প্রথম দেখায় শিরোনামটি একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু কথাটি সত্য যে পুরুষদের তুলনায় বিজ্ঞানীর জগতে নারীদের পদচারণা অনেক কম। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর কিছু কিছু জায়গায় নারীদের শিক্ষার আলো দেখতে দেয়া হয় না। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে সেরকমটি হয় না। সেখানে নারী-পুরুষ উভয়ই এক কাতারে কাজ করতে পারে। সেসব দেশের মূল সমস্যা হচ্ছে তারা নারীদেরকে গবেষণার জগতে আকৃষ্ট করতে পারছে না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে গবেষণার জগতে নারীদের অবস্থান একদম নিচের দিকে, বিশেষ করে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে। যুক্তরাষ্ট্রে STEM (Science, Technology, Engineering and Mathematics) নামক একটি উদ্যোগ নেয়া হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীদেরকে এই চারটি বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জগতে তাদের অবস্থান আরও শক্ত করা। ওবামা প্রশাসনের সময় এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে একটি ক্যাম্পেইন করা হয়, নাম Let Girls Learn। এই ক্যাম্পেইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেসব মেয়েরা মাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে তাদেরকে বিজ্ঞানের দিকে নিজের কর্মজীবন ঠিক করতে উজ্জীবিত করা।
এরকম করার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে যেকোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রাঙ্গণে নারীদের সংখ্যা অনেক কম। যেখানে যেকোনো দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, সেখানে যেকোনো বিষয়ে নারীদের সংখ্যা অর্ধেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ পুরুষদের তুলনায় নারীদের অবস্থান অনেক পেছনের দিকে পড়ে রয়েছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে যেসব নারী কাজ করছেন তারা খুব ভালো অবস্থানে আছেন এবং নিজেদেরকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। পুরুষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় নিজেদের কাজের ছাপ রেখে যাচ্ছেন নারীরা। তবুও বিজ্ঞানের জগতে একটি বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।
অনেক ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে। যেমন- কেন আমরা নোবেলজয়ী কোনো নারী পাচ্ছি না? কেন এবেল পুরস্কার কিংবা অন্যান্য বড় বড় বৈজ্ঞানিক পুরস্কার ঘোষণায় নারীদের নাম নেই? কেন গবেষণার জগতে পুরুষদের মতো নারীদের কোনো পথ প্রদর্শক নেই? এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকভাবেই দেয়া যায়। হয়তো শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদেরকে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে, পুরুষরা নারীদেরকে তাদের সাথে একই কাতারে ভাবতে পারছে না, নারীদের বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে পুরুষদের আধিপত্য বেশি থাকায় নারীরা এসব বিষয়কে পেশা হিসেবে নিতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে এবং আরও বেশি নারি বিজ্ঞানী তৈরি করতে হলে এদিকে আমাদের গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ বেশি বেশি নারী বিজ্ঞানী তৈরি না হলে আমরা নারীদের সৃজনশীল মস্তিষ্ক এবং তাদের আইডিয়াগুলোকে কাজে লাগাতে পারবো না। এমনও তো হতে পারে যে, একজন পুরুষ বিজ্ঞানী একটি বৈজ্ঞানিক সমস্যা যেভাবে চিন্তা করছেন, একজন নারী অন্যভাবে সেটা আরও দ্রুত চিন্তা করে বের করে ফেলতে পারবেন। এই লক্ষ্য নিয়েই উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানে নারীদের আগ্রহ গড়ে তোলার কাজ চলছে।
এই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে 500 Women Scientists বলে একটি সংঘ তৈরি করা হয়েছে, যাদের কাজ নারীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলা। এই সংঘের সদস্যরা সভা-সমাবেশ করে বিজ্ঞান এবং এখানে নারীর অবদান, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। তারা সাধারণ মানুষকে তাদের সংঘের সাথে যুক্ত করে এবং তাদেরকে বোঝায় যে কীভাবে বিজ্ঞান একটি সমাজকে আরও বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারে এবং কীভাবে নারীরা এখানে নিজেদেরকে সম্ভাবনাময় করে তুলতে পারে।
বর্তমানে প্রায় ২০,০০০ নারী এই সংঘের সাথে জড়িত, প্রায় ১,০০০ মতো পুরুষও এখানে সম্মিলিতভাবে কাজ করছেন। এই সংঘ কখনও জোর করে কোনো নারীকে বিজ্ঞানী হতে বলে না, বরঞ্চ সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিয়ে, ইতিহাস থেকে উদাহরণ টেনে, এমনকি বিজ্ঞানে কাজ করলে নারীদের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতির অভাবের কারণে কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ও তাদের সামনে আনা হয়।
২০১৮ সালে এই সংঘ থেকে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়, যার শিরোনাম Request a Woman Scientist। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে এই উদ্যোগের কাজ চলে। এরকম অভিনব উদ্যোগের সাথে পৃথিবীর অনেক দেশের বিজ্ঞানী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ইত্যাদি বিভিন্ন পেশা থেকে নারীরা যোগ দেয়। তারা সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের কথা বলে, সাধারণ মানুষকে নিজেদের ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করে যে কেন বিজ্ঞানে প্রচুর নারী উপস্থিতির প্রয়োজন, কেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জগতে নারী-পুরুষের সমতার প্রয়োজন?
এক সপ্তাহের মধ্যে এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয় ৭৮টি দেশের প্রায় ২,৫০০ নারী, যাদের মধ্যে স্নাতক পর্যায়ের নারী শিক্ষার্থীরাও ছিল। দেশগুলোর মধ্যে ছিল যুক্তরাজ্য (২২৭), কানাডা (১৪৯), অস্ট্রেলিয়া (১৩১), জার্মানি (৩৭), ভারত এবং নেদারল্যান্ড থেকে ৩৫ জন, মেক্সিকো (৩৪), স্পেন (৩১), দক্ষিণ আফ্রিকা (৩০ ইত্যাদি দেশ)। নারীদেরকে বিজ্ঞানে উজ্জীবিত করতে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত নারীরা এখানে এসে নিজেদের কথা বলেছেন। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ফোটোনিক্স, রেডিওলোজী, গণিত (কম্বিনেটরিক্স), নিউরোপ্রস্থেটিক্স, ডিসিশন মেকিং– ইত্যাদি বিভিন্ন পেশা, যেখানে পুরুষদের আধিপত্য বেশি, সেখানে কীভাবে নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়ে তারা টিকে আছে সেসব নিয়ে কথা বলেছেন এই নারীরা।
চান্দ্রা ডেজিয়া একজন নারী, যিনি পেশায় একজন পরিবেশবিদ এবং রেডিওতে কাজ করেন। জামাইকাতে থাকেন। সেখানে তিনি স্বাস্থ্য, পর্যটন শিল্প ইত্যাদির উপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন এবং বিভিন্ন সমস্যার কথা সবাইকে রেডিওর মারফত জানান। ইথিওপিয়ার আরেকজন আছেন যিনি পেশায় একজন পক্ষিবিদ। তিনি বিপন্ন এবং বিলুপ্ত প্রাণীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন এবং এর সাথে পাখিদের ব্যবহার নিয়েও তার আগ্রহ প্রবল। আরেকজন নারী আছেন যিনি সৌদিআরবে নিজের ডক্টরেট করছেন এবং তার মূল কাজ হচ্ছে লোহিত সাগরের কোরালদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেমন সেটা বের করা।
এখানে যে উদাহরণগুলো দেয়া হলো সেখানে দেখা যাচ্ছে, যেসব নারীরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করছে তারা বিভিন্ন পেশায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করছে এবং সেখানে নিজেকে পারদর্শী করে তুলছে। বিষয়গুলো সাধারণত পরিচিত নয়, এবং খুব কম সংখ্যক পুরুষদেরকেই এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। কোন নারীকে এসব বিষয়ে কাজ করতে দেখা যায় না। কিন্তু প্রতিযোগিতা কম হওয়াতে নারীরা এ সমস্ত কাজে নিজেদেরকে আবদ্ধ করছে এবং তাদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা সেখানে সফল।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, চিরচারিত প্রথা ভেঙে কিছু সংখ্যক নারী সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। নারীদের বিজ্ঞানের জগতে যেকোনো বিষয়ে কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। শুধুমাত্র প্রয়োজন তাদেরকে বিজ্ঞানের দিকে প্রণোদিত করা। Request a Woman Scientist – নামক যে উদ্যোগ নেয়া হয়, সেখানে কিন্তু ভারত ছাড়া কোনো উন্নয়নশীল দেশ যোগ দেয়নি। তাই উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে নারীদের বিজ্ঞানী হওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে আরও কিছু কাজ করার প্রয়োজন হবে। যেমন- সামাজিক পরিবর্তন আনা, পরিবারের মানুষের মানসিকতার মধ্যে পরিবর্তন আনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের অবস্থানে পরিবর্তন আনা ইত্যাদি। এরপর তাদেরকে বিজ্ঞানের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়তো সম্ভবপর হবে। এখানে উন্নত দেশের সাথে আমাদের দেশ তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর চিন্তাধারার পার্থক্য ধরা পড়ে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: RightBrainNews