ঘরের দোরগোড়ায় থমকে গেল জিম।
নবদম্পতি জিম আর ডেলা। ভালোবাসার মানুষের জন্য ক্রিসমাসের উপহার কিনতে পরস্পরকে না জানিয়ে তাদের সবথেকে দামি বস্তু বিক্রি করেছে তারা। ডেলার কাছে সবথেকে মূল্যবান তার কোমর ছাড়িয়ে নেমে যাওয়া কেশরাজি। এই চুল বিক্রি করে জিমের জন্য সে কিনেছে পকেটঘড়ির চেন।
জিমের পকেটঘড়ি বংশপরম্পরায় হাতবদল হয়ে আসা। ডেলার পরে সম্ভবত তার কাছে সবথেকে প্রিয় এই ঘড়ি। কিন্তু ঘড়ির পুরনো চেন নষ্ট হয়ে গেছে বহু আগেই। টাকার টানাটানিতে নতুন একটা চেন কিনব কিনব করে কিনতে পারছে না সে। কিন্তু আজ স্ত্রীর জন্য সেই ঘড়ি বিক্রি করে হাতির দাঁতের একসেট চিরুনি কিনেছে। ডেলার বহু আকাঙ্ক্ষিত এই চিরুনির সেট, কিন্তু দামের কথা ভেবে এতদিন কেনা হয়ে ওঠেনি।
ডেলার মাথা আঁকড়ে থাকা ছোট চুল তাই জিমকে থমকে দিয়েছে। স্ত্রীর হাতে উপহার তুলে দিয়ে অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতো সোফায় বসে পড়ল সে। এবার স্বামীর উপহার বের করল সে। বেলার হাতে ঘড়ির চেন দেখে হেসে ফেলল জিম। জানো ডেলা, আমাদের উপহার দু’টি এতটাই মূল্যবান যে এ মুহূর্তে তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
বাইবেলে বলে, সদ্যভূমিষ্ঠ যিশুর জন্য উপহার নিয়ে এসেছিলেন তিন জ্ঞানী ম্যাজাই। লেখকের কথায় এই নবদম্পতির উপহার বিনিময় যদিও আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, কিন্তু একটু ভালো করে ভাবলেই বোঝা যাবে পরস্পরের জন্য যে ত্যাগ তারা স্বীকার করেছে, তার মূল্য সেই তিন ম্যাজাইয়ের দেওয়া উপহার থেকে কিছুমাত্র কম নয়।
খুব সাধারণ একটি গল্প। কিন্তু লেখকের কলমের অসাধারণ আঁচড়ে তা হয়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম পঠিত ও জনপ্রিয় ছোটগল্পের একটি। যার হাত ধরে জিম আর ডেলা নামের চরিত্র দুটো স্থান করে নিয়েছে অগণিত পাঠকের হৃদয়ে, সেই লেখকের নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, তবে তিনি সমধিক পরিচিত তার ছদ্মনামে, ও’ হেনরি।
ছেলেবেলা
উইলিয়াম সিডনি পোর্টারের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যরোলিনা অঙ্গরাজ্যের শহর গ্রিন্সবোরোতে, ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। তার বাবা অ্যালগেরনন সিডনি পোর্টার ছিলেন চিকিৎসক, আর মা মেরি জেন ভার্জিনিয়া একজন গৃহিণী। ও’ হেনরির জন্মের চার বছর আগে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু ও’ হেনরির দুর্ভাগ্য, মায়ের আদর বেশিদিন তার কপালে জোটেনি। তার বয়স যখন তিন, তখন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মেরি মারা যান।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর ও’ হেনরি আর তার বড় ভাই শার্লিকে নিয়ে তাদের পিতা চলে আসেন তাদের নানির বাড়িতে। নিজে কাজ শুরু করেন শ্যালকের ওষুধের দোকানে। খালা এভেলিনা দুই সন্তানের ভার নেন। পেশায় লিনা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষিকা। তার উৎসাহেই প্রথম ও’ হেনরির মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ জন্মে। তার বয়স যখন দশ, তখনই তিনি ডিকেন্স আর স্যার ওয়াল্টার স্কটে ডুবে থাকতেন।
১৮৭৬ সালে খালার স্কুল থেকে প্রাথমিক সমাপ্ত করেন তিনি। এবার তিনি ভর্তি হলেন লিন্ডসে স্ট্রিট হাই স্কুলে। ১৫ বছর পর্যন্ত খালাই তার পড়াশোনার বিষয়টা দেখতে থাকেন। এরপর একদিন ও’ হেনরি সার্টিফিকেট না নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দেন। কাজ নেন মামার ফার্মেসিতে।
টেক্সাসে ও’ হেনরি
তখনকার দিনে ফার্মেসিতে নির্দিষ্ট সময় কাজ করলে তা প্রশিক্ষণ হিসেবে ধরা হতো। এর ভিত্তিতে দেয়া হত ফার্মাসিস্টের লাইসেন্স। তিনিও সেই সুযোগই কাজে লাগালেন। চার বছরের মাথায় লাইসেন্স নিয়ে হয়ে গেলেন অনুমোদিত ফার্মাসিস্ট। মামার দোকানে কাজ করার সময়েই তার সৃজনশীলতা প্রকাশ পেতে থাকে। কলমের টানে তিনি এঁকে ফেলতেন দোকানে আসা শহরবাসীদের মুখ।
ও’ হেনরি ছোটবেলা থেকেই খুসখুসে কাশিতে ভুগতেন। তার মনে হয়েছিল, হয়তো নর্থ ক্যারোলিনার আবহাওয়াই এর কারণ। কাজেই বায়ুবদলের উদ্দেশ্যে পারিবারিক বন্ধু ডক্টর জেমস হলের সাথে ১৮৮২ সালের মার্চে তিনি পাড়ি জমালেন টেক্সাসে। এখানে লা স্যালে অঞ্চলের কটুলা শহরের কাছে ডুল-হল র্যাঞ্চ দু’বছরের জন্য হলো তার অস্থায়ী ঠিকানা। জেমসের ছেলে রিচার্ড হল ছিলেন এই র্যাঞ্চের মালিক। তার অধীনে র্যাঞ্চের কাজ করার কথা থাকলেও হেনরির বেশিরভাগ সময় কেটে যায় বই পড়ে আর স্থানীয় অভিবাসীদের থেকে স্প্যানিশ আর জার্মান শিখে। এ সময় তিনি কিছু লেখালেখি করেন, যা পত্রযোগে পাঠিয়ে দেন গ্রিন্সবোরোর স্থানীয় পত্রিকাতে। সেখানে নিজ নামেই তার লেখা প্রকাশিত হয়।
টেক্সাসে তার কাশি অনেকটাই কমে যায়। ১৮৮৪ সালে তিনি রিচার্ডের সাথে অস্টিন শহরে বেড়াতে আসেন। অস্টিন ভালো লেগে যাওয়ায় এখানেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। রিচার্ডের বন্ধু হ্যারেলদের বাড়িতে স্থান হলো তার। জীবিকার তাগিদে অস্টিনে বেশ কয়েকবার চাকরি বদল করেন ও’ হেনরি। ফার্মাসিস্ট, হিসাবরক্ষক, কেরানি ইত্যাদি পেশায় কেটে যায় বেশ ক’বছর।
পরিবার
অস্টিনেই তার পরিচয় হয় সতের বছরের এথল এস্টেসের সাথে। ১৮৮৭ সালে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেন দুজনে। বিয়ের পর টেক্সাসের ভূমি অফিসে কাজ নেন হেনরি। এখানে চিত্রকর হিসেবে ছোটবেলার প্রতিভা তিনি মানচিত্র তৈরিতে সফলভাবে ব্যবহার করেন। তার আঁকা কিছু মানচিত্র আজও সেখানে সংরক্ষিত আছে।
১৮৮৮ সালে এথল আর ও’হেনরির কোল জুড়ে এল এক ছেলে। কিন্তু জন্মের কয়েক ঘণ্টার মাথাতেই শিশুটির মৃত্যু হয়। পরের বছর জন্ম নেয় তাদের একমাত্র জীবিত সন্তান, মার্গারেট। মার্গারেটের জন্মের পর থেকেই এথলের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে থাকে। দেখা দেয় যক্ষ্মার লক্ষণ। সংসার চালাতে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় ও’ হেনরি এসময় জে ডব্লিউ উইলবার্গারের লেখা বই ‘ইন্ডিয়ান ডিপ্রেডেশনস ইন টেক্সাস’-এর জন্য ছবি এঁকে দেন।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
১৮৯১ সালে ও’ হেনরি অস্টিনের ফার্স্ট ন্যাশনাল ব্যাংকে কাজ নিলেন। এখানে তার বেতন ছিল মাসে ১০০ ডলার, যা তৎকালীন সময়ের বিচারে খুব খারাপ নয়। ব্যাংকে থাকাকালেই ১৮৯৪ সালে তিনি ‘দ্য রোলিং স্টোন’ নামে একটি রম্যপত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। তিনি নিজেই এই পত্রিকার লেখক ও সম্পাদক। ১১,০০০ লোকের শহরে কয়েকমাসের মাথাতেই পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা ১০০০-এ দাঁড়াল।
কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু নিয়েছিল। ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাঙ্ক নিরীক্ষক এফ বি গ্রে ফার্স্ট ন্যাশনালের খাতাপত্র পরীক্ষা করে প্রায় চার হাজার ডলারের ফাঁকি আবিষ্কার করলেন। অভিযোগের তীর ছুটে গেল ও’ হেনরির দিকে। ব্যাংকের কাজ ছেড়ে তিনি পত্রিকা নিয়ে পড়লেন। কিন্তু লোকসান দিতে থাকলে ১৮৯৫ সালের এপ্রিলে দ্য রোলিং স্টোন পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে।
এদিকে গ্রে কিন্তু ও’ হেনরির পিছু লেগেই ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনে গ্রের আবেদন জুলাই মাসে বিচারকেরা নাকচ করে দেন। কিন্তু তিনি হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। বিচলিত অভিযুক্ত চলে এলেন হিউস্টনে। এখানে মাসিক ২৫ ডলারে কলাম লেখকের চাকরি নেন হিউস্টন পোস্ট পত্রিকাতে। লেখার রসদ খুঁজতে তিনি বিভিন্ন হোটেলের লবিতে ঘুরে ঘুরে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতেন।
অস্টিনে গ্রে, হেনরির বিরুদ্ধে ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শমন জারি করতে সক্ষম হন। জুনের ২২ তারিখ হিউস্টন পোস্টে ছাপা হয় তার সর্বশেষ কলাম। পরের মাসের ৬ তারিখে অস্টিনে বিচারের সম্মুখীন হতে ট্রেনে চাপেন তিনি। প্রায় ৫০ মাইল যাবার পর ট্রেন বদল করে তিনি চলে যান নিউ অরলিন্সে। বিচারের মুখোমুখি হতে তিনি চাইছিলেন না।
ফেরারি জীবন
স্ত্রী-সন্তান রেখে নিউ অরলিন্সে পরবাসী জীবন বেছে নেন ও’ হেনরি। এখানে স্থানীয় সংবাদপত্র টাইমস-পিকায়ুন এবং নিউ অরলিন্স ডেল্টাতে লেখালেখি চলতে থাকে। মাসখানেক পর বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় হন্ডুরাসের উদ্দেশে স্টিমারে উঠলেন তিনি। হন্ডুরাসের সাথে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোনো আসামি বিনিময় চুক্তি ছিল না। ও’ হেনরির আশা ছিল, কয়েক বছর এখানে কাটিয়ে দিয়ে অভিযোগ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে ফিরে আসবেন। এ নিয়ে এথলের সাথে তার চিঠি চালাচালিও হচ্ছিল।
ফিরে আসা এবং জেল
হন্ডুরাস থেকে স্ত্রীকে সাংকেতিক চিঠি পাঠিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিতেন ও’ হেনরি। এমন সময় শাশুড়ি খবর দিলেন, এথল যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত অসুস্থ। তিনি অভিযোগের পরোয়া না করে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর পাশে থাকতে হন্ডুরাস যাবার ছয় মাস পরেই অস্টিনে ফিরে এলেন। এথল তখন মুমূর্ষু। মানবিক কারণে পুলিশও ও’ হেনরিকে গ্রেফতার করল না তখন।
১৮৯৭ সালে স্বামী আর মেয়ে মার্গারেটকে ফেলে এথল পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। এবার পুলিশ সক্রিয় হলো। ১৮৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৮৫৪ ডলার আত্মসাতের অভিযোগে ও’ হেনরি দোষী সাব্যস্ত হন। বর্তমান কালের অধিকাংশ আইনজ্ঞই মনে করেন, পুরো বিষয়টিতে ও’ হেনরি বলির পাঁঠা ছিলেন মাত্র। এ ঘটনায় জড়িত রাঘব বোয়ালেরা নিজেদের বাঁচাতে তাকে থালায় সাজিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
অতঃপর পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো তাকে। ১৮৯৮ সালের ২৫ এপ্রিল, স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের কলম্বাসের জেলখানায় কয়েদি নম্বর ৩০,৬৬৪ হিসেবে জেলজীবন শুরু করেন ও’ হেনরি। মেয়ে মার্গারেট তখন ছিলেন পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গে, নানা-নানির কাছে। তাকে জানানো হলো, তার বাবা ব্যবসার কাজে কয়েক বছর বাইরে থাকবেন।
লেখক ও’ হেনরি
জেলখানাতে ও’ হেনরি তার ফার্মাসিস্ট লাইসেন্সের সুবাদে ফার্মেসিতে নিযুক্ত হন। এখানে রাতের পর রাত বসে দু’হাতে কলম চালাতে থাকেন তিনি। মেয়ের ভরণ-পোষণের নিমিত্তে লিখতে থাকেন ছোট ছোট গল্প। তার বন্ধুরা সে গল্প পৌঁছে দিত পত্রিকা অফিসে।
সাজার অপেক্ষায় থাকাকালীন ম্যাকক্লারি নামক এক ম্যাগাজিন ও’ হেনরির লেখা গল্প ‘মিরাকল অফ লাভা ক্যানিয়ন’ কিনে নিয়ে প্রকাশ করে। এখানে তার আসল নামই ব্যবহার হয়েছিল। তবে জেলখানায় বসে লেখা গল্পে ও’ হেনরি নিজ নাম ব্যবহারে ইতস্তত করলেন। পাঠকেরা একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির লেখা পড়তে না-ও চাইতে পারে ভেবে তিনি ছদ্মনামের প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৮৯৯ সালের ডিসেম্বরে ম্যাকক্লারি ম্যাগাজিন ও’ হেনরির জেলখানায় বসে লেখা প্রথম গল্প প্রকাশ করে, যার নাম ছিল ‘হুইসলিং ডিক’স ক্রিসমাস স্টকিং’। নিউ অরলিন্সের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এ গল্পের অবতারণা করেছিলেন। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে এইন্সলে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আরেকটি গল্পে নিজের নাম হিসেবে তিনি ‘অলিভিয়ের হেনরি’ হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রায় দশ-বারোটি ছদ্মনাম ব্যবহারের পর ও’ হেনরি নামে তিনি স্থির হলেন।
ও’ হেনরি
কেন এবং কীভাবে উইলিয়াম সিডনি পোর্টার ও’ হেনরি নামটির প্রতি আকৃষ্ট হন, তা নিয়ে কয়েকটি গল্প আছে। নিজের জীবদ্দশাতেও তিনি কয়েকবার কয়েকটি কাহিনীর কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেন, ও’ হেনরি আসলে পোর্টারের পরিচিত এক ফরাসি ফার্মাসিস্ট, এটিয়েন অসিয়ান হেনরির সংক্ষিপ্ত রূপ। আবার অনেকের ধারণা, শৈশবের পোষা বেড়াল হেনরি দ্য প্রাউড থেকেই ও’ হেনরির জন্ম। লেখক গাই ড্যাভেনপোর্টের মতে, ও’ হেনরি আসলে ওহাইয়ো জেল বা পেনিটেনশারির প্রতিনিধিত্ব করে।
সবথেকে প্রচলিত গল্প হলো, নিউ অরলিন্সে থাকাকালীন পোর্টার সহকর্মীদের সাথে প্রায়ই শহরের নানা রেস্তোরাঁয় যেতেন। টাইমস-পিকায়ুনের রিপোর্টার আর্নস্ট হপনারের সাথে একরাতে তিনি গিয়েছিলেন টোব্যাকো প্ল্যান্ট স্যালুনে। সেখানে ছিল বিশাল ভিড়। এত মানুষের পানের অর্ডার সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল বারটেন্ডার হেনরি। কাস্টমারেরাও প্রায়ই তাকে ডাকছিল, “ও হেনরি, আরেক গ্লাস দাও!” বলা হয় সেই থেকে ‘ও’ হেনরি’ নামটা গেঁথে যায় পোর্টারের মাথায়।
আরেকটি গল্প, যা তার নিজমুখে করা গল্পের একটি; সেখানে বলা আছে, লেখা ছাপানোর আগে ও’ হেনরি তার এক বন্ধুর সাথে ছদ্মনামের ব্যাপারে কথা বলছিলেন। যুতসই একটা নাম খুঁজতে তারা পত্রিকা খুলে বসেন। সেখান থেকে হেনরি নামটি তাদের মনে ধরল। একে শেষ নাম হিসেবে বেছে নিলেন তারা। বন্ধু পরামর্শ দিলেন, প্রথম নাম হিসেবে ইংরেজি কোনো অক্ষর ব্যবহার করতে। ‘ও’ লেখাটা সহজ বলে হেনরির আগে জুড়ে গিয়ে পোর্টার হয়ে গেলেন ও’ হেনরি। আরেক জায়গায় অবশ্য তিনি দাবি করেছেন, ‘ও’ হলো অলিভিয়েরের সংক্ষিপ্ত রূপ।
খ্যাতির শীর্ষ
ভালো ব্যবহারের সুবাদে তিন বছরের মাথায় ১৯০১ সালের ২৪ জুলাই ছাড়া পেয়ে যান তিনি। মেয়েকে দেখতে ছুটে গেলেন পিটসবার্গে।ততদিনে ছোটগল্পকার হিসেবে তার বেশ নামডাক হচ্ছে। একে কাজে লাগাতে পরের বছর তিনি পাড়ি দিলেন নিউ ইয়র্কে। এখানে প্রতি সপ্তাহে একটি গল্প লেখার বিপরীতে চুক্তিবদ্ধ হন নিউ ইয়র্ক সানডে ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের সাথে।পাশাপাশি অন্যান্য পত্রিকাতেও লেখা অব্যাহত থাকে।
ও’ হেনরির ছোটগল্পের প্রথম সংকলন, ক্যাবেজ অ্যান্ড কিংস বের হয় ১৯০৪ সালে। হন্ডুরাসে ছয়মাসের অভিজ্ঞতার থেকে গড়ে উঠেছিল এই বইয়ের গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট। ১৯০৬ সালে এল ‘দ্য ফোর মিলিয়ন’ এবং পরবর্তী বছর ‘দ্য ট্রিমড ল্যাম্প’ ও ‘হার্ট অভ দ্য ওয়েস্ট’। সবগুলো বই-ই তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। ১৯০৮-১০ সালের মধ্যে একে একে প্রকাশিত হলো আরো কয়েকটি সংকলন। ১৯১০ সালের প্রকাশিত গ্রন্থ হুইরলিগিগসে অন্তর্ভুক্ত ছিল ও’ হেনরির সম্ভবত সবথেকে মজার গল্প, ‘দ্য র্যানসম অভ রেড চিফ’। তার লেখার মূল আকর্ষণ ছিল চরিত্র চিত্রায়নের অভিনবতা এবং গল্পের চমকপ্রদ সমাপ্তি। ও’ হেনরির চরিত্ররা অযাচিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রায়ই উদ্ভাবন করত সৃজনশীল উপায়ের।
দ্য গিফট অভ দ্য ম্যাজাই
‘দ্য গিফট অভ দ্য ম্যাজাই’ সম্ভবত ও’হেনরির সবথেকে পরিচিত এবং জনপ্রিয় গল্প, এ লেখার শুরুতেই আগ্রহী পাঠকদের জন্য যেটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল পাঠ্যক্রমে থাকায় সেখানকার প্রায় সব শিশুই এর সাথে পরিচিত। আমাদের দেশেও একসময় নবম-দশম শ্রেণিতে এ গল্প পড়ানো হতো। বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত ছোটগল্পগুলোর একটি এটি।
গল্পটি ১৯০৫ সালে নিউইয়র্ক সানডে ওয়ার্ল্ডে প্রথম বের হয়। দ্য ফোর মিলিয়নে পরবর্তী সময়ে এটি সংকলিত হয়েছিল। ও’ হেনরির জীবনীলেখক ডেভিড স্টুয়ার্টের ভাষ্যে, এর জন্ম হয়েছিল ১৯০৫ সালের শরতে। সানডে ওয়ার্ল্ডের এক সম্পাদক মনে করছিলেন, ও’ হেনরির পেছনে যে অর্থ খরচ হচ্ছে, সে অনুপাতে লাভ হচ্ছে না। সুতরাং তিনি এ লেখককে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তি থাকায় ওয়ার্ল্ড চাইছিল তার থেকে আরো একটি লেখা। ও’ হেনরির তা জানা ছিল না। তিনি ওয়ার্ল্ডের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে ভেবে বসে ছিলেন। এমন সময় ক্রিসমাসের আগ দিয়ে তার দরজায় কড়া নাড়ল পত্রিকার বার্তাবাহক। তার উপর নির্দেশ, একটি লেখা নিয়ে আজই পত্রিকায় পৌঁছে দিতে হবে। এ লেখা যাবে ক্রিসমাসের বিশেষ সংখ্যায়।
দুই ঘণ্টার মধ্যে ও’ হেনরি নামিয়ে দিলেন ‘দ্য গিফট অভ দ্য ম্যাজাই’। তার লেখার ধারাই ছিল এমন। তিনি শুরু করতেন ডেডলাইনের একেবার শেষদিকে। কিন্তু তার লেখার হাত ছিল এতই ভাল যে সম্পাদকের তেমন কোনো কাটাছেঁড়াই করতে হতো না।
শেষ জীবন
লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তা ও’ হেনরির ব্যক্তিগত জীবনের দুর্ভাগ্য সরিয়ে দিতে পারেনি। মেয়ে মার্গারেট ৩৭ বছর বয়সে মায়ের মতোই যক্ষ্মায় মারা যান। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে শেষশয্যা থেকেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। স্ত্রীকে হারানোর পর ও’ হেনরি মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। মেয়ের মৃত্যু তাকে ঠেলে দেয় খাদের একেবারে কিনারায়। ১৯০৭ সালে সারাহ লিন্ডসে কোলম্যান নামে এক তরুণীর সাথে তার বিয়েও ছিল ক্ষণস্থায়ী।
ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতা থেকে প্রায়ই আকণ্ঠ মদ্যপান করতেন তিনি। ফলে তার শরীর খারাপ হতে থাকে। ১৯০৯ সালে জানা গেল, তার লিভার প্রায় নষ্ট। জন্মভূমিতে ফিরে এলেন তিনি। মনে আশা, আবহাওয়ার বদলে হয়ত শরীরে কিছুটা বল ফিরতে পারে। এতে কোনো উন্নতি না হলে ছয় মাস পর তিনি ফেরত যান নিউ ইয়র্ক।
১৯১০ সালের ২রা জুন, অত্যন্ত অসুস্থ ও’ হেনরিকে বন্ধুরা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে এলেন। কেবিনের বাতি যখন নার্স নিভিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন ও’ হেনরি বলে উঠলেন, “বাতি জ্বালিয়ে দাও। অন্ধকারের মধ্যে আমি বিদায় নিতে চাই না।” পরদিন সূর্যোদয়ের পর দিনের প্রখর আলোতে চলে গেলেন উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, কোটি কোটি পাঠকের হৃদয়ে থাকা ও’ হেনরি।
মূল্যায়ন
ছোটগল্পকার হিসেবে এ লেখকের জনপ্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করার মতো খুব বেশি লেখক এখন পর্যন্ত আসেননি। মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তার আরো কয়েকটি সংকলন প্রকাশিত হয়। তার প্রয়াণের পরবর্তী মাত্র দশ বছরে বিক্রি হয় তার লেখা পাঁচ মিলিয়ন বই। সংখ্যার বিচারে তার থেকে এগিয়ে ছিলেন কেবল রুডিয়ার্ড কিপলিং। আজও ও’ হেনরির গল্পের আবেদন এতটুকু কমেনি। অনেক সমালোচক তাকে সাহিত্যিক হিসেবে উঁচুমানের মনে না করলেও সাধারণ পাঠকের তাতে যেন বয়েই গেছে!
ও’ হেনরির পৈত্রিক বাড়ি পরিণত করা হয়েছে জাদুঘরে। প্রতি বছর বহু মানুষ সেখানে ঘুরতে যান। তার নামানুসারে প্রতি বছর জাতীয়ভাবে ছোটগল্পের জন্যে দেয়া হয় ও’ হেনরি পুরস্কার।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থেকে ও’ হেনরির মরণোত্তর ক্ষমার জন্যও অনেকে চেষ্টা করেছেন। নর্থ ক্যারোলিনার প্রাক্তন সিনেটর জেসে হেমস, ও’ হেনরি জাদুঘরের প্রধানসহ অনেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে এজন্য সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন। তবে মরণোত্তর ক্ষমা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুর্লভ। ফলে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
২০১২ সালে অধ্যাপক রাকম্যান এবং সাংবাদিক স্কট হ্যানসন প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমার জন্য আবেদন করেন। তবে তৎকালীন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট তাদের আবেদন খারিজ করে দেয়। রাকম্যান অবশ্য হাল ছাড়েননি। তিনি আশা করেন, কোনো না কোনো সময় তারা সফল হবেন। তবে ক্ষমা পান আর না-ই পান, লেখক ও’ হেনরি চিরকালই পাঠকহৃদয়ে সমাসীন থাকবেন কেবল তার লেখা দিয়েই।