সাবেক গুপ্তচরকে হত্যাচেষ্টার সূত্র ধরে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। মূলত ইংল্যান্ডের সাথে শুরু হওয়া এ কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোতেও। এখন পর্যন্ত ২৮টি দেশ মোট ১৫২ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। কেউ কেউ এটাকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বলেও অভিহিত করছেন। কিন্তু কেন ঘটছে এ গণবহিষ্কারের ঘটনা, কোথা থেকে ঘটনার শুরু, আর ভবিষ্যতেই বা কী হতে পারে?
ঘটনার পটভূমি
গত ৪ মার্চ ইংল্যান্ডের সলসবারিতে সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তার মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপালের উপর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নোভিচক প্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সের্গেই স্ক্রিপাল ছিলেন রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী, জিআরইউর সদস্য, যিনি নব্বইয়ের দশকে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্সের হয়ে কাজ করা শুরু করেন।
স্ক্রিপাল ব্রিটেনে সক্রিয় কয়েক ডজন (মতান্তরে প্রায় তিনশত) রাশিয়ান এজেন্টের নাম, ঠিকানা, ছদ্মনাম, ফোন নাম্বার এবং অপারেশনের বিস্তারিত তথ্য ব্রিটেনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি ধরা পড়েন, তার বিচার এবং শাস্তির রায় হয়, কিন্তু ২০১০ সালে ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি ব্রিটেনেই ছিলেন। সের্গেই স্ক্রিপালের পরিচয়, তার গোয়েন্দা কর্মকান্ড এবং তার উপর বিষ প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে আমাদের এ লেখায়।
স্ক্রিপালের উপর রাসায়নিক বিষ প্রয়োগের ঘটনায় শুরু থেকেই ব্রিটেন রাশিয়াকে দায়ী করে। কারণ নোভিচক নামের এই বিশেষ রাসায়নিক পদার্থটি শুধুমাত্র রাশিয়ার কাছে আছে বলেই ধারণা করা হয়। ঘটনার পরপরই প্রমাণের অপেক্ষা না করেই ব্রিটেন ২৩ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াও ২৩ জন ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। কিন্তু পরিস্থিতি সেখানেই থেমে না থেকে বরং ছড়িয়ে পড়ে, যখন গত সপ্তাহে ইংল্যান্ড ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ব্রিটেনে অন্যান্য মিত্র দেশগুলো রাশিয়ান কূটনীতিকদেরকে বহিষ্কার করতে শুরু করে।
কোন কোন দেশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে?
গত ২৬ মার্চ সোমবার ইংল্যান্ডের প্রধান ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসাথে ৬০ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। তারা একইসাথে সিয়াটলে অবস্থিত রাশিয়ান কনস্যুলেটও বন্ধ করার ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পরই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কূটনীতিক বহিষ্কার করে রাশিয়ার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ইউক্রেইন। তারা ১৩ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেয়। কানাডা ৪ জনকে বহিষ্কার করে এবং আরো ৩ জনের নতুন নিয়োগ বাতিল করে। ফ্রান্স, জার্মানি এবং পোল্যান্ডও ৪ জন করে কূটনীতিক বহিষ্কার করে।
Today, @StateDept announced its decision to expel 60 Russian officials from the United States, including 48 serving at #Russia’s bilateral mission to the United States and 12 intelligence operatives from the Russian Mission to the @UN. https://t.co/hTFIDbyz4k pic.twitter.com/fr3D4oiYTx
— Department of State (@StateDept) March 26, 2018
এছাড়াও লিথুয়ানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র ও মলডোভা ৩ জন করে, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, ডেনমার্ক, স্পেন, আলবেনিয়া ও অস্ট্রেলিয়া ২ জন করে এবং এস্তোনিয়া, ল্যাটভিয়া, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি, সুইডেন, নরওয়ে, মেসিডোনিয়া, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও মন্টিনিগ্রো ১ জন করে রাশিয়ান কূটনীতিক বহিষ্কার করে।
এর বাইরে ন্যাটো তাদের ৭ জন রাশিয়ান প্রতিনিধির সদস্যপদ খারিজ করেছে এবং আরো নতুন ৩ জনের সদস্যপদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়াতে তাদের স্থায়ী প্রতিনিধি দলের প্রধানকে এবং পোল্যান্ড, ল্যাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া তাদের রাষ্ট্রদূতদের রাশিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
কেন কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হচ্ছে?
রাশিয়ান কূটনীতিকদের বহিষ্কারের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে একটি হুঁশিয়ারি বার্তা প্রদান করা। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র সারাহ স্যান্ডার্সের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে এই বার্তা দিতে চায় যে, প্রতিটি কর্মেরই ফলাফল আছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই, যারা ১ বা ২ জন করে রাশিয়ানকে বহিষ্কার করেছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য হতে পারে সংগঠনটির অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা।
Today’s extraordinary international response by our allies stands in history as the largest collective expulsion of Russian intelligence officers ever & will help defend our shared security. Russia cannot break international rules with impunity
— Boris Johnson (@BorisJohnson) March 26, 2018
এছাড়াও ব্রিটেন এবং আমেরিকা বহিষ্কৃত কূটনীতিকদেরকে অঘোষিত গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের মতে, ‘গোয়েন্দা কর্মকর্তা’দেরকে বহিষ্কারের ফলে রাশিয়ার গোয়েন্দা তৎপরতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা পুষিয়ে উঠতে তাদের বহু বছর সময় লাগবে।
এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্তে রাশিয়ার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইংল্যান্ড তাদের মিত্র দেশগুলোকে অভূতপূর্ব পর্যায়ের গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে। এ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই অন্যান্য রাষ্ট্র বিশ্বাস করেছে যে, রাশিয়াই রাসায়নিক হামলার জন্য দায়ী। সে কারণেই তারাও রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইংল্যান্ডের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া কী?
‘Did all these European countries stand up and expel American diplomats for the invasion of Iraq? Of course not’ – Peter Kuznick to RT https://t.co/CSQET15mII
— RT (@RT_com) March 28, 2018
স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া তাদের কূটনীতিকদের বহিষ্কারের বিষয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করেছে। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে ভুল বলে আখ্যায়িত করে বলেন, রাশিয়ার এবং আমেরিকার মধ্যে যে সামান্য সম্পর্ক অবশিষ্ট আছে, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমেরিকা সেটাও ধ্বংস করে দিয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াতে অবস্থিত কোন মার্কিন কন্সুলেট বন্ধ করে দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে ভোট দেওয়ার জন্য রাশিয়ার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের টুইটার পেজ থেকে টুইটার ব্যবহারকারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্মিলিত এ ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল চাপ এবং ব্ল্যাক মেইলের কারণে ঘটেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাহারোভা বলেছেন, যে রাষ্ট্রগুলো তাদের কূটনীতিকদেরকে বহিষ্কার করেছে, রাশিয়া তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তিনি স্ক্রিপালের উপর রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের পেছনে রাশিয়ার ভূমিকার কথা অস্বীকার করে পাল্টা ব্রিটেন এবং আমেরিকাকে দায়ী করেন।
পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে?
রাশিয়ার সাথে দীর্ঘদিন ধরেই ব্রিটেনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। সিরিয়া এবং ইউক্রেন প্রসঙ্গে দেশ দুটির অবস্থান পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপরীতে। সের্গেই স্ক্রিপালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটতে পারে।
গত ১৯ মার্চ রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংস্থা, OPCW এর প্রতিনিধিরা স্ক্রিপালের উপর প্রয়োগকৃত রাসায়নিক পদার্থের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এছাড়াও ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যদি তদন্তে এবং গবেষণাগারের পরীক্ষায় রাশিয়ার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়, তাহলে ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে।
Russia’s ambassador to Australia, Grigory Logvinov, rejects claims that the Kremlin is behind the nerve agent attack on Sergei Skripal and warns of a new Cold War pic.twitter.com/FKY9MYNlCo
— TRT World Now (@TRTWorldNow) March 28, 2018
ব্রিটেন ইতোমধ্যেই ২৩ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। এ সংখ্যা হয়তো আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। রাশিয়ান নাগরিকদের ইংল্যান্ডের ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে। ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য মিত্র রাষ্ট্র রাশিয়ান নাগরিক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর অবরোধ আরোপ করতে পারে এবং চিহ্নিত কিছু ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
তবে এ ধরনের অবরোধ আরোপ করলে রাশিয়ার পাশাপাশি ইংল্যান্ডের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেক্ষেত্রে ইংল্যান্ড হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে রাশিয়ার উপর সামগ্রিক অবরোধ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। তবে ব্রেক্সিটের কারণে ইংল্যান্ডের পক্ষে এরকম পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। রাশিয়াও চাইবে এ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে।
এ বছরের জুন মাস থেকে রাশিয়াতে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের উপর এ ঘটনার তেমন কোনো প্রভাবের লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি। অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ বিশ্বকাপ বর্জন করতে পারে, এরকম সংবাদ শোনা গেলেও অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করেছেন। ইংল্যান্ড, আইসল্যান্ড এবং পোল্যান্ডের কর্মকর্তারা বিশ্বকাপে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিলেও খেলায় অংশগ্রহণকারী দলগুলো কেউ এখনও খেলা বর্জনের ঘোষণা দেয়নি।
ফিচার ইমেজ- Youtube