কার্টুন আঁকা টি-শার্টটির মতো গোলগাল মুখখানাও ধুলো মাখা, রক্তে সিক্ত। রোবোটের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে অ্যাম্বুলেন্সের চেয়ারে, চোখে নেই কোনো অশ্রু, মুখে নেই কোনো শব্দ, মনে অজানা ত্রাস। নিষ্পলক-নিস্পৃহ দৃষ্টিতে সে যেন প্রতি মুহূর্তে বিদ্ধ করছিলো বিশ্ব মানবতাকে। একটি আওয়াজ বা চোখের জল না ফেলেই রাজ্যের অভিযোগে মনুষ্যত্বকে কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছিলো শিশুটি। এক ছবিতেই তাকে চিনেছিলো গোটা বিশ্ব। লেখাটি যারা পড়ছেন, সম্ভবত তাদের কারোরই দৃষ্টি এড়ায়নি সেই ছবি। বলছি সিরিয়ার আলেপ্পোর সেই শিশু ওমরান দাকনীশের কথা।
সিরিয়ার বিদ্রোহী দখলকৃত শহর আলেপ্পোতে বিদ্রোহীদের ওপর আসাদ সমর্থিত সরকারি সেনা ও রাশিয়ান সহায়তাকারী বাহিনীর যৌথ বিমান হামলার শিকার হয়েছিলো তিন বছর বয়সী ওমরান। বিধ্বস্ত ভবন থেকে তাকে আহত অবস্থায় স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার করে আনে। অ্যাম্বুলেন্সের চেয়ারে বসা ওমরানের কিছু ছবি সেদিনই গণমাধ্যমের কল্যাণে চাউর হয়ে যায় বিশ্বময়। কে সেই ওমরান? কী হয়েছিলো তার সাথে? কেমন আছে সে এখন? সে উত্তরই খুঁজবো আজকের লেখায়।
রক্তাক্ত হবার সেই ভয়াবহ দিন
২০১৬ সালের ১৮ আগস্টের কথা। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো এমনিতেই যুদ্ধে ভঙ্গুর। আলেপ্পোর কোর্টজিতে ওমরানের পরিবার যে ভবনে থাকতো, তার কাছের একটি ভবনেই ছিলো সিরিয়ার সরকার বিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপের একটি ঘাঁটি। সেখানে সরকারি বাহিনীর বিমান হামলায় বিধ্বস্ত হয় ওমরানদের ভবন। ওদিকে সরকারি বাহিনীর পাল্টা প্রতিরোধের মুখে গোলাগুলিও শুরু হয়। এতে প্রাণ হারায় তিনজন, আহত হয় ১২ থেকে ১৫ জন। হামলার সময় প্রাণ নিয়ে যে যেভাবে পারে, ছুটে পালাচ্ছিলো। বাবা-মা’র থেকে এভাবেই আলাদা হয়ে পড়ে ওমরান। এক ঘন্টা ভবনের ভেতর আটকা থাকার পর তাকে উদ্ধার করে হোয়াইট হেলমেট নামের সিরিয়ান উদ্ধারকর্মীরা।
অ্যাম্বুলেন্সে ও হাসপাতালে নেওয়ার পরও চোয়াল শক্ত করে নির্বিকার বসে ছিলো শিশু ওমরান। তাকে দেখে একরকম ঘাবড়েই গিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তারা ভাবছিলেন, ওমরান হয়তো মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পেয়ে থাকতে পারে। তবে তার বাহ্যিক আঘাত গুরুতর না হওয়ায় কয়েকটা ব্যান্ডেজ লাগিয়েই আশঙ্কামুক্ত হয় তার অবস্থা। আবু রাজীব নামক সিরিয়ান-আমেরিকান মেডিকেল সোসাইটির এক সদস্য বলেন,
“শিশুটি একদম চুপ ছিলো আর বাবা-মাকে খুঁজছিলো ইতিউতি দৃষ্টিতে। তাদের দেখার আগ পর্যন্ত একটুও কান্না করেনি শিশুটি। নিথর হয়ে বসেছিল। মানুষ ঘুমিয়ে থাকলে যেমন অচেতন মনে হয়, তাকেও অনেকটা সেরকম লাগছিলো, সেই সাথে ভীত-সন্ত্রস্ত।”
ভবনটিতে বাস করা ওমরানের পরিবারের পাঁচ সদস্যই হামলার সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ওমরানের বড় ভাই আলি এই হামলায় নিহত হয়। মোটামুটি অক্ষত বাকি সদস্যরা হাসপাতালে পরবর্তীতে ওমরানকে খুঁজে পায়।
পার্সন অব দ্য ইয়ার, ২০১৬
২০১৭ সালের ৭ জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার ২০১৬ সালের ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ জরিপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে শিশু ওমরান। আল-জাজিরা আরবি সার্ভিসের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, তাদের ফেসবুক জরিপে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ অংশ নেয়। এরদোয়ান মোট ভোটের ৪০ শতাংশ পেয়ে ২০১৬ সালের ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ খেতাবে ভূষিত হন। ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সিরিয়ান শিশু ওমরান দাকনীশ ছিলো তার পরেই। ২০১৬ শেষভাগের পুরোটা সময় জুড়ে সামাজিক গণমাধ্যম সহ অনলাইন দুনিয়ার তাবৎ আলোচনার অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিলো ওমরান। খুব বেশি তথ্য তার সম্পর্কে কেউই তখন জানতে পারেনি, জানা সম্ভব হয়নি। তারপরও ওমরান এতটা আলোচিত, কেবল সেই বিবেক নাড়িয়ে দেওয়া ছবিটির জন্যই।
ওমরানের জন্য ওবামাকে চিঠি
যেখানে বিশ্ববাসীর মন গলে গেছে মোমের মতো, সেখানে ফুলের মতো নরম শিশুর মন গলবে না, তা তো হয় না। ওমরানের সেই ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত স্তব্ধতার ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিলো আমেরিকার ছয় বছরের শিশু অ্যালেক্সকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে চিঠি লিখে বসলো সে। প্রিয় প্রেসিডেন্টের কাছে আবদার জানালো খেলার সাথী হিসেবে ওমরানকে তার কাছে এনে দেবার। সেই চিঠি পড়ে ওবামা এতটাই আপ্লুত হলেন যে, হোয়াইট হাউজের অফিশিয়াল টুইটার পাতায় পোস্ট করলেন সেই চিঠির চুম্বকাংশ-
“প্রিয় প্রেসিডেন্ট ওবামা, সিরিয়ায় অ্যাম্বুলেন্সে বসা সেই ছেলেটির কথা মনে আছে? আপনি কি তাকে আনতে যাবেন? আমার বাড়িতে নিয়ে আসবেন? আমরা আপনাদের জন্য পতাকা, ফুল, বেলুন নিয়ে অপেক্ষায় থাকবো। আমরা তাকে একটি পরিবার দেবো, আর সে আমাদের ভাই হবে।”
চিঠিটি পাঠরত অবস্থায় অ্যালেক্সের একটি ভিডিও-ও “তোমার জন্য গর্বিত” ক্যাপশন দিয়ে শেয়ার করেছিলেন ওবামা। বিশ্বময় ভাইরাল হওয়া আবেগে টইটুম্বুর সেই চিঠির কয়েকটি বাক্য ছিলো এমন-
‘‘আমার ছোট বোন ক্যাথেরিন ওমরানের জন্য প্রজাপতি আর জোনাকি ধরে নিয়ে আসবে। স্কুলে ওমর নামে আমার একজন সিরিয়ান বন্ধু আছে। আমি ওকে ওমরের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেবো। আমরা একসঙ্গে খেলবো। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দেবো। সে ওদের ভাষা আমাদের শেখাবে। আমরাও তাকে ইংরেজি শেখাবো, যেমনটা আমার জাপানী বন্ধুটিকেও শিখিয়েছি।”
আবার আলোচনায় এলো ওমরান!
২০১৬ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে অনলাইন দুনিয়ায় পুনরায় আলোড়ন তোলে শিশু ওমরান। বিধ্বস্ত-রক্তাক্ত ওমরানের পরে কী হয়েছিলো, তা জানতে পৃথিবী কতটা উদগ্রীব ছিলো, তা বোঝা গেলো তার নতুন প্রকাশিত ছবিগুলোকে গণমাধ্যমের লুফে নেওয়া দেখে। পরিবারের সাথে হাস্যোজ্জ্বল সময় কাটানো অবস্থায় ওমরান দাকনীশের কয়েকটি ছবি ও ভিডিও গত বছরের মাঝামাঝি ভাইরাল হয়। সেখানে খয়েরি চুলো ওমরানের স্বাস্থ্যবান গোলগাল-গোলাপী মুখ দেখে বিশ্ববাসী আক্ষরিকভাবেই পুলকিত হয়েছিলো। সকলেই যেন আশ্বস্ত হলো। যাক, ওমরান সুস্থ আছে, ভালো আছে!
তবুও হীরকের রাজাই ভগবান?
টুইটারসহ গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশের পর গত জুনে ওমরানের পরিবারের বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারের ভিডিও প্রকাশিত হয়। বেশিরভাগ প্রকাশিত ভিডিওতেই কথা বলেছেন তার বাবা। একটি ভিডিওতে ওমরানের বাবা দাবি করেন, তার ছেলের ছবি ও ঘটনাকে প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বমিডিয়া চাইছে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের বৈধতা আরোপ করতে!
পূর্ব আলেপ্পোর অনেকের মতোই ওমরানের পরিবারও সরকারের অনুগত এবং পুরো অচলাবস্থা জুড়ে তেমনটাই ছিলেন। ওমরানের এই ঘটনাটির পর অনেক গণমাধ্যমই তাদের সাক্ষাৎকার নিতে চাইলেও তারা সকলকে মানা করে দেন এবং পশ্চিম আলেপ্পোয় একরকম গা ঢাকা দেন।
গত জুনের প্রথম সপ্তাহে সেখানকার সরকার সমর্থক সিরিয়ান সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলেন ওমরানের বাবা মুহাম্মাদ খাইর দাকনীশ। সেসব সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন সিরিয়ার সরকার সমর্থক ইরান, রাশিয়া ও লেবাননেরও কিছু সাংবাদিক। তাদের উদ্দেশ্যে ওমরানের বাবা বলেন, “তারা (গণমাধ্যম) হীন উদ্দেশ্যে আমার ছেলের রক্তমাখা মুখের ছবি নিয়ে ব্যবসা করছে।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের ভুক্তভোগী হবার দায় কেবলই ঐ অস্ত্রধারীদের। আলহামদুলিল্লাহ, ওমরান তেমন গুরুতর আহত হয়নি। সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, তারা উদ্ধার করেছিলো বলেই আজকে আমরা নিজেদের বাড়িতে। এখন সব স্বাভাবিক। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।”
অন্যদিকে সিরিয়ার সরকারি গণমাধ্যমে সামা-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খাইর দাকনীশ দাবি করেন, তাকে নাকি বিদ্রোহী কমান্ডার মুহাম্মাদ ফাত্তেহ তুরস্কে পাঠাবার প্রলোভন দেখিয়ে গণমাধ্যমের কাছে সিরিয়ান বাহিনীর নিন্দা করতে বলেছিলেন। তবে মি. দাকনীশ তা করলেন না কেন? তার সাফ জবাব, “আমি আমার দেশকে ভালোবাসি।”
ওমরানের পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষে ফেসবুকে তাদের নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়েছেন সরকার-সমর্থক হিসেবে পরিচিত সিরিয়ান সাংবাদিক কিনানা আলাউশে। ওমরানের ছবি ভাইরাল করে সিরিয়ান আর্মিকে ‘বিতর্কিত’ করবার জন্য তিনি সেই ফেসবুক পোস্টে খোঁচা দেন বিশ্ব গণমাধ্যমকে। ক্যাপশনে তিনি লেখেন-
“এখানেই এখন সে (ওমরান) বাস করছে, তার আর্মির সাথে, তার নেতা ও জনগণের সাথে।”
সম্পূরক তথ্য হলো, এই কিনানা এর আগেও হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলেন, সিরিয়ার এক বিদ্রোহীর লাশের সাথে। বলা বাহুল্য, বিতর্কিতই হয়েছিলেন সেই বেলা। অন্যদিকে ভ্যালারি জিবালা নামের একজন সাংবাদিক ও সিরিয়া ইনস্টিটিউটের গবেষক আবার থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের কাছে একটি সন্দেহ জানিয়েছেন। তার ধারণা, ওমরানের পরিবারকে সরকারের পক্ষে কথা বলতে বাধ্য করা হয়ে থাকতে পারে। কেননা বিদ্রোহীদের সরিয়ে দেবার পর আলেপ্পো আবার সরকারের নিয়ন্ত্রণে, যাদের বিরোধীদের মতো শক্ত হাতে দমন করবার কুখ্যাতি আছে। এদিকে সিরিয়ার সরকারের মিত্র রাশিয়া বিমান হামলার দায় তো বটেই, আলেপ্পোয় সেদিন কোনো বিমান হামলার দাবিই নাকচ করে দিয়েছে।
তাহলে কি উপসংহার এমন দাঁড়াচ্ছে যে, ওমরানের আহত ও তার দশ বছর বয়সী ভাই আলির নিহত হবার জন্য কেউই দায়ী নয়?
ফিচার ইমেজ: bbc.com