বিখ্যাতদের জীবনী সবসময় অবিরত সফলতা বর্ণনা করে না। উত্থান-পতন ও বারবার ব্যর্থতার কথাই বেশি শোনা যায়। যারা খুব বেশি প্রতিভাবান হন, তাদের নিজের প্রতিও অনেক বেশি প্রত্যাশা থাকে এবং অনেক সময় তারা সেটা পূরণে ব্যর্থ হন। তাদের কাছে সে ব্যর্থতা অন্য সবকিছুর চাইতে অনেক বেশি কষ্টকর। লেখকদের ক্ষেত্রে ‘রাইটার’স ব্লক’ এমনই এক ব্যর্থতার নাম, এমনই এক অমানিশার আশ্রয়।
ইতিহাসের বিখ্যাত এমন অনেক লেখক ছিলেন যারা এই ঘোর আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছেন। কেউ হয়তো সে আঁধার কাটিয়ে আলোর মুখ দেখেছিলেন, বাকিদের পক্ষে তা-ও সম্ভব হয়নি। আজ আমরা এমন কিছু ইতিহাসবিখ্যাত লেখকের কথা জানবো, যারা চূড়ান্ত ‘রাইটার’স ব্লক’ এ ভুগেছিলেন। তাদের জীবনের বহু সম্ভাবনাময় দিন, এমনকি বছর কেটে গেছে কোনো সৃষ্টিশীলতা ছাড়াই।
১. স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (১৭৭২-১৮৩৪)
কবি কোলরিজ উইলিয়াম ওর্ডসওর্থের সাথে ‘লিরিকাল ব্যালাডস’ লিখেছিলেন। তার প্রায় সকল কবিতাই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লেখা হয়েছে। এর পরবর্তী সময়ে যেকোনো লেখার প্রতিই তার একপ্রকার অনীহা লক্ষ্য করা যায়। তার অবশিষ্ট জীবন তিনি আফিম সেবন করে কাটান। এসময় যদিও তিনি সমালোচনাধর্মী লেখা লিখে গেছেন, তবু তার নিজস্ব শৈলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটানো কবিতাগুলো বা যা তিনি সত্যিই লিখতে চাইতেন, তা আর লেখা হয়নি। তিনি সেক্ষেত্রে তার কলম পুরোপুরিই থামিয়ে দিয়েছিলেন। সমালোচক কোলরিজ বেঁচে রইলেও কবি কোলরিজের মৃত্যু হয়েছিল মৃত্যুরও বহু পূর্বে।
তার এক বন্ধু তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কেন তিনি আর আগের মতো লেখেন না। উত্তরে কোলরিজ বলেছিলেন যে ‘রাইটার’স ব্লক’ এ ভোগা লেখককে লিখতে বলা এবং প্যারালাইসিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ হবার জন্য তার দুই হাত একসাথে ঘষা একই কথা। এ থেকে বোঝা যায় তার অসহায়ত্বের মাত্রা কতটা বিস্তৃত ছিল। তিনি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছিলেন এই সমস্যাটির কাছে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, এর কোনো সমাধান নেই এবং এই ভাবনা থেকেই তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। অনুর্বরতা তার ক্ষেত্রে প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর কওরে গেছে কোলরিজের জীবনে, যিনি কিনা আজো বিখ্যাত হয়ে আছেন তার শক্তিশালী কাব্যিক লেখনীর জন্য। তিনি এই সমস্যাটিকে অভিহিত করতেন ‘এক অনির্দিষ্ট ও অবর্ণনীয় আতঙ্ক’ বলে।
৩২ বছর বয়সে তার জন্মদিনের পরের দিন নোটবুকে তিনি লিখেছিলেন, “So completely has a whole year passed, with scarcely the fruits of a month.—O Sorrow and Shame. . . . I have done nothing!”
জোসেফ মিশেল (১৯০৮-১৯৯৬)
১৯৪০-৫০ এর সময় জোসেফ মিশেল নিজেকে সেরা একজন কল্পকাহিনীলেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিউইয়র্ক শহরে তিনি ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে, নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনে তার সকল লেখা প্রকাশিত হতো। তার সর্বশেষ চরিত্রটি ছিল অপর এক লেখকের। জো গুল্ড, যাকে ‘প্রফেসর সী-গাল’ বলেও ডাকা হতো। প্রফেসর সী-গাল দাবি করেন যে ‘ওরাল হিস্টোরি’ হচ্ছে সবধরনের ইতিহাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ‘ওরাল হিস্টোরি’র মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তার সমসাময়িক মানুষ ও আশেপাশের সবকিছুর দৈনন্দিন জীবনকে লেখনীতে প্রকাশ করা। জোসেফ মিশেল অত্যন্ত আকর্ষণ বোধ করেন এই ব্যক্তিটির প্রতি। তিনি ‘জো গুল্ড’স সিক্রেট’ লেখেন, যাতে জানা যায় জো গুল্ড আসলে ওরাল হিস্টোরি বলে কিছু লেখেনইনি, তিনি যা লিখেছেন তা শুধুই তার প্রতিদিনের রুটিন। সকালে কখন উঠেছেন, উঠে কী কী করেছেন, কখন স্নান করেছেন- ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল তার ৯ কোটি শব্দ! তিনি মারা যাবার জোসেফ মিশেল বইটি লেখেন। প্রফেসর সী-গাল রাইটার’স ব্লক এ ভুগেছিলেন এবং তারই ফসল এই ‘রহস্য’টি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সী-গালের রহস্য সমাধানের পর জোসেফ মিশেলও একই সমস্যায় আক্রান্ত হন। অন্য কিছু লেখা তো দূরের কথা, তিনি এই বইটিও প্রকাশ করতে পারেননি। তার অন্য অপ্রকাশিত লেখার সাথে এটি সংগ্রহ করা হয় এবং ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। জোসেফ মিশেল ১৯৯২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, “জো গুল্ডের সাথে এত বছর কথা বলতে বলতে একভাবে সে আর আমি একই ব্যক্তি হয়ে গেছি”।
হারোল্ড ব্রডে (১৯৩০-১৯৯৬)
১৯৯১ সালে টাইম ম্যাগাজিন ‘রাইটার’স ব্লকের ৩০ বছর’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিলো লেখক হারোল্ড ব্রডেকে নিয়ে।
তিনি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের স্বনামধন্য ছোটগল্প লেখক, যার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য রানওয়ে সোল’ এর ঘোষণা ১৯৬০ সালে দেওয়া হয়। ছোটগল্পে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই লেখক, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ছোটগল্পের মাধ্যমেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু যখন তিনি লেখার ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে গিয়ে হাত দিলেন উপন্যাস রচনায়, তাকে জেঁকে ধরলো রাইটার’স ব্লক। তা-ও এমনই চূড়ান্ত রূপে, যা তার ৩০টি বছর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভরে দিয়েছিল। তিনি এই উপন্যাসটি নিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদী ছিলেন। এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখকের নিজের এত বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল যে তিনি সবার কাছে বইটি প্রকাশের আগেই অনেক বেশি আশা দিয়ে ফেলেন। কিন্তু আশানুরূপ কিছুই হয়নি।
বইটি প্রকাশিত হতে লাগে ৩০ বছর! কিন্তু ৩০ বছর ধরে তিনি লড়াই করে যান তার উপন্যাসটিকে একটি গতিময় পথে নিয়ে যেতে। ১৯৯১ সালে প্রকাশ পাওয়া ৮৩৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এই উপন্যাসটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করে সমালোচক মহলের কাছ থেকে, নেতিবাচক আলোচনাই বেশি ছিল। এই লেখক এইডসে আক্রান্ত ছিলেন এবং ১৯৯৬ সালে মারা যান। অসুস্থ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘দিস ওয়াইল্ড ডার্কনেস: দ্য স্টোরি অফ মাই ডেথ’।
হার্পার লি (১৯২৬-২০১৬)
যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ১৯৬০ সালে হার্পার লি লিখেছিলেন তার কালজয়ী উপন্যাস ‘হাও টু কিল অ্যা মকিংবার্ড’। লিখনশৈলী ও বইটির বিষয়ের তীব্রতার জন্য এটি ১৯৬২ সালে পুলিৎজার পুরষ্কার অর্জন করে। মোট ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই বই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটিই তার প্রথম ও শেষ সাফল্য। এরপর শুধু খরা আর খরা। প্রকাশিত প্রথম উপন্যাসেই খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছানো এই লেখিকা লেখেননি একটি উপন্যাসও। ২০১৫ সালে, তার ৮৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় ও সর্বশেষ উপন্যাস ‘গো সেট অ্যা ওয়াচম্যান’। এটি ‘হাও টু কিল অ্যা মকিংবার্ড’ এর আগেই লেখা হয়েছিল।
তিনি তার এক বন্ধুর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, “আমি আর লিখতে পারছি না। আমার প্রায় ৩০০ জন বন্ধু রয়েছে যারা প্রায়ই কফি পানের ছুতোয় চলে আসে। আমি ভোর ৬টায় উঠার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তখন সব ৬টায় জাগা ব্যক্তিরা এক জায়গায় জড়ো হয়!” হার্পার লি একা সময় পাচ্ছিলেন না এবং তার লিখতে না পারার পেছনে তিনি এই ভিড়বাট্টাকে দায়ী করেছিলেন।
তার রাইটার’স ব্লক তাকে জীবনভর যন্ত্রণা দেয়। যার একটি বই-ই পৃথিবীজোড়া এত খ্যাতি ও স্বীকৃতি পেতে পারে, তিনি আরো লিখলে কত বেশি প্রাপ্তি তার ঝুলিতে পড়তো- তা শুধু কল্পনাই করা যায়। ২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ফিচার ইমেজ- latimes.com