মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে উপন্যাসের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প, আনিসুল হকের মা, সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান, শাহরিয়ার কবিরের পুবের সূর্য, ইমদাদুল হক মিলনের সাড়ে তিন হাত ভূমি, মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ, শওকত আলীর যাত্রাসহ কালজয়ী বা কাল-না-জয়ী অসংখ্য উপন্যাস আছে।
কিন্তু এ-ই কি যথেষ্ট? বোধহয় না। কেননা এখনো যে অনেক গল্পই বলা বাকি। লেখক ওবায়েদ হকের মতে, একাত্তরের অন্তত সাত কোটি গল্প আছে। বিচিত্র, অভাবনীয়, বিভীষিকাময় একেকটি গল্প। খেটে খাওয়া জেলে-মজুরের গল্প, স্বামীহারা স্ত্রীর গল্প, সন্তানহারা বাবার গল্প ইত্যাদি।
প্রচারবিমুখ এই লেখক এমনই একটি গল্প বেছে নিয়েছেন। এক চোরের গল্প। ফজর আলী, যে কি না উত্তরাধিকার সূত্রে চোর। পরের ঘরে সিঁদ কেটেই তার নিজের ঘরের উনুনে ভাত চড়ানো হয়। বাবার মৃত্যু হয়েছিল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে। নিজের কপালে কী লেখা আছে তার জানা নেই।
ফজরের কাছে তার পৃথিবী বলতে শুধু বউ আমেনা আর একমাত্র ছেলে মজিদ। বউ-ছেলের দিকে তাকিয়ে সে যে ভাল হতে চায়নি এমনটাও নয়। কারণ আমেনার চোখে যে তার জন্য বিন্দুমাত্র সম্মান নেই, চোরের বউ হিসেবে তাকে যে পাহাড়সমান অপবাদ সহ্য করতে হয়- সবই সে বুঝতে পারে। কিন্তু সমাজ যে বড়ই নিষ্ঠুর। ফজর চৌর্যবৃত্তি ছেড়ে দিলেও চোর উপাধি তার পিছু ছাড়েনি। জোয়ারদার বাড়িতে কামলার কাজ পেলেও বাড়ির ছোট বউয়ের বালা চুরির মিথ্যা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাকে।
জেলে গিয়েও সব সময় ফজর আমেনার কথাই ভাবে, মজিদের ছবি তার মানসপটে ভেসে ওঠে। জেলের মধ্যে তার সাথে পরিচয় হয় ইউসুফ মুন্সী, সুজন মাস্টার, বাচ্চু, এক পিএইচডি পাগলা প্রফেসরসহ নানারকম সামাজিক অবস্থা থেকে আসা অনেকের সাথে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেকরকম। ফজর আলী সবই শোনে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। সে তো শেখ মুজিব চেনে না, মুক্তি চেনে না, পাক হানাদারও চেনে না। সে শুধু চেনে আমেনা আর মজিদকে, তার ছোট্ট সেই সংসারকে।
এদিকে আমেনাও পড়েছে অথৈ সাগরে। ফজরের অবর্তমানে ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে, সাথে আবার জুটেছে তার সদ্য বিধবা ভাবি রোশনি। গ্রামের মানুষের ধর্মান্ধতা আর সংকীর্ণতার মধ্যে দুই নারীর জন্য জীবন সংগ্রাম করে যাওয়া সহজ কাজ নয়। গতর বেচে নয়, গতর খাটিয়ে জীবন ধারণের জন্যেই বাঁশের তৈরি মাছ দরার চাঁই, ঝুড়ি বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করে রোশনি। একদিন গঞ্জে যাওয়ার পথে রোশনির সাথে দেখা হয় নসু মাঝির। কলেরায় বাবা-মা কে হারানো নসু মাঝির মানবতাবোধে মুগ্ধ হয় রোশনি।
ততদিনে শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছেন, শহর পেরিয়ে যুদ্ধের দামামা মফস্বলেও বাজতে শুরু করেছে। গ্রামে গ্রামে পাক হানাদারেরা ক্যাম্প করেছে। শান্তি কমিটি গঠন হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম পুরুষশূন্য হচ্ছে, রাজাকারদের সহায়তায় নারীদের ধরে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
জেলের মধ্যে থেকেও যুদ্ধের ভয়াবহতা কয়েদিরা টের পাচ্ছে টর্চার সেলের পাশে পড়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত লাশগুলো দেখে। মাঝে মাঝেই ফজর আর সুজন মাস্টারকে ডাকা হয় গণকবর খোঁড়ার জন্য। সুজন মাস্টার ঠিক করে জেল থেকে পালিয়ে সে মুক্তি হবে, মুন্সি আর বাচ্চু ঠিক করে তারা রাজাকার হবে। পাগলা প্রফেসরের বুদ্ধিতে তারা পালানোর পরিকল্পনাও করতে থাকে।
আদৌ কি তারা পালাতে পারবে? কী লেখা আছে সুজন মাস্টার, মুন্সী আর বাচ্চুর অদৃষ্টে? পাগলা প্রফেসরেরই বা পরিণতি কী? ফজরের সাথে কি দেখা হবে আমেনার? আত্মপরিচয় নিয়ে হীনম্মন্যতায় থাকা ফজরের কি পরিবর্তন হবে কোনো? এ সবেরই উত্তর রয়েছে উপন্যাসে।
ওবায়েদ হকের লেখনী প্রাঞ্জল, সহজপাঠ্য। রসবোধ বরাবরের মতোই তীক্ষ্ণ ও নির্লিপ্ত, যা পাঠককে চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম হতে আরো সহায়তা করে। উপন্যাসের চরিত্রায়নও প্রশংসার দাবিদার। ছোট-বড় সব চরিত্রেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন লেখক, দিয়েছেন তাদেরকে অসাধারণ গভীরতা।
বাবা আর স্বামী চোর হলেও আমেনা নীতিবিবর্জিত নয় মোটেও। মিথ্যা বলে না কখনো সে। অপমানের প্রত্যুত্তর দেয় না, কারো অনিষ্ট কামনা করে না। আবার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাবকেও সে বর্জন করতে পারেনি। হিন্দুর বাড়ির জলও সে স্পর্শ করে না।
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীতে, বিশেষত উপন্যাসে, মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারদের চরিত্রায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে স্টেরিওটাইপ থেকে লেখক বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। মুক্তিযোদ্ধা মানেই আগাগোড়া সাদা, আর রাজাকার হলেই সে কালো, এমন চিরাচরিত পথে না হেঁটে প্রতিটি চরিত্রেই রেখেছেন কম-বেশি ধূসরতার ছোঁয়া।
সমাজের তথাকথিত নিচু শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গিতে মুক্তিযুদ্ধের নতুন দিক উন্মোচন করেছেন লেখক পরম যত্নে। গ্রামীণ সমাজের ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সংকীর্ণতা আর একইসাথে সরলতা মুক্তিযুদ্ধে কী প্রভাব ফেলেছিল, আর যুদ্ধই বা এই সমাজের গতিপথে কেমন বাঁকের জন্ম দিয়েছিল, সেগুলো লেখক তুলে ধরেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।
পাঠকের সামনে সেই অস্থিতিশীল সময়ের খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছেন, যেখানে কেউ সেই ভয়াবহতার মধ্যেও জীবনের স্বরূপ খুঁজে পায়, কেউ বা শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার, যেখানে সমাজের কাছে অপাঙক্তেয় শ্রেণীও প্রয়োজনে সমাজকে দূরে ঠেলতে পারে না। উপন্যাসটির সমাপ্তি চরিত্রগুলোকে এক অভাবনীয় পূর্ণতা দেয়, আর পাঠকের মনে রেখে যায় বিশুদ্ধ মুগ্ধতার রেশ।
নীল পাহাড়, জলেশ্বরী খ্যাত ওবায়েদ হকের তেইল্যা চোরা বাঙালি মানসের সবচেয়ে গর্বের বস্তু যে মুক্তিযুদ্ধ, সেটিকে এক অভূতপূর্ব আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছে। তবে কেবল মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবেই এর অসাধারণত্ব সীমাবদ্ধ নয়। বরং মেদহীন, বাহুল্যবর্জিত এই উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক আরো একবার প্রমাণ করে দেন, টসটসে আবেগ ও অলঙ্কার ছাড়াও, স্রেফ সৌষ্ঠবপূর্ণ একটি গল্পের জোরেই পাঠকের হৃদয়কে আর্দ্র এবং দুচোখকে সিক্ত করে তোলা সম্ভব।
তাই নিঃসন্দেহে তেইল্যা চোরা একটি অবশ্যপাঠ্য উপন্যাস। গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধকে আরেকটু গভীরভাবে অনুভব করতে, সেই সাথে ওবায়েদ হকের মতো এক নিভৃতচারী লেখকের মাঝে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে আবিষ্কার করতে, তেইল্যা চোরা আপনাকে পড়তেই হবে।