অবশেষে সম্পন্ন হলো প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেলের রাজকীয় বিয়ে। শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২ টায় উইন্ডসর ক্যাসেল প্রাঙ্গনের সেইন্ট জর্জেস চ্যাপেলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় ৬০০ অতিথি ও ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের সামনে বিয়ের শপথগ্রহণ ও আংটি বদল করেন এই যুগল।
মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেলকে কিছুদিন আগেও বিয়ের কনের বেশে দেখা গিয়েছে। তবে সেটা আসল বিয়ে নয়, টিভির পর্দায়। টিভি সিরিজ স্যুটস এর পরে এবার সত্যি সত্যিই বধূবেশে আবির্ভূত হলেন তিনি। আসল বিয়েটা বরং অভিনয় জগতের চেয়েও বেশি নাটকীয়। কেননা সত্যিকার অর্থেই একজন প্রিন্সের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। তার ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অংশ হওয়াটা অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের রক্ষণশীল নিয়মকানুনে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি ও তার প্রেয়সীর এই বিয়ের ক্ষেত্রে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই রাজকীয় বিয়ে সম্পন্ন হলো।
বিয়ের অনুষ্ঠান
ধবধবে সাদা বিয়ের পোশাকে কনে মেগান মার্কেল সেইন্ট জর্জেস চ্যাপেলে হাজির হন। মেগানের মা ডোরিয়া র্যাগল্যান্ড মেয়ের সাথে চ্যাপেলে আসার আগের রাতেও তার সাথে অবস্থান করছিলেন। ১০ জন ফুটফুটে ব্রাইডসমেইডস ও পেজবয়েজদের সাথে বিয়ের মঞ্চে আসেন কনে। ব্রাইডসমেইডস ও পেজবয়েজদের মাঝে উইলিয়াম ও কেটের পুত্র-কন্যা প্রিন্স জর্জ ও প্রিন্সেস শার্লটও ছিল।
কনের সাথে চ্যাপেলে প্রবেশ করে পাত্র পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে থাকে সাধারণত তার বাবা। তবে মেগানের বাবা থমাস মার্কেল অসুস্থতার কারণে এ বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তাই সে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রিন্স হ্যারির বাবা প্রিন্স চার্লস। প্রিন্স চার্লসের সাথে চ্যাপেলের করিডোর ধরে এগিয়ে যান কনে।
প্রায় ৬০০ অতিথি ও ব্রিটেনের রাণীর সামনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। কনের মুখে মিষ্টি হাসি দেখা গেলেও প্রিন্স হ্যারিকে কিছুটা আবেগপ্রবণ হতে দেখা যায়। তবে বিয়ের শপথে স্বামীকে ‘মান্য’ করে করে চলার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেননি বধু মেগান মার্কেল। অপরদিকে রাজকীয় ঐতিহ্য ভঙ্গ করে প্রিন্স হ্যারি তার হাতে আংটি পরেন। বরের আংটিটি প্লাটিনামের হলেও কনের আংটি ওয়েলসের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি।
বিয়ের পরে তাদেরকে ডিউক ও ডাচেস অব সাসেক্স বলা হবে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলে চ্যাপেলের সিঁড়িতে নববধুকে চুম্বন করেন প্রিন্স হ্যারি। এরপর যুগলটি ঘোড়ার গাড়িতে করে উইন্ডসর চক্কর দিলে হাজার হাজার দর্শক তাদের অভিবাদন জানায়। পরবর্তীতে একটি জাগুয়ার গাড়িতে করে নবদম্পতি তাদের রিসেপশনে হাজির হন।
বিয়ের সাজ-পোশাক
মেগানের ধবধবে সাদা বোট-নেকের বিয়ের পোশাকটি ব্রিটিশ ডিজাইনার ক্লেয়ার ওয়েইট কেলারের ডিজাইন করা। সিল্কের তৈরি পোশাকটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল এর সাথের স্বচ্ছ সুন্দর ভেইলটি। প্রায় ৫ মিটার লম্বা এই ভেইলটি পেছন থেকে ধরে তাকে হাঁটতে সাহায্য করে ক্ষুদে ব্রাইডসমেইড ও পেজবয়রা। সামনে থেকে স্বচ্ছ ভেইল দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছিলেন কনে।
হাতে এমব্রয়ডারি করা ভেইলটিতে ফুলেল নকশা করা ছিল, যা কমনয়েলথের ৫৩টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। ডিজাইনার খুব যত্ন সহকারে প্রতিটি দেশ থেকে ফুল বাছাই করেছেন। মেগান মার্কেল তার পছন্দের দুটি ফুলও এতে যুক্ত করেছেন।
কনের ভেইলটি সুন্দর করে মাথায় ধরে রাখা ছিল একটি হীরার তৈরি টিয়ারা তথা ছোট্ট মুকুটের মাধ্যমে। টিয়ারাটি রাণী মেরির, যা বর্তমান রাণী এলিজাবেথ তাকে বিয়ে উপলক্ষ্যে পরতে দেন। টিয়ারাটির মধ্যে ১০টি হীরার তৈরি একটি ব্রুচ রয়েছে, যা রাণী মেরিকে ১৮৯৩ সালে তার বিয়েতে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে ব্রুচটি টিয়ারাতে স্থাপন করা হয়। এছাড়াও টিয়ারাটিতে আরও হীরা ও প্লাটিনাম রয়েছে।
গহনা হিসেবে কনে শুধু কানে হীরের ছোট দুল ও হাতে একটি ব্রেসলেট পরেছিলেন। গহনার মতো মেকাপেও ছিল না কোনো আধিক্য। চুলগুলো পেছনে খোপা করে রেখেছিলেন তিনি। ছিমছাম সাজে সাধারণ বেশেই অসাধারণ ছিলেন এই নতুন রাজবধূ।
প্রিন্স হ্যারি তার ভাইয়ের সাথে মিলিয়ে পরেছিলেন ব্লুস অ্যান্ড রয়ালস এর ফ্রককোট ইউনিফর্ম। এ ধরনের ইউনিফর্মের সাথে দাড়ি রাখা নিয়ম নয় বলে ছোট দাড়ি রাখতে তাকে রাণীর বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে।
বিয়ের অতিথিবৃন্দ
বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অনেক বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, খেলোয়াড়, গায়ক-গায়িকা এবং অন্যান্য রাজ পরিবারের সদস্যবৃন্দ। অন্যান্যদের মধ্যে জর্জ ক্লুনি ও তার স্ত্রী আমাল ক্লুনি, অপরাহ উইনফ্রে, স্যার এল্টন জন, ডেভিড ও ভিক্টোরিয়া ব্যাকহেম, সেরেনা উইলিয়ামস, জেমস করডেন, জেমস ব্লান্ট, ক্যারি মুলিগান, জনি উইল উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন স্যুটস সিরিয়ালে তার সহ অভিনেতা প্যাট্রিক জে অ্যাডামস। স্যুটসের অন্যান্য সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও বিয়ে উপলক্ষ্যে ব্রিটেনে ভ্রমণ করেছেন।
আরও উপস্থিত ছিলেন আর্ল স্পেন্সার, ডাচেস অব ইয়োর্ক সারাহ ফার্গুসন, ডাচেস অব কেমব্রিজ কেটের বোন পিপ্পা, প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার বোন জেন প্রমুখ। তবে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান না বলে সেখানে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সহ অন্যান্য রাজনীতিবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
তবে চ্যাপেলে উপস্থিত ৬০০ অতিথি ছাড়াও জনসাধারণের মধ্যে থেকে প্রায় ১২০০ জনকে উইন্ডসর ক্যাসেলের প্রাঙ্গনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যাদের অনেকেই দাতব্য কাজের জন্য সুপরিচিত।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের শিথিলতা
প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেলের বিয়ে শুধু রাজকীয় বিয়ে বলেই এত আলোচিত নয়। মেগান মার্কেলের ব্রিটিশ রাজ পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সেখানে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। রাজ পরিবারের কথা শুনলেই মনে হয় তাদের উচ্চাভিলাষী জীবন ও যা খুশি তাই করার ক্ষমতার কথা। তবে সেটি সব সময় সত্য নয়। রাজ পরিবারের সদস্যদের মেনে চলতে হয় নানা ধরনের নিয়ম কানুন। এর হেরফের হলে তাদের রাজকীয় উপাধি হারাতে হয়, এমনকি হাতছাড়া করতে হয় রাজমুকুটও।
এর আগে ১৯৩৬ সালে অষ্টম এডওয়ার্ড একজন তালাকপ্রাপ্ত মার্কিন মেয়ে ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করার জন্য তাকে রাজমুকুট বিসর্জন দিতে হয়। ১৯৫০ সালে বর্তমান রাণী এলিজাবেথের বোন প্রিন্সেস মার্গারেটকেও তার রাজউপাধি বজায় রাখতে ভালবাসার মানুষটিকে ছেড়ে দিতে হয়।
কিন্তু প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেলের বেলায় এ ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি। মেগান মার্কেল একজন মার্কিন অভিনেত্রী। তিনি একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী এবং জাতিগতভাবেও মিশ্রগোত্রের। এমনকি তিনি প্রিন্স হ্যারির চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড়। তারপরেও হ্যারির এ প্রেয়সীকে স্বানন্দে নিজেদের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে ব্রিটিশ রাজ পরিবার। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে রাজ পরিবারের রক্ষণশীলতা থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসা বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে অভিনয় জগতকে চিরতরে বিদায় জানাতে হয়েছে মেগানকে। বিয়ের অনুষ্ঠানের পরপরই তিনি অভিনয় থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণাটি দেন।
Featured Image Source: USA Today