দীর্ঘ ৭০ বছরের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সৌদি আরব প্রথমবারের মতো নিজেদের আকাশসীমা ইসরায়েলগামী প্লেনের জন্য উন্মুক্ত করল। গত বৃহস্পতিবার থেকে ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া সৌদি আকাশ সীমা ব্যবহার করে নয়া দিল্লি থেকে তেল আবিব পর্যন্ত সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট চালু করেছে। চলুন জেনে নিই কেন এ সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ? ঠিক কী ঘটেছে? আর ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে?
কীভাবে সৌদি আরবের আকাশ সীমা উন্মুক্ত হয়েছে?
🇮🇳✈️🇮🇱 Air India’s inaugural Delhi-Tel Aviv flight has now entered Saudi Arabian airspace. #AI139 is the first commercial flight in 7 decades to fly over Saudi Arabia en route to Israel.⁰⁰
📡
https://t.co/x5ov2kEcJN pic.twitter.com/DkjtFYg3OR— Flightradar24 (@flightradar24) March 22, 2018
ইসরায়েল সৃষ্টির পর থেকেই অধিকাংশ আরব এবং মুসলিম প্রধান দেশের মতো সৌদি আরবের আকাশ সীমাও ইসরায়েলের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। শুধু ইসরায়েলি এয়ারলাইনের জন্যই না, বরং ইসরায়েলগামী অথবা ইসরায়েল থেকে আগত যেকোনো দেশের ফ্লাইটের জন্যই বলবৎ ছিল এ নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ভারতের জাতীয় এয়ারলাইন্স এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই ১৩৯ আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিষেধাজ্ঞার সমাপ্তি ঘটিয়ে নয়া দিল্লি থেকে সৌদি আকাশ সীমার উপর দিয়ে তেল আবিবের বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছেছে।
মার্চ মাসের শুরুর দিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু সর্বপ্রথম জানিয়েছিলেন যে, ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া ইসরায়েলে যাতায়াতের জন্য সৌদি আকাশ সীমা ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছে। এর পরদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও একই তথ্য নিশ্চিত করেন। প্রাথমিকভাবে সৌদি আরব সংবাদটিকে মিথ্যা বলে দাবি করলেও পরবর্তীতে জানা যায়, আসলেই তা সত্য ছিল।
Air India launches non-stop flight from Delhi to Tel Aviv. Flight AI139 took off from Indira Gandhi Intl Airport at 1800 hrs & will arrive at the Ben Gurion International Airport at Tel Aviv at 2145 hrs. pic.twitter.com/Wmna4ibvjd
— Sidhant Sibal (@sidhant) March 22, 2018
এই অনুমতির পূর্ব পর্যন্ত ভারত থেকে ইসরায়েলে যাওয়া আসার জন্য সৌদি আরবকে এড়িয়ে লোহিত সাগরের উপর দিয়ে ঘুরে যেতে হতো। এখন সৌদি আরবের উপর দিয়ে যাওয়ার ফলে যাত্রাকালীন সময় দুই ঘন্টা হ্রাস পাবে, জ্বালানী ব্যবহারও অনেক কমে আসবে, ফলে যাতায়াতের খরচও অনেক হ্রাস পাবে। এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনটি বৃহস্পতিবার ভারত সাগর থেকে ওমান হয়ে সৌদি আরবের উপর দিয়ে জর্ডান এবং পশ্চিম তীরের উপর দিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করে। সৌদি আরবের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় প্লেনটি রাজধানী রিয়াদে থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল।
ইসরায়েলের যোগাযোগমন্ত্রী ইসরায়েল কাট্জ ঘটনাটিকে ঐতিহাসিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এটি হচ্ছে প্রথম ঘটনা, যেখানে সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হলো।
আর কোন কোন দেশের আকাশ সীমা ইসরায়েলের জন্য বন্ধ?
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে মিসর, জর্ডান এবং তুরস্ক বাদে অন্য কোনো দেশের সাথেই ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ফলে এসব দেশ তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করে ইসরায়েলে যাওয়া আসা করার অনুমতি দেয় না। দেশগুলো হলো: আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ, ব্রুনেই, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মরক্কো, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন।
এর মধ্যে সৌদি আরব সম্প্রতি ব্যতিক্রম উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া আরেকটি ব্যতিক্রম হলো সুদান, যারা শুধুমাত্র ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সকে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করে আদ্দিস আবাবা থেকে তেল আবিবে আসা যাওয়া করার অনুমতি দেয়। তবে এর বাইরে ইসরায়েলের বা অন্য যেকোনো দেশের এয়ারলাইন্সের জন্য সুদানের আকাশসীমা ব্যবহার করে ইসরায়েলে যাওয়া আসা নিষিদ্ধ।
কেন সৌদি আরব আকাশ সীমা উন্মুক্ত করেছে?
সৌদি আরবের এ সিদ্ধান্ত একদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফল কূটনীতির একটি উদাহরণ। গত বছর প্রথম কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইসরায়েল ভ্রমণ করেছিলেন। সে সময়ই তিনি ইসরায়েলের সাথে এ ব্যাপারে প্রথম আলাপ করেন। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দখলকৃত পশ্চিম তীর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তার ইসরায়েল ভ্রমণের কিছুদিন পরেই সৌদি আরব এয়ার ইন্ডিয়াকে সৌদি আকাশ সীমা ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
অন্যদিকে বৃহত্তর পরিসরে সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তটি সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের পরিবর্তিত রাষ্ট্রনীতিরই একটি প্রতিফলন। সৌদি আরবের যুবরাজ হিসেবে প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের নাম ঘোষণার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের সাথে দেশটির সম্পর্ক পূর্বের তুলনায় অনেক শক্তিশালী হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুও স্বীকার করেছেন, দেশটির সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক এখন সবচেয়ে ভালো।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ইরানকে তার সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানের শক্ত অবস্থানের কারণে সৌদি আরবও ইরানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ইরানের প্রতি উভয়ের সাধারণ শত্রুতা থেকেই দেশ দুটির মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছে বলে ধারণা করা হয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেও তার কূটনীতিকদেরকে ইরান এবং হেজবুল্লাহ’র বিরোধিতার ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে সমর্থন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ভবিষ্যতে আর কী ঘটতে পারে?
IMAGE: Saudi Arabia opened its airspace for the first time to a commercial flight to Israel, as an Air India aircraft flew from New Delhi to Tel Aviv. pic.twitter.com/HowHOAh0ct
— The Spectator Index (@spectatorindex) March 22, 2018
সৌদি আরব আপাতত শুধু এয়ার ইন্ডিয়াকেই ইসরায়েলে যাওয়ার সময় নিজেদের আকাশ সীমা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ইসরায়েলের এয়ালাইন্সের জন্য এখনও দেশটির আকাশ সীমা নিষিদ্ধই আছে। তবে ভবিষ্যতে হয়তো ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশের এয়ারলাইন্সকেও অনুমতি দেওয়া হতে পারে। ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের জাতীয় এয়ারলাইন্স এল আল জানিয়েছে, তারাও সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে ভারতে বিমান চলাচল চালু করার ব্যাপারে আগ্রহী।
ইসরায়েলের যোগাযোগ মন্ত্রীও আল এলের অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। তার মতে, সৌদি আরব কাউকেই অনুমতি দিতে চায়নি। কিন্তু এখন যেহেতু তারা ভারতকে অনুমতি দিয়েছে, আশা করা যায় শেষ পর্যন্ত তারা ইসরায়েলকেও অনুমতি দিবে। তিনি আরো জানান, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এবং ফিলিপিন্সের একটি এয়ারলাইনের সাথে তাদের আলাপ চলছে, যেন তারাও সৌদি আরবের আকাশসীমা ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারে।
ভারত থেকে ইসরায়েলে যাওয়ার সময় সৌদি আরবে প্রবেশের পূর্বে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনটিকে ওমানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে হয়েছিল। ওমান আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও এ ঘটনার মাধ্যমে সৌদি আরবের পাশাপাশি ওমানও কার্যত তাদের আকাশ সীমাকে ইসরায়েলে যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করে দিল। সৌদি আরবের দেখাদেখি ভবিষ্যতে বাহরাইন, কুয়েত, আরব আমিরাত সহ অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রও হয়তো একই পথ অনুসরণ করতে পারে।
ফিচার ইমেজ- AFP