারা আসিফাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তখন খাজুরিয়াও তাকে ধর্ষণ করে। এরপর সে আসিফাকে তার ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে এবং পাথর দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর তার দেহ জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়।

আসিফার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কী ঘটেছিল?

আসিফাকে তার বাবা-মা কয়েক বছর আগে কেনা জমিতে দাফন করতে চেয়েছিল। সেখানে এর মাঝে পাঁচজনকে কবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে আসিফাকে কবর দিতে গেলে ডানপন্থী হিন্দুরা তাদের ঘেরাও করে। সেখানে কবর দেওয়া হলে তারা সহিংসতা চালানোর হুমকি দেয়। এরপর প্রায় সাত মাইল পায়ে হেঁটে তাদেরকে অন্য গ্রামে যেয়ে আসিফাকে কবর দিতে হয়।

কেন আসিফার উপর এই নির্যাতন?

আসিফা ধর্ষণ ও হত্যার মূল হোতা সানজি রাম বলে জানানো হয় পুলিশের দাখিল করা চার্জশিটে। চার্জশিটে উল্লেখ করা আছে, এই অপরাধের উদ্দেশ্য ছিল বাকেরওয়াল গোত্রকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল থেকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া। পশুপালক হওয়ায় তারা সরকারি জমি ও বন-জঙ্গলে তাদের পশু চড়িয়ে ঘাস খাওয়াত। এর ফলে সে এলাকার কিছু হিন্দু অধিবাসীদের সাথে তাদের বিবাদ বাঁধে।

তালিব হুসেইন নামে একজন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী জানান, এটি ভূমি সংক্রান্ত বিবাদের জের। অংকুর শর্মা নামে আসামীপক্ষের একজন আইনজীবী বলেন, “তারা আমাদের বন ও পানির উৎসসমূহে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে।” তার মতে, অভিযুক্তদের এখানে মিথ্যা দায়ভার দেওয়া হচ্ছে আর আসল অপরাধীরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পুলিশের ভূমিকা

একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই অপরাধে সরাসরিভাবে পুলিশ সদস্য জড়িত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় পুলিশ প্রাথমিকভাবে আসিফার পরিবারকে সহযোগিতা করেননি বলেও অভিযোগ করেছে তার বাবা। চার্জশিটে এটিও উল্লেখ করা হয় যে, কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া চেষ্টা চালিয়েছে, আসিফার রক্ত ও কাদা মাখা জামাকাপড় ডিএনএ পরীক্ষা করার আগে পরিস্কার করে তারপর পাঠিয়েছে।

কিন্তু দুজন পুলিশ সদস্য তাদের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় পুরো ঘটনাটি অনুসন্ধান করে অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়েছেন। জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশের অপরাধ শাখার পুলিশের সিনিয়র সুপারিন্টেনডেন্ট রমেশ কুমার জাল্লা অনুসন্ধানটি পরিচালনা করেন। অনুসন্ধান পরিচালনাকালে তিনি বিজেপির নেতাদের প্রভাব ও চাপ অগ্রাহ্য করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অনুসন্ধানের জন্য তিনি একের পর এক গ্রেফতার করতে থাকেন।

রমেশ জাল্লা একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেন, যা পরিচালনার দায়িত্ব দেন নাভিদ পীরজাদা নামে এক পুলিশ অফিসারকে। নাভিদ পীরজাদা ও রমেশ জাল্লার দল আসিফার কাপড়ে লেগে থাকা কাদা ও মন্দিরে প্রাপ্ত চুলের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে ও চার্জশিট দাখিল করতে সক্ষম হয়।

রমেশ কুমার জাল্লা; Source: Majid Hyderi

অনুসন্ধানকারী দল আসিফার মৃতদেহের ছবি দেখে সন্দেহ করে যে, তার কাপড় ধুয়ে কাদা ও রক্ত পরিস্কার করা হয়েছে এবং এই আলামতগুলো তাদের ভেতর থেকেই কোনো সদস্য নষ্ট করছে। পরবর্তীতে পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার ব্যাপারটি বেরিয়ে আসে। এ ঘটনায় ৪ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। চার্জশিটে একজন স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে দেড় লক্ষ রুপি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। সরাসরি ধর্ষণের সাথে অভিযুক্ত নয় কিন্তু আসিফাকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তা জানে, এরকম অভিযোগও আনা হয়েছে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। সানজি রাম, তার ছেলে বিশাল ও তার ভাগ্নেসহ মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে সে অঞ্চলে অভিযুক্তদের সমর্থনে স্থানীয়রা কথা বলতে থাকে। জাল্লা ও তার দলের উপর চাপ বাড়তে থাকে। চার্জশিট দাখিল করার সময় পেছানোর জন্যও শুরু হয় প্রতিবাদ।

তবে তাদের উপর সবচেয়ে বড় চাপ আসে যখন মন্ত্রী চৌধুরি লাল সিং ও চন্দর প্রকাশ গঙ্গা আটককৃত পুলিশদের মুক্তির দাবিতে হিন্দু একতা মঞ্চের র‍্যালিতে যোগদান করেন। তবে সমালোচনার ঝড়ে তারা পরবর্তীতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ভারত জুড়ে প্রতিবাদ

এদিকে এ ঘটনায় ভারতের নয়াদিল্লী, মুম্বাই ও অন্যান্য শহরে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে সতর্কতা তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছে সাধারণ জনগণ।

গত সপ্তাহে একদল হিন্দু আইনজীবী কাশ্মীরের একটি আদালত ঘেরাও করেন, কেননা তাদের মতে আটককৃত ৮ জনকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সারা ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে হ্যাশট্যাগ প্রচারণা চালানো হয়।

অভিযুক্ত ৮ ব্যক্তি সোমবার, ১৬ এপ্রিল আদালতে তাদের প্রথম শুনানির জন্য হাজির হয়। এদিকে আসিফার পরিবার ও তাদের পক্ষের আইনজীবীদের নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এছাড়া আসামীপক্ষের আইনজীবীদের লাইসেন্স বাতিল করার দাবি জানিয়েছে অন্যান্য আইনজীবীরা

এদিকে গত শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “আমি দেশকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না, পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার করা হবে। আমাদের মেয়েরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবে।”  

আসিফারা ন্যায়বিচার পাক। আর কোনো আসিফার সাথে যেন এমন কোনো দুর্বিষহ ঘটনা না ঘটে সেটি নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রদায়িকতা ও বর্বর মানসিকতার শিকার হয়ে যেন আর একটি মানুষেরও প্রাণহানি বা সম্মানহানি না ঘটে। সেই সাথে আমাদেরও দাবি তুলতে হবে, সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অবস্থানের কারণেই হোক, ধর্ষণ মানুষের সমাজের বর্বরতম ঘটনা। প্রতিবেশী দেশের পাশাপাশি আমাদের দেশের মাঝে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচারই হোক এই মুহূর্তের সবচেয়ে জোরালো দাবি।

Featured Image Source: Newslaundry

Related Articles

Exit mobile version