দ্য মিন্টস: ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চার মোড়ল

২০০১ সালে ব্রিক্স শব্দটি সারা বিশ্বে খুব পরিচিতি লাভ করেছিল। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত (ইন্ডিয়া) এবং চীন- এই চারটি রাষ্ট্রের ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরি এই ব্রিক্স (BRICs) শব্দটি। অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল এ নামটি দেন। এই চারটি দেশকে তখন বলা হচ্ছিল বিশ্বের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস। এরপর জিম আরো চারটি রাষ্ট্র শনাক্ত করেন যারা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এই চারটি রাষ্ট্রকে একত্রে বলা হয় দ্যা মিন্ট। রাষ্ট্রগুলো হলো মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া এবং তুর্কি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ চারটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক দিক থেকে খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্রিক্সের এখনকার অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একমাত্র চীন ছাড়া বাকি রাষ্ট্রের প্রভাব আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাজারে অনেকটাই কমে গেছে। তাই বিনিয়োগকারীরা এখন মিন্ট রাষ্ট্রগুলোতে তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, সামনে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাজারে এই চারটি রাষ্ট্রের বিকাশ এবং ক্রমোন্নতি সবার গোচরে আসবে।

Image Source: capital moments

অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে কিনা সেটা বুঝতে হলে অর্থনীতির কিছু মৌলিক বিষয়ে ধারণা থাকা দরকার। না হলে সাধারণ মানুষ অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না আসলে কীসের উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বলা হচ্ছে। এই মৌলিক বিষয়গুলো খেয়াল করলে একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তির পরিচয়ও পাওয়া যায়। অর্থনীতিতে প্রধান প্রধান মৌলিক বিষয়গুলো হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ, মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index), জিডিপি, জনগণের চাহিদার সাথে রাষ্ট্রের যোগান, মুদ্রাস্ফীতির হার, একটি দেশের মুদ্রার এক্সচেঞ্জ রেট বা মুদ্রা বিনিময় হার ইত্যাদি। এখানে বিস্তারিতভাবে বিষয়গুলো আলোচনা করা হলো।

১) যদি একটি দেশের জন্মহার মৃত্যুহারের তুলনায় বেশী হয় তাহলে অর্থনীতিতে এর মানে দাঁড়ায়, সেই দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সেই দেশের উৎপাদন হার বাড়াতে সাহায্য করবে। উৎপাদন হার বেড়ে গেলে সেই দেশ আর্থিক দিক থেকে আরো বেশী সচল থাকবে। কিন্তু যদি এ বৃদ্ধির হার সেই দেশের জিডিপির হার থেকে বেশী হয় তাহলে আর্থিক উন্নয়নে বাঁধা চলে আসবে।

২) একটি দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেশী হলে তা ঐ দেশের কর্মক্ষম জনগণের সক্ষমতা এবং উৎপাদন ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। কারণ বেশি আয় মানেই বেশি বেশি সময় কাজ করা এবং অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা।

৩) মানব উন্নয়ন সূচক তিনটি নির্দেশকের উপর নির্ভরশীল: ১) জিডিপি বা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার, ২) লেখাপড়া এবং ৩) জীবন প্রত্যাশা। একটি রাষ্ট্রের মানব উন্নয়ন সূচক থেকে সেই রাষ্ট্রের মানুষদের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

8) কোনো একটি দেশের জিডিপির হার যত বেশী সেই দেশ তত বেশী উন্নয়নশীল।

৫) যেকোনো রাষ্ট্র তার দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার কমিয়ে রাখতে চায়।

৬) এগুলো ছাড়াও একটি দেশের উন্নতি এবং আর্থিক প্রগতি সম্পর্কে বোঝার আরেকটি ভালো উপায় হচ্ছে সেই দেশের জনগণ সন্তুষ্ট আছে কিনা সেটা বিচার করা। কারণ একটি দেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি পেলে খুব স্বাভাবিকভাবে তাদের কিছু কেনার বা ব্যবহারের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু অনেক সময় এরকম হতে পারে যে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্র যোগান দিতে পারছে না। তখন জনগণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হবে না।

অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল; Image Source: Manchester Evening News

উপরের আলোচনার সাথে মিলিয়ে মিন্ট রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এই চারটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যার পরিমাণ অনেক বেশি। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী এই চার রাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে কম জনসংখ্যা হচ্ছে তুরস্কের, প্রায় ৭৫ মিলিয়ন। সবচেয়ে বেশী আছে ইন্দোনেশিয়ায়, প্রায় ২৪২ মিলিয়ন। এসব রাষ্ট্রের জন্মহারও অনেক বেশী। তুরস্কে প্রতি ১ হাজার জনে জন্মহার ১৭ এবং নাইজেরিয়াতে প্রায় ৪১.৫।

মিন্ট দেশগুলোর সম্পদের দিকে যদি তাকানো হয় তাহলে লক্ষ্য করা যায়, মেক্সিকো এবং তুর্কির আয় প্রতি জনে প্রায় ১০ হাজার ডলার যা ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে ৩ হাজার ৫০০ ডলার এবং নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে দেড় হাজার ডলার। ব্রিক্স দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, রাশিয়া এবং ব্রাজিল– এই দুটি দেশ থেকে আয়ের দিক দিয়ে মিন্ট দেশগুলো পিছিয়ে থাকলেও ভারত এবং চীনের থেকে তেমন পিছিয়ে নেই, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েই আছে।

নাইজেরিয়া, মেক্সিকো এবং ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে; Image Source: bbc.com

উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ এবং সেগুলোর ব্যবহার ও বণ্টন- দুটোই এই চারটি দেশে প্রায় সমান হারে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে নাইজেরিয়াকে অনেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রথম ২০টি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল রাষ্ট্রগুলোর কাতারে দেখতে পাচ্ছে। এরকম মনে করার পেছনে অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন একমাত্র কৃষি খাত ছাড়া অন্যান্য প্রায় সকল খাতে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিরাপত্তা নিয়ে সেখানে কিছু উদ্বেগের কারণ থাকা সত্ত্বেও কিছু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেখানে তাদের ঘাটি তৈরি করছে এবং নিজেদের পণ্যের বাজার তৈরি করছে।

২০১৪ সালে নাইজেরিয়া এবং তুর্কির বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮%। ইন্দোনেশিয়া এবং মেক্সিকোর ক্ষেত্রে এ হার ছিল যথাক্রমে ৫.৭% এবং ৫.২%। মেক্সিকো ২০১৪ সালে কিছু অর্থনৈতিক নীতি এবং পরিমাপকাঠি ব্যবহার করেছিল যার কারণে তাদের মুদ্রাস্ফীতির হার তুলনামূলকভাবে কমে যায়। ২০১৪ সালের আগস্টে মেক্সিকো সরকার তাদের শক্তি বাজার অর্থাৎ তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি মুক্ত করে দেয়। এতে প্রাইভেট সেক্টরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সেই দেশের নিজস্ব পেট্রোলিয়াম ফার্মগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা এবং ব্যবসা করার সুযোগ পায়। এছাড়া মেক্সিকো সরকার সেসময় তাদের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। এতে করে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়ও উন্নতি দেখা দেয়।

২০১৪ সালে এই চারটি দেশে তাদের এক্সচেঞ্জ বা বিনিময় হার খাতে অনেক অস্থিরতা দেখা দেয়। ইন্দোনেশিয়ার মুদ্রা রুপিয়ার মূল্য প্রতি আমেরিকান ডলারে ১০,৬৮৫ থেকে ১১৪৫০ এ উঠে যায়। তুরস্কের মুদ্রা টার্কিশ লিরার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। এতে সমস্যা যেটা হয়, অনেক বেশী মূল্যে আমেরিকা থেকে এই দুটি দেশকে পণ্যদ্রব্য আমদানি করতে হয় এবং এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।

তুরস্কের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে তাদের টার্কিশ এয়ারলাইন্স; Image Source: bbc.com

এ রাষ্ট্রগুলোর সম্ভাব্য শক্তিশালী অর্থনৈতিক রাষ্ট্র হওয়ার বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। যেমন এ দেশগুলোতে তরুণ জনসংখ্যার হার বেশী। এ কারণে তাদের শ্রম বল অনেক শক্তিশালী। এসব রাষ্ট্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য আইনী জটিলতা কম, ভৌগোলিক অবস্থানও ব্যবসার জন্য অনুকূল। নাইজেরিয়ার রয়েছে নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ, জনবল এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংকিং কাঠামো, মেক্সিকোকেও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এ অঞ্চলের অর্থনীতি ২০০৮ সালের মন্দা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছে। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তাদের কর্মক্ষম জনবল। তাছাড়া মিন্ট রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বাইরের দেশে রপ্তানি করে আয় করে। নাইজেরিয়া, মেক্সিকো এবং ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। ইন্দোনেশিয়া এখন চীনে কয়লা রপ্তানি করার দিকে ঝুঁকেছে।

ইন্দোনেশিয়াকে অবকাঠামো নির্মাণে সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হতে হবে; Image Source: bbc.com

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনীতিতে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হতে নাইজেরিয়া এবং তুরস্কের জন্য খুব বেশী সমস্যা হবে না। নাইজেরিয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে। আর তুরস্কের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে তাদের টার্কিশ এয়ারলাইন্স যেটা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বর্ধমান বিমান সংস্থা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থেকে যায়, কারণ এ রাষ্ট্রের অনেক কিছু করতে হবে যদি তারা অর্থনীতিতে আরো শক্তিশালী হতে চায়। বিশেষ করে অবকাঠামো নির্মাণে তাদেরকে আরো অনেক দূর অগ্রসর হতে হবে। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের শক্তিধর প্রথম দশটি রাষ্ট্রের মধ্যে মিন্ট রাষ্ট্রগুলোর যেতে আরো ২০-৩০ বছর সময় লাগতে পারে।

ফিচার ইমেজ- LinkedIn   

Related Articles

Exit mobile version