(পর্ব ৮ এর পর থেকে)
“তাহলে কারা বার্লিন দখল করতে যাচ্ছে, আমরা, না মিত্রশক্তি?” (ঝুকভ ও লাল ফৌজের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে জোসেফ স্তালিন, ২ এপ্রিল, ১৯৪৫)
জুলাই, ১৯৪৪। লাল ফৌজ কর্তৃক পরিচালিত অপারেশন বাগ্রাতিয়ন সফল হয়েছে। ইউক্রেন ও বেলোরুশিয়া থেকে জার্মানরা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়েছে। সামরিক কৃতিত্বের জন্য মার্শাল ঝুকভ দ্বিতীয় বারের মতো ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পদকে ভূষিত হয়েছেন। লাল ফৌজের জন্য জার্মান–নিয়ন্ত্রিত পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়া আক্রমণের পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু জার্মানদের চূড়ান্ত পরাজয় হতে তখনো অনেক দেরি।
অপারেশন বাগ্রাতিয়নের মূল লক্ষ্য ছিল বেলোরুশিয়া পুনর্দখল করা, কিন্তু জার্মান আর্মি গ্রুপ সেন্টার ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লাল ফৌজ পূর্ব প্রাশিয়া এবং মধ্য ও দক্ষিণ পোল্যান্ডের দিকে ক্ষিপ্রগতিতে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ লাভ করে। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েতদের আক্রমণাভিযান কোনদিকে পরিচালিত হবে, সেটি নিয়ে মস্কোয় আলোচনা শুরু হয়। ১৯ জুলাই ঝুকভ স্তালিনের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করেন যে, বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সোভিয়েতদের পূর্ব প্রাশিয়া দখল করে নেয়া উচিত, কিংবা অন্ততপক্ষে জার্মানির মূল ভূখণ্ড থেকে অঞ্চলটিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা উচিত। জুলাইয়ের শেষে স্তালিন ও লাল ফৌজের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই প্রস্তাব নিয়ে বৈঠক করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, এই মুহূর্তে সোভিয়েতদের পক্ষে পূর্ব প্রাশিয়া অধিকার করা সম্ভব নয়।
এজন্য সোভিয়েতরা ওয়ারশ (পোল্যান্ডের রাজধানী) দখলের দিকে মনোনিবেশ করে। ২৭ জুলাই লাল ফৌজের ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্ট এবং পোলিশ কমিউনিস্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ১ম পোলিশ আর্মিকে ওয়ারশর প্রান্তে ও ভিশ্চুলা নদীর পূর্বে অবস্থিত প্রাগা আক্রমণ এবং নদীটির পশ্চিম তীরে ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ওয়ারশ অঞ্চলে জার্মানদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। ওয়ারশ জার্মানির রাজধানী বার্লিনের পথে অবস্থিত ছিল এবং এজন্য একে রক্ষা করা ছিল তাদের জন্য আবশ্যক। তারা পূর্ব রণাঙ্গনের অন্যান্য স্থান ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে জার্মান সৈন্যদের এই অঞ্চলে মোতায়েন করে এবং আর্মি গ্রুপ সেন্টারকে পুনর্নির্মাণ করে।
এদিকে সোভিয়েতদের আক্রমণ ক্রমশ গতি হারিয়ে ফেলছিল। সোভিয়েত সৈন্যরা ছিল ক্লান্ত, তাদের রসদপত্র সরবরাহের পথ ছিল শত শত মাইল বিস্তৃত এবং সোভিয়েত বিমানবাহিনীকে অগ্রবর্তী বিমানঘাঁটিগুলোতে মোতায়েন করার ফলে তাদের কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল যার ফলে জার্মান বিমানবাহিনী আংশিকভাবে পোল্যান্ডের আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ও পোলিশ সৈন্যরা ভিশ্চুলার পশ্চিম তীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও জার্মানদের তীব্র আক্রমণের মুখে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয় এবং প্রাগাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ৮ আগস্ট ঝুকভ ও রোকোসোভস্কি ওয়ারশ দখলের জন্য স্তাভকার কাছে একটি নতুন পরিকল্পনা পেশ করেন।
বুলগেরিয়া অভিযান: ঝুকভের সহজ বিজয়
অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে ঝুকভ এই অভিযানে জড়িত ছিলেন না। কারণ আগস্টের শেষদিকে স্তালিন তার ওপর অন্য একটি দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন অক্ষশক্তির সদস্য বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। বুলগেরিয়া জার্মান–নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু জার্মানদের নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেছিল। মার্শাল ফিয়োদোর তোলবুখিনের নেতৃত্বাধীন ৩য় ইউক্রেনীয় ফ্রন্টকে বুলগেরিয়া আক্রমণের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং ঝুকভকে এই অভিযান তত্ত্বাবধান করার জন্য প্রেরণ করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর ঝুকভ ও তোলবুখিন বুলগেরিয়া আক্রমণের জন্য তাদের পরিকল্পনা স্তাভকার কাছে পেশ করেন এবং ৫ সেপ্টেম্বর এটি অনুমোদন লাভ করে।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, লাল ফৌজের ৩টি আর্মি ও ২টি মেকানাইজড কোরের বুলগেরিয়া আক্রমণের কথা ছিল। ৫ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং কয়েক দিন পর ৩য় ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট বুলগেরিয়া আক্রমণ করে। কিন্তু কার্যত তাদেরকে তেমন কোনো লড়াই করতে হয়নি। বুলগেরিয়ার সিংহভাগ জনসাধারণ এবং বুলগেরীয় সশস্ত্রবাহিনীর সিংহভাগ ইউনিট লাল ফৌজকে ‘মুক্তিদাতা’ হিসেবে স্বাগত জানায়। ৯ সেপ্টেম্বর বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় সংঘটিত কমিউনিস্ট–পরিচালিত একটি অভ্যুত্থানে দেশটির জার্মানপন্থী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং নতুন বুলগেরীয় সরকার শীঘ্রই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
ভিশ্চুলা–ওডের অপারেশন: ঝুকভ কর্তৃক বলশেভিকদের পুরনো স্বপ্নের বাস্তবায়ন
এদিকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ সোভিয়েতরা প্রাগা দখল এবং ভিশ্চুলার পশ্চিমে ১ম পোলিশ আর্মির অবস্থান গড়ে তোলার উদ্দেশ্য পুনরায় প্রচেষ্টা চালায়। একই সময়ে ঝুকভকে পোল্যান্ডে প্রেরণ করা হয় এবং ১ম ও ২য় বেলোরুশীয় ফ্রন্টের সমন্বয়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সোভিয়েতরা প্রাগা দখল করতে সক্ষম হয়, কিন্তু ভিশ্চুলার পশ্চিমে ১ম পোলিশ আর্মির অবস্থান গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অক্টোবরের প্রথম দিকে সোভিয়েত আক্রমণ গতি হারিয়ে ফেলে এবং ১২ নভেম্বর সোভিয়েত সৈন্যদের আক্রমণ বন্ধ করে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একই দিনে ঝুকভকে ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।
নভেম্বরের প্রথমভাগে স্তালিন ঝুকভ ও লাল ফৌজের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল, ১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে লাল ফৌজ একটি মাল্টি–ফ্রন্ট কৌশলগত অভিযান চালাবে, যেটি তাদেরকে প্রথমে ভিশ্চুলা নদী থেকে ওডের নদী পর্যন্ত এবং এরপর বার্লিন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। ভিশ্চুলা–ওডের অভিযানে ঝুকভের ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্ট এবং কোনেভের ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের কথা ছিল। উত্তরে ২য় ও ৩য় বেলোরুশীয় ফ্রন্ট এবং দক্ষিণে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট তাদের সহায়ক হিসেবে নিযুক্ত ছিল। এক্ষেত্রে ঝুকভের দায়িত্ব ছিল ওয়ারশ দখল করা, সেখান থেকে পোজনান পর্যন্ত অগ্রসর হওয়া এবং এরপর বার্লিন অধিকার করা।
১৯৪৫ সালের ৮–১০ জানুয়ারি ভিশ্চুলা–ওডের অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিলম্বিত হয়। ১২ জানুয়ারি সোভিয়েতরা আক্রমণ শুরু করে। ঝুকভের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ওয়ারশ দখল করা। তিনি ভিশ্চুলা নদীর পশ্চিমে অবস্থিত ক্ষুদ্র সোভিয়েত ও পোলিশ অবস্থানগুলোকে ব্যবহার করে দক্ষিণ দিক থেকে ওয়ারশর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং জার্মানদের পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য করেন। সোভিয়েতদের পরিকল্পনা অনুসারে, ১৭ জানুয়ারি ১ম পোলিশ আর্মি প্রথম ওয়ারশ শহরে প্রবেশ করে এবং এরপর সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটিতে প্রবেশ করে।
ওয়ারশ অধিকার ছিল লাল ফৌজের জন্য প্রতীকীভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২০ সালে সোভিয়েত–পোলিশ যুদ্ধ চলাকালে মিখাইল তুখাচেভস্কির নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজ ওয়ারশর দোরগোড়ায় এক প্রচণ্ড যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। এই পরাজয় পশ্চিম দিকে বলশেভিকবাদের বিস্তারের সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ঝুকভ ওয়ারশ অধিকারের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে বলশেভিকবাদের বিস্তারের সম্ভাবনা পুনরায় উন্মুক্ত করে দেন। কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কেবল পোল্যান্ডে নয়, পূর্ব জার্মানিতেও কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওয়ারশ অধিকারের পর ঝুকভ ১২০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত পোজনানের দিকে অগ্রসর হন। কার্যত সোভিয়েত সৈন্যদের পোজনানে পৌঁছানোর কথা ছিল ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে, কিন্তু তারা এক সপ্তাহের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে যায়। ২৬ জানুয়ারি ঝুকভ স্তালিনের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করেন যে, তাদের উচিত জানুয়ারিতেই ওডের নদী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়া, একটি বিস্তৃত ফ্রন্ট বরাবর নদীটি অতিক্রম করা এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বার্লিনকে ঘিরে ফেলা। স্তালিন এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ঝুকভের ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্ট ওডের অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। কিন্তু জার্মানদের প্রতিরোধ ছিল তীব্র এবং এজন্য ঝুকভ গতি শ্লথ করতে বাধ্য হন।
বার্লিনের যুদ্ধ: নাৎসি জার্মানির প্রাণকেন্দ্রে ঝুকভের ঘূর্ণিঝড়
১০ ফেব্রুয়ারি ঝুকভ স্তালিনের কাছে বার্লিন দখলের জন্য তার পরিকল্পনা পেশ করেন এবং ১৯–২০ ফেব্রুয়ারিতে বার্লিন অধিকারের জন্য আক্রমণ শুরুর প্রস্তাব করেন। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি স্তাভকা তাকে আক্রমণ শুরু না করার জন্য নির্দেশ দেয়। এর কারণ ছিল: ঝুকভের ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্টের দক্ষিণে ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট দ্রুতগতিতে অগ্রসর হলেও উত্তরে ২য় বেলোরুশীয় ফ্রন্ট পিছে রয়ে গিয়েছিল, কারণ তারা পূর্ব প্রাশিয়ায় তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন ৩য় বেলোরুশীয় ফ্রন্টকে সাহায্য করছিল। এই পরিস্থিতিতে ঝুকভ যদি বার্লিন আক্রমণ করতেন, তাহলে পমেরানিয়ায় অবস্থানরত শক্তিশালী জার্মান সৈন্যদল উত্তর দিক থেকে ঝুকভের সৈন্যদলের ওপর আক্রমণ চালাতে পারত। এজন্য স্তাভকা ঝুকভকে বার্লিনের দিকে অগ্রসর না হয়ে উত্তর দিকে ঘুরে পমেরানিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেয়।
পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, কারণ কিছু কিছু সমরবিদ মনে করতেন যে, ঝুকভ যদি ফেব্রুয়ারিতেই বার্লিন আক্রমণ করতেন, তাহলে সোভিয়েতরা সহজেই শহরটি দখল করে নিতে পারত এবং পরবর্তীতে এটি অধিকারের জন্য তাদেরকে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হতে হতো না। কিন্তু পমেরানিয়ায় অবস্থানরত জার্মান সৈন্যদলটি যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং তাদেরকে পরাজিত করতে ঝুকভের ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্টের বাম বাহু এবং ২য় বেলোরুশীয় ফ্রন্টের ডান বাহুর প্রায় দুই মাস সময় লেগেছিল। এই সময়ে সোভিয়েত সৈন্যরা পমেরানিয়ায় ২০টির বেশি জার্মান ডিভিশন ধ্বংস করে দেয়, কিন্তু তাদের ৫০,০০০ সৈন্য নিহত ও ১,৭০,০০০ সৈন্য আহত হয় এবং তারা ৩,০০০ ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি পিস ও যুদ্ধবিমান হারায়। সুতরাং, ফেব্রুয়ারিতে ঝুকভের বার্লিন আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল।
অবশ্য পমেরানিয়ার লড়াই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ঝুকভের দৃষ্টি বার্লিনের ওপরেই নিবদ্ধ ছিল। মার্চের শেষদিকে তিনি স্তাভকার নিকট বার্লিন অধিকারের জন্য দুইটি প্রস্তাব পেশ করেন এবং যে কোনো একটি কার্যকর করার পরামর্শ দেন। এই প্রসঙ্গে স্তাভকার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য তিনি মস্কোয় যান। কিন্তু ইতোমধ্যে সোভিয়েত গুপ্তচররা সোভিয়েত সরকারকে জানায় যে, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাল ফৌজের আগেই বার্লিন দখল করে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কার্যত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি যতই ঘনিয়ে আসছিল, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ততই তীব্র হয়ে উঠছিল। বার্লিন দখলের জন্য উভয় পক্ষের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা ছিল এই দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ।
এই পরিস্থিতিতে ২ এপ্রিল স্তালিন ঝুকভসহ লাল ফৌজের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন এবং বার্লিন দখল করে এলবে নদী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার জন্য ঝুকভকে নির্দেশ দেন। এই আক্রমণে ঝুকভের ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্টের ভূমিকা হওয়ার কথা ছিল প্রধান, কিন্তু ১ম ইউক্রেনীয় ও ২য় বেলোরুশীয় ফ্রন্টও এই আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বার্লিন ছিল একটি অত্যন্ত কঠিন লক্ষ্যবস্তু। শহরটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৩০ মাইল গভীর ছিল এবং ৩টি প্রতিরক্ষা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। এই প্রতিরক্ষা অঞ্চলগুলো মেশিনগান নেস্ট, বাঙ্কার, স্ট্রংপয়েন্ট, গুপ্ত পরিখা ব্যবস্থা, ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী অবস্থান, আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক ও ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী কামানে পরিপূর্ণ ছিল। অগ্রবর্তী অঞ্চলগুলো মাইনক্ষেত্র দিয়ে ভরপুর ছিল এবং সোভিয়েতদের অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করার জন্য বহু অঞ্চল প্লাবিত করে দেয়া হয়েছিল। বৃহদাকৃতির ফ্ল্যাক টাওয়ারে মোতায়েনকৃত জার্মান বিমান–বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে স্থলযুদ্ধের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়েছিল। প্রায় ১০ লক্ষ জার্মান সৈন্য, ১,৫০০টি ট্যাঙ্ক ও অ্যাসল্ট গান এবং প্রায় ১০,০০০ আর্টিলারি পিস ও মর্টার বার্লিনকে রক্ষা করছিল।
জার্মানদের পরিকল্পনা ছিল: তারা যুদ্ধ করতে করতে একেকটি অঞ্চল থেকে পশ্চাৎপসরণ করবে এবং সম্ভব হলে বার্লিনে সোভিয়েতদের প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখবে। সেই সময় নাগাদ জার্মানরা দুই বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং এই ধরনের লড়াইয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। জার্মান সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই ছিল কিশোর বা বৃদ্ধ, কিন্তু সামগ্রিকভাবে জার্মানরা লাল ফৌজকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করে, কারণ পরাজয়ের চেয়ে সোভিয়েতদের প্রতিশোধকে তারা বেশি ভয় করছিল।
বার্লিন আক্রমণের জন্য ঝুকভ পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণের সময় পাননি, কিন্তু সীমিত সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ততটুকু যথাযথ প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তিনি চেষ্টা করেন। তার অধীনে ছিল ৭৭টি রাইফেল ডিভিশন, ৩,১৫৫টি ট্যাঙ্ক ও সেল্ফ–প্রোপেল্ড গান, ১৪,৬২৮টি আর্টিলারি পিস ও মর্টার এবং ১,৫৩১টি রকেট লঞ্চার। আক্রমণের জন্য সোভিয়েতরা ওডের নদীর ওপরে ৪০টি ফেরি ক্রসিং এবং ২৫টি সেতু নির্মাণ করে। ঝুকভের প্রকৌশলীরা বার্লিনের কেন্দ্রস্থলের নমুনা তৈরি করে এবং স্তালিনগ্রাদে যেরকম শহুরে যুদ্ধ হয়েছিল সেরকম যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মূল আক্রমণের প্রাক্কালে জার্মানদের দুর্বলতা যাচাই করার জন্য সোভিয়েতরা তাদের ওপর ছোট একটি আক্রমণও পরিচালনা করে।
১৯৪৫ সালের ১৬ এপ্রিল রাত ৩টায় জার্মানদের অবস্থানের ওপরে ১০ লক্ষেরও বেশি গোলা নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে ঝুকভের সৈন্যরা আক্রমণ শুরু করে। ৩টা ৩০ মিনিটে ঝুকভের নির্দেশে ১৪০টি সার্চলাইট জ্বালিয়ে সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রকে আলোকিত করে তোলা হয়। কিন্তু কুস্ট্রিন ও সিলো উচ্চভূমি অঞ্চল দখল করতে ঝুকভের সৈন্যদের প্রায় তিন দিন সময় লাগে এবং ইতোমধ্যে স্তালিন কোনেভের ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্টকে দক্ষিণ দিক থেকে বার্লিন আক্রমণের নির্দেশ দেন। এমতাবস্থায় বার্লিন দখলের জন্য ঝুকভ ও কোনেভের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। ২০ এপ্রিল ঝুকভের সৈন্যরা কুস্ট্রিন ও সিলো উচ্চভূমি অধিকার করতে সক্ষম হয় এবং তাদের কামান সরাসরি বার্লিনের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ঝুকভের ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্ট ও কোনেভের ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট একই সঙ্গে বার্লিনের উপকণ্ঠে প্রবেশ করে।
২৩ এপ্রিল স্তালিন বার্লিনে ঝুকভ ও কোনেভের সৈন্যদলগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে দেন এবং এর মধ্য দিয়ে বার্লিন অধিকারের জন্য তাদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছিল সেটির অবসান ঘটে। পরবর্তী সপ্তাহ জুড়ে তীব্র যুদ্ধের পর সোভিয়েত সৈন্যরা বার্লিন শহরের কেন্দ্রে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। কার্যত বার্লিনের প্রতিটি ভবন এবং প্রতিটি ব্লকের জন্য তাদেরকে লড়াই করতে হয়েছিল। অবশেষে ৩০ এপ্রিল ঝুকভের সৈন্যরা রাইখস্টাগ (জার্মান আইনসভা) ভবনের ওপরে সোভিয়েত পতাকা উত্তোলন করে এবং একই দিনে জার্মান নেতা হিটলার সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে বন্দিত্ব এড়ানোর জন্য আত্মহত্যা করেন। ২ মে বার্লিনের প্রতিরোধকারীরা আত্মসমর্পণ করে।
বার্লিনের যুদ্ধে সোভিয়েতরা অন্তত সাড়ে ৩ লক্ষ সৈন্য হারায়। অন্যদিকে, এই লড়াইয়ে অন্তত ৩,৭৫,০০০ জার্মান সৈন্য ও ১,২৫,০০০ বেসামরিক জার্মান নাগরিক নিহত হয় এবং প্রায় ৫ লক্ষ জার্মান সোভিয়েতদের হাতে বন্দি হয়। বার্লিন অধিকারের পরে ঝুকভ প্রথম যে কাজটি করেন সেটি হচ্ছে হিটলারের আত্মহত্যার তদন্ত করা। স্তালিন ও ঝুকভ হিটলারের আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্বাস করেননি এবং তাদের ধারণা ছিল, হিটলার হয়ত বার্লিন ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু সোভিয়েত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা হিটলারের দগ্ধ মৃতদেহের বিস্তৃত পরীক্ষানিরীক্ষার পর নিশ্চিত করেন যে, হিটলার প্রকৃতপক্ষেই আত্মহত্যা করেছেন।
জার্মানির আত্মসমর্পণ এবং মস্কোর বিজয় প্যারেডে ঝুকভ
৯ মে বার্লিনের কার্লশোর্স্টের একটি ভিলায় জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসি প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ফিল্ড মার্শাল ভিলহেলম কেইটেল জার্মানির পক্ষে আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মার্শাল গিওর্গি ঝুকভ। ঝুকভের আত্মজীবনী অনুযায়ী, জার্মানির আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর সোভিয়েত জেনারেলরা আক্ষরিক অর্থেই নাচতে শুরু করেছিলেন এবং ঝুকভ নিজেও এই ‘নৃত্যোৎসবে’ অংশ নেন! উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত রাশিয়া ও অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রে ৯ মে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়।
১৯ মে ঝুকভ মস্কোয় ফিরে যান এবং সেখানে তিনি জানতে পারেন যে, স্তালিন তাকে জার্মানিতে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদলের অধিনায়ক ও ‘মিত্রপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ পরিষদে’ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ৩০ মে ঝুকভ তার নতুন দায়িত্বে যোগদান করেন এবং ৯ জুন বার্লিনে অনুষ্ঠিত একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি সোভিয়েত ও বিদেশি সাংবাদিকদের একটি বিস্তৃত সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।
জুনের মাঝামাঝি ঝুকভ মস্কোয় ফিরে আসেন এবং তাকে তৃতীয়বারের মতো ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পদকে ভূষিত করা হয়। ২৪ জুন মস্কোয় একটি বিরাট বিজয়সূচক প্যারেড আয়োজিত হয় এবং সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিটি শাখার প্রতিনিধিরা এই প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। এই প্যারেডে ঝুকভ ঘোড়ায় চড়ে সৈন্যদের অভিবাদন গ্রহণ করেন। এটি ছিল ঝুকভের জন্য এক চরম গৌরবময় মুহূর্ত। কিন্তু প্যারেডের পর ক্রেমলিনে ২,৫০০ সোভিয়েত সামরিক কর্মকর্তার জন্য যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, সেটিতে স্তালিনের বক্তব্য ছিল ঝুকভের আসন্ন পরিণতির ইঙ্গিত, যদিও সেসময় ঝুকভ হয়তো ব্যাপারটির তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেননি। এই অনুষ্ঠানে স্তালিন জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়কে জেনারেলদের প্রতি নয়, বরং লক্ষ লক্ষ ‘ক্ষুদ্র মানবে’র প্রতি উৎসর্গ করেন, যাদের ওপর নির্ভর করে তিনি এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন।
এর চার দিন পর স্তালিনকে ‘জেনারেলিসিমো’ পদে ভূষিত করা হয়। ঝুকভ এবং অন্যান্য শীর্ষ সোভিয়েত সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে স্তালিনের প্রচ্ছন্ন বার্তা ছিল স্পষ্ট: তারা বিজয় গৌরবে নিজেদেরকে গৌরবাম্বিত ভাবতেই পারেন, কিন্তু স্তালিনই এখন পর্যন্ত সর্বেসর্বা। অবশ্য ঝুকভের তখন এতকিছু বোঝার সময় ছিল না। জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল, কিন্তু ক্রমশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিন্ন ধরনের একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছিল– স্নায়ুযুদ্ধ। পরবর্তী বছরগুলোতে ঝুকভকে এই লড়াইয়ের দিকেই তার মনোযোগ নিবদ্ধ রাখতে হবে।
(এরপর দেখুন ১০ম পর্বে)