সূর্য; আমাদের সবচেয়ে কাছের এবং এ সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্র। তাই সূর্যকে আমরা অনেকটা আপন হিসেবে নিজেদের জীবনে গ্রহণ করেছি। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সূর্যের উপাসনা করত। বর্তমানে সন্তানের নাম হিসেবে, এমনকি কারও বীরত্ব বা তেজ বর্ণনা করতে গেলেও আমরা সূর্যকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করি।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিজ্ঞানীদের কাছেও সূর্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের এত কাছে একটা নক্ষত্র আছে বলেই তারা নক্ষত্র সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। অন্যান্য নক্ষত্রের বর্ণনার ক্ষেত্রে সবসময়ই তাকে সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। তবে সূর্য আমাদের পৃথিবীর তুলনায় কয়েক লক্ষ গুণ বড় হলেও, সৌরজগতের বাইরে অন্যান্য নক্ষত্রের সাথে তুলনা করলে তাকে শিশুই বলা যায়। যেমন- এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় নক্ষত্র UY Scuti এর ব্যাসার্ধ সূর্যের চেয়ে ১,৭০০ গুণ বড়। সূর্যের চেয়ে বড় এসব নক্ষত্রের জীবনও চমকপ্রদ। তবে ছোট হলেও সূর্যের জীবন কিন্তু কম ঘটনাবহুল না।
জন্ম
আজ থেকে প্রায় ৪.৫৭ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের এ সৌরজগতের অস্তিত্ব ছিল না। তার জায়গায় ছিল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে ভেসে বেড়ানো গ্যাস এবং ধূলিকণা, যার নাম নেবুলা। নেবুলার বেশিরভাগ পদার্থই ছিল হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম, অতি সামান্য পরিমাণ ভারী মৌল। তারপর অনেকটা হঠাৎ করেই নেবুলার মহাকর্ষীয় পতন ঘটে (Gravitational Collapse)। ধারণা করা হয়, কাছ দিয়ে যাওয়া অন্য কোনো নক্ষত্রের প্রভাবে অথবা সুপারনোভা থেকে আসা শক ওয়েভই এ পতনের জন্য দায়ী।
কারণ যেটাই হোক, এ পতনের ফলে ধূলিকণা এবং গ্যাস একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং নেবুলার কেন্দ্রে ভর জমা হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে মহাকর্ষের প্রভাবে কেন্দ্রটি আরও ভর নিজের দিকে টেনে নিয়ে গোলাকার বস্তুতে পরিণত হয় এবং ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার কারণে ঘুরতে শুরু করে। ভর বৃদ্ধির সাথে সাথে এর চাপ এবং তাপও বৃদ্ধি পায়। নেবুলার বেশিরভাগ পদার্থই (প্রায় ৯৯.৮%) এ গোলাকার বস্তুর সাথে যুক্ত হয়। বাকি পদার্থগুলো চ্যাপ্টা ডিস্কের আকারে এর চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে এবং প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এ ডিস্ক থেকে গ্রহগুলো এবং সৌরজগতের অন্যান্য পদার্থের উদ্ভব ঘটে।
কেন্দ্রের গোলাকার বস্তুটি পরবর্তী এক লক্ষ বছর পর্যন্ত প্রোটোস্টার হিসেবে থাকে এবং ভর অধিগ্রহণ করতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পর্যাপ্ত চাপ ও তাপ এর অভ্যন্তরে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু না করে। পরবর্তী কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যেই এটি নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে, জন্ম হয় সূর্যের, আমাদের সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্রের। শুরু হয় এক বৈচিত্র্যময় ও আশ্চর্য জীবনের পথচলা।
নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া
সহজভাবে বলতে গেলে, নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় যুক্ত থাকে পরমাণুর নিউক্লিয়াস, এবং দুটি হালকা পদার্থ একত্রিত হয়ে তৈরি করে একটি ভারী পদার্থ। এককালে বিজ্ঞানীরা জানতেন, শক্তির কোনো সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। শক্তি কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়। একে আমরা বলি শক্তির নিত্যতা সূত্র। একইভাবে, ভরেরও নিত্যতা সূত্র রয়েছে। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন সর্বপ্রথম এ দুটি নিত্যতা সূত্রের যোগসূত্র খুঁজে বের করেন। তিনি দেখান, দুটি মৌল যখন একটি আরেকটির সাথে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া করে, তখন তাদের মিলিত ভর, তাদের আলাদা অবস্থার ভরের চেয়ে সামান্য কম।
সূর্যের ভেতর এ ফিউশন বিক্রিয়া হয় হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের মাধ্যমে। হাইড্রোজেন প্রকৃতির সবচেয়ে সরল পরমাণু, যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রোটন এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে একটি ইলেকট্রন। পরের পরমাণুটি হচ্ছে হিলিয়াম, যার কেন্দ্রে রয়েছে দুটি প্রোটন এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে দুটি ইলেকট্রন। তবে প্রোটনের চার্জ পজিটিভ হওয়ায় এরা একসাথে নিউক্লিয়াসে থাকতে পারে না। এদেরকে একসাথে আটকে রাখার কৃতিত্ব নিউট্রনের, যার ভর প্রোটনের কাছাকাছি কিন্তু কোনো চার্জ নেই। দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একীভূত হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম উৎপন্ন করে। আলাদাভাবে দুটি প্রোটন এবং দুটি নিউট্রনের যত ভর, হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর তার থেকে সামান্য কম, সঠিকভাবে বলতে গেলে ০.০০৭ ভাগ কম। এই ভর কোথায় যায়? আইনস্টাইন তার বিখ্যাত সূত্র E = mc^2 এর মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে এই হারিয়ে যাওয়া ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আজ সূর্যের যত শক্তি, সবটুকুই আসে ঐ হারিয়ে যাওয়া ভর থেকে।
সূর্যের গঠন এবং শৈশবকাল
জন্মের পরবর্তী অবস্থায় সূর্যের প্রায় পুরোটাই ছিল হাইড্রোজেন। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হতে থাকে এবং সূর্য প্রবল শক্তিতে জ্বলতে থাকে। সূর্যকে মোট ৬টি অঞ্চলে ভাগ করা যায়-
১. কেন্দ্র (The Core)
২. বিকীরণ অঞ্চল (Radiative Zone)
৩. পরিচলন অঞ্চল (Convective Zone)
৪. দৃশ্যমান পৃষ্ঠ বা ফটোস্ফিয়ার (Visible Surface called the Photosphere)
৫. আলোকমন্ডল বা ক্রোমোস্ফিয়ার (The Chromosphere) এবং
৬. সর্ববহির্ভূত অঞ্চল বা করোনা (The Corona)
কেবল সূর্য নয়, মহাবিশ্বের প্রতিটি নক্ষত্রই নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় তাদের শক্তি লাভ করে। সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে ৬০০ মিলিয়ন টন ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং মোটামুটি 4X10^27 ওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে। সূর্যের কেন্দ্রে তাপমাত্রা প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস যা ফিউশন বিক্রিয়া অব্যাহত রাখে। উৎপন্ন শক্তি বিকীরণের মাধ্যমে প্রথমে বিকীরণ অঞ্চল এবং পরে পরিচলন অঞ্চলের উপরিভাগে আসে। এই যাত্রাপথে সময় লাগে প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার বছর! পরিচলন অঞ্চলে তাপমাত্রা নেমে আসে ২ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে যেখানে উত্তপ্ত প্লাজমা বড় বড় বাবল অবস্থায় বাইরের দিকে যেতে থাকে। সূর্যের যে অংশ আমরা দেখতে পাই, অর্থাৎ পৃষ্ঠতল, তার তাপমাত্রা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। কেন্দ্রের তুলনায় যথেষ্ট ঠান্ডা বলা চলে!
সূর্যের পৃষ্ঠের অর্থাৎ ফটোস্ফিয়ারের পুরুত্ব ৫০০ কিলোমিটার। এটি গ্রহের পৃষ্ঠের মতো শক্ত নয়, বরং গ্যাসীয়। ফটোস্ফিয়ার থেকেই মূলত সূর্যালোকের যাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীতে আসতে এর সময় লাগে আট মিনিট।
প্রাপ্তবয়স্ক সূর্য
সূর্য বর্তমানে এর যৌবনকাল অতিবাহিত করছে। সাধারণ ভাষায়, সূর্য প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর ধরে জ্বলছে এবং আরও প্রায় একই সময় ধরেই জ্বলবে। এখন সূর্যের ৭০.৪% হাইড্রোজেন, ২৭.৪% হিলিয়াম এবং বাকিটা অন্যান্য পদার্থ। এখন পর্যন্ত বলা যায়, সূর্যে প্রায় ১০০ খানা পৃথিবীর সমপরিমাণ ভরের হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ৩০ ভাগ হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হতে যদি এত সময় লাগে, তাহলে বাকি ৭০ ভাগ রূপান্তরিত হতে তো আরও বেশি সময় লাগার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হবে না। কারণ সময়ের সাথে সাথে সূর্যে বিক্রিয়ার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে প্রতি মূহুর্তেই আগের তুলনায় অধিক হিলিয়াম উৎপন্ন হচ্ছে।
বর্তমানে সূর্যের যা ঔজ্জ্বল্য, আগামী ১০০ মিলিয়ন বছরে তা ১% বৃদ্ধি পাবে। আর ১.১ বিলিয়ন বছর পরেই তা বৃদ্ধি পাবে ১০%। ঔজ্জ্বল্য বাড়ার সাথে সাথে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাপও বৃদ্ধি পাবে। সূর্যের তাপ একটু এদিক ওদিক হলেই আমাদের জীবনযাপন দূর্বিষহ হয়ে পড়ে, আর ১০% বৃদ্ধি পেলে এখানে কোনো জীবের বেঁচে থাকাই অসম্ভব। পৃথিবী তখন জ্বলে পুড়ে পরিণত হবে মৃত এক গ্রহে। মানবজাতি কি টিকে থাকবে ততদিন? আশ্রয় নেবে অন্য কোনো গ্রহে? নাকি তার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? উত্তর দেবে মহাকাল।