‘আলিবাবা’ নামক চাইনিজ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। এটি খুচরো বিক্রেতাদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম। আর এই আলিবাবারই একটি অংশ ‘আলিএক্সপ্রেস’ তো আমাদের সকলের নিকটই অত্যন্ত পরিচিত, যার মাধ্যমে আমরা এখন সহজেই ঘরে বসে বিভিন্ন খুচরো বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতে পারছি। যে প্লাটফর্মের সুবিধা আমরা বর্তমানে খুব সহজেই লুফে নিচ্ছি, তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এবং বিস্তৃত হওয়ার সফর নিতান্তই সহজ ছিল না। এক্ষেত্রে আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মাঁ অবশ্যই নিজের অসম্ভব ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। জ্যাক মাঁ’কে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করতে যেভাবে প্রতিনিয়তই উত্থান-পতনের সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি বাস্তব জীবনেও তাকে সবসময় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন।
চলুন প্রথমে জ্যাক মাঁ সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক এবং এরপর জানা যাক কীভাবে তিনি আলিবাবাকে বর্তমানের অবস্থায় আনেন।
১৯৬৪ সালের ১৫ অক্টোবর জ্যাক মাঁ চীনের হাংঝুর খুব সাধারণ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা-বাবা সেখানকার ঐতিহ্যগত সংগীতশিল্পী এবং গল্পকার ছিলেন। পরিবারের অর্থনেতিক অবস্থা এতটাই দুর্বিষহ ছিল যে তাদেরকে মধ্যবিত্ত পরিবার বলাও চলে না। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’-এর মতো অবস্থা আরকি। জ্যাক মাঁ’র জন্ম এমন একটা সময়ে, যখন তার পরিবারে ছিল অর্থনৈতিক দুরবস্থা, আর দেশে রাজনৈতিক দুরবস্থা। সেই সময়ে চীনে কমিউনিজম তথা সাম্যবাদের উত্থান ঘটে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সবদিক থেকেই প্রতিকূলতা থাকায় পড়াশোনায় কিছুটা পিছিয়ে পড়তে শুরু করেন জ্যাক মাঁ। কিন্তু কিছু সময় পরই তার ভাগ্য ফিরল। ১৯৭২ সালে হাংঝুতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আগমন অস্থির পরিবেশকে কিছুটা হলেও শান্ত করতে সক্ষম হয়। আর এই সুযোগকে খুব ভালোভাবেই কাজে লাগান তিনি। ইংরেজি শেখার দৃঢ় ইচ্ছা ছিল এবং তিনি তা শেখাও শুরু করেন এই সময়ে। এমনকি ইংরেজিতে স্নাতক পাস করে হাংঝু ডায়ানঝি ইউনিভার্সিটিতে মাসিক ১২ ডলারের জন্য পড়ানো শুরু করে। এই সাধারণ শিক্ষকই একদিন কোটিপতিদের তালিকায় নাম লেখান। কাজটা নিতান্তই সহজ ছিল না।
তাছাড়া জ্যাক মাঁ’র জীবনে ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতাও কম ছিল না। প্রাথমিক স্কুলে দু’বার, আর মাধ্যমিক স্কুলে তিনবার অকৃতকার্য হন। হাংঝু নর্মাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ১০বার আবেদন করেন এবং প্রতিবারই বাদ পড়ে যান। স্নাতক পাস করার পূর্বে এবং পরে বারবার আবেদন করেও কোনো চাকরি পাননি। আর এই আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩০! এমনকি ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেওয়া শুরু করলে প্রথম দু’টি উদ্যোগই ব্যর্থ হয়।
বিভিন্ন সময়ে প্রত্যাখানের সম্মুখীন হতে হতে জ্যাক মাঁ ১৯৯৫ সালের দিকে প্রথম কোনো সফলতা দেখতে পান। তাকে ‘হাংঝুর সর্বোত্তম ইংরেজি বক্তা’ আখ্যা দেওয়া হয়। সে বছর মহাসড়ক নির্মাণের জন্য সরকারের গৃহীত একটি প্রজেক্টের জন্য কাজ করতে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়। আর সেখানেই তিনি প্রথমবারের মতো কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের সাথে পরিচিত হন। আসলে সেই সময়ে চীনে কম্পিউটার অনেকটাই বিরল ছিল। আর ইন্টারনেট এবং ই-মেইলের তো বলতে গেলে কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সেজন্য জ্যাক মাঁ এই নতুন প্রযুক্তি দেখে বেশ বিস্মিত হন এবং নতুন জিনিসটি বোঝার জন্য বেশ উঠেপড়ে লাগেন। তিনি ব্রাউজারে প্রথমেই ‘বিয়ার’ লিখে সার্চ দেন। একটি জিনিস সম্পর্কে এত তথ্য একসাথে পেয়ে বেশ অবাক হন। চীন সম্পর্কে ইন্টারনেটে কী কী তথ্য পাওয়া যায়, তা জানার জন্য উৎসুক হয়ে পড়েন। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো চীন সম্পর্কে কোনো তথ্য ব্রাউজারে ছিল না। আর তখন থেকেই তার মাথায় ঘুরতে থাকে, চীন এবং তার আমজনতার কাছে ইন্টারনেটকে কীভাবে পরিচিত করে তোলা যায় এবং ব্রাউজারে নিজের দেশের অস্তিত্ব ফুটিয়ে তোলা যায়।
জ্যাক মাঁ’র মাথায় ই-কমার্স স্টার্ট আপের একটি বুদ্ধি ঘুরপাক খেতে থাকে। তিনি তার আরো ১৭জন বন্ধুকে তার প্রজেক্টে বিনিয়োগ করতে রাজি করেন। তার এই নতুন ই-কমার্স স্টার্ট আপটিই হলো আলিবাবা, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। প্রজেক্টটি খুব ঘরোয়াভাবেই নিজের অ্যাপার্টমেন্টে শুরু করেন তারা। পরবর্তী সময়ে আলিবাবা পরিচালনার জন্য বাইরে থেকে মূলধন সংগ্রহ করা শুরু করেন। তারা ‘সফটব্যাংক’ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার এবং ‘গোল্ডম্যান স্যাকস’ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলারের মূলধনের যোগানও পেয়ে যান। বিনিয়োগ সংগ্রহ করা কিংবা প্রজেক্ট শুরু করার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কঠিন ছিল চীনের সাধারণ জনগণকে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম এবং প্যাকেজ ট্রান্সফার বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত করানো। প্রথমদিকে আলিবাবা একটু ঝিমিয়ে চললেও একুশ শতকের আগমন জ্যাক মা এবং তার নবপ্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইটের জন্যও শুভই ছিল।
অবশ্য নামের সাথে অন্তত যেন সাধারণ জনগণ পরিচিত থাকে এবং এর সূত্র ধরে একটু হলেও এই ওয়েবসাইট ব্যবহারে আগ্রহী হয়, সেজন্য তিনি খুব ভেবেচিন্তেই নামটা ঠিক করেন। ২০০৬ সালে সিএনএন’স টক এশিয়া প্রোগ্রামের একটি ইন্টারভিউতে জানান যে, তিনি স্যান ফ্রান্সিসকোর একটি ক্যাফেতে ছিলেন, যখন হঠাৎ করেই ‘আলিবাবা’ নামটি তার মাথায় আসে। সেই ক্যাফেরই এক পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করেন যে, এই নামটি সম্পর্কে কিছু জানেন নাকি। এর প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, “ওপেন সিসেম”। এটি ‘আলিবাবা এবং চল্লিশ চোর’ গল্পটির অতি পরিচিত একটি বাক্য, যা গল্পে বললেই ধনের ভাণ্ডারের গোপন দরজা খুলে যায়।
তারপর তিনি রাস্তায় এলোমেলোভাবে অনেকের কাছেই জানতে চান, আলিবাবা নামটি সম্পর্কে তারা কী কী জানেন। সবার কাছ থেকেই ইতিবাচক মতামত তাকে এই নামটিই বেছে নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। জ্যাক মাঁ বলেন যে, আলিবাবা ছিলেন একজন দয়ালু এবং একইসাথে চালাক ব্যবসায়ী। তিনি গ্রামবাসীকেও সহায়তা করেন। আর এই ব্যক্তিত্বের জন্যই নামটি তার বেশ ভালো লাগে। বর্তমানে আলিবাবা ছোট থেকে মাঝারি সাইজের কোম্পানি নিয়ে কাজ করে।
সফটব্যাংক থেকে বিনিয়োগ পাওয়ার পরপরই আলিবাবার সুদিনের আরম্ভ ঘটে। কোম্পানির বৃদ্ধিও বেশ বাড়তে থাকে। যখন কোম্পানিটি ক্যাশ পজিটিভ হয়ে যায়, তখন আলিবাবা ‘তাওবাও.কম’ প্রতিষ্ঠা করে।
এটি ক্রেতা-ক্রেতা পণ্য ক্রয় বিক্রয় ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে থাকে। ই-বে যেভাবে বাইরের দেশগুলোতে সার্ভিস দিচ্ছিল, জ্যাক মাঁ তার কোম্পানি আলিবাবার মাধ্যমে সেই সার্ভিসই চীনে দিতে চাচ্ছিল। আালিবাবা এতটুকু উন্নতি বা বিস্তৃতেই সন্তুষ্ট ছিল না। আবার নিজের কোম্পানিকে বিস্তৃত করার তাগিদে জ্যাক মাঁ উঠেপড়ে লাগেন এবং সফলভাবে ৮২ মিলিয়ন ডলার যোগাড় করেন। এ পরিমাণ অর্থ তিনি ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজিং টুল ‘আলিওয়াংওয়াং’ এবং থার্ড পার্ট অনলাইন পেমেন্ট প্লাটফর্ম ‘আলিপে’ প্রতিষ্ঠা করার কাজে লাগান। তাওবাও.কম, আলিওয়াংওয়াং এবং আলিপে এই তিনটি ব্যবসাকে একসাথে ই-কমার্সের ‘আয়রন ট্রায়াঙ্গল’ বলে। এই ট্রায়াঙ্গলের উপরই আজকের আলিবাবা গ্রুপ মূলত টিকে আছে। বর্তমানে আলিবাবা ক্রেতা-ক্রেতা (সি টু সি), ব্যবসায়ী-ক্রেতা (বি টু সি), ব্যবসায়ী-ব্যবসায়ী (বি টু বি) সার্ভিস দিয়ে থাকে।
অনেকেই আলিবাবাকে অ্যামাজনের সাথে তুলনা করে থাকে। দু’টি কোম্পানির মধ্যে কিছু মিল থাকলেও অমিলের সংখ্যাও কম নয়। যেমন- অ্যামাজনের মতো আলিবাবা নিজেই খুচরো বিক্রেতা নয়। বরং এটি সকল খুচরা বিক্রেতাদের জন্য একটি প্লাটফর্মের ব্যবস্থা করে দেয়, যেখানে ক্রেতা, বিক্রেতা, উৎপাদক, সরবরাহকারীরা ই-কমার্স ব্যবস্থার সুযোগ পেয়ে থাকে। চীনে ইন্টারনেটের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পলিসি আলিবাবার জন্য বেশ সুবিধাই সৃষ্টি করে। বাইরের দেশগুলোর গুগল, ই-বে এবং ইয়াহুর কাজ চীনে আলিবাবাই করা শুরু করে। উল্লেখ্য যে, ২০০৫ সালে আলিবাবা ইয়াহুর সাথে পার্টনারশিপ করে। পরবর্তী তিন বছরে আলিবাবা আরো তিনটি সফল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন- তাওবাও ইউনিভার্সিটি (একটি অনলাইন ই-কমার্স শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম), আলিমামা (একটি অনলাইন মার্কেটিং প্লাটফর্ম) এবং টিমল (থার্ড পার্টি ব্র্যান্ডেড প্রোডাক্টের জন্য একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস)।
২০০৯ সালে কোম্পানির ১০ম বার্ষিকী উপলক্ষে কোম্পানিটি আলিবাবা ক্লাউড প্রতিষ্ঠিত করে। তাছাড়া চীনের প্রধান আইপি প্রদানকারী ‘হাইচায়না’-কেও জয় করে নেয়। পরবর্তীতে জুহুয়াসুয়ান (একটি গ্রুপ-বাইং মার্কেটপ্লেস), আলিএক্সপ্রেস (রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বিশ্ব মার্কেটপ্লেস) এবং ডায়ানডায়ানচং (একটি মোবাইল সোস্যাল নেটওয়ার্কিং অ্যাপ)-ও চালু করে। ২০১৮ সালের জানুয়ারির তথ্য মোতাবেক, এটি দ্বিতীয় এশিয়ান কোম্পানি, যার ভ্যালুয়েশন মার্ক ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং মার্কেট ভ্যালু ৫৩৭ বিলিয়ন ডলার পৌঁছে গেছে।
আলিবাবার উন্নতির সফরের পথটা ছিল বন্ধুর। বর্তমান অবস্থায় আসার জন্য এটি প্রতিনিয়ত কাজ করার পাশাপাশি লক্ষ্য রেখেছে যেন পরিবেশগত এবং মানবিক বিষয়গুলোতে ত্রুটি না থাকে। জ্যাক মাঁ’র দক্ষ নেতৃত্ব এবং বুদ্ধিমত্তাই আলিবাবাকে বর্তমানের সফল অবস্থায় নিয়ে এসেছে।