আধুনিক বিজ্ঞান আজকের পৃথিবীর মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য এবং পৃথিবীকে দূষণমুক্ত একটি গ্রহে পরিণত করতে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। কৃষিজমি যেহেতু দিন দিন কমে যাচ্ছে, তাই মানুষের জন্য অন্যতম বড় একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অল্প জমিতেই অনেক বেশি ফসল উৎপাদন, এবং এমন প্রযুক্তি নিয়ে আসা যা একইসাথে পরিবেশেরও ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনবে অনেকাংশে। আর শুধু কৃষিজাত পণ্যেই যেহেতু পুষ্টির চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়, সাথে তাই মৎস্যজাত ও গৃহপালিত পশুর থেকে পাওয়া অন্যান্য খাদ্যের উৎসেরও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা জরুরি। বিজ্ঞানের উন্নতির কল্যাণে এখন এমন প্রযুক্তি আমাদের রয়েছে যেখানে মাছ চাষ এবং বিভিন্ন ফসল ও সবজির উৎপাদন একই সাথে করা সম্ভব হচ্ছে। এমনই এক প্রযুক্তির নাম অ্যাকোয়াপনিক্স, যেখানে টেকসই জৈব ফসল উৎপাদন এবং জলজ প্রাণীর চাষ করা যাচ্ছে একসাথে।
অ্যাকোয়াপনিক্স
অ্যাকোয়াপনিক্স হলো অ্যাকোয়াকালচার ও হাইড্রোপনিক্সের সংমিশ্রণ। অ্যাকোয়াকালচার মানে বদ্ধ জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাছ ও জলজপ্রাণীর চাষ, এবং হাইড্রোপনিক্স মানে মাটি ছাড়াই পানিতে প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট প্রদানের মাধ্যমে গাছের ফলন ঘটানো। অ্যাকোয়াপনিক্সে এই দুই পদ্ধতির মাঝে একটি সিম্বায়োটিক সংমিশ্রণ তৈরি করা হয়, যেখানে গাছপালার জন্য পুষ্টির যোগান দেয় জলজ প্রাণীদের বর্জ্য আর গাছের দ্বারা পানি পরিশুদ্ধ হয়ে পুনরায় মাছ চাষের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। মাছ এবং তাদের বর্জ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের আণুবীক্ষণিক জীবও গাছের জন্য নিউট্রিয়েন্টের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের উপকারী ব্যাকটেরিয়া গাছের শিকরের মধ্যবর্তী অংশে জড়ো হয় এবং মাছের বর্জ্য ও পানিতে থাকা বিভিন্ন কঠিন পদার্থকে এমন পদার্থে রূপান্তরিত করে যা উদ্ভিদ তার বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে পারে। ফলশ্রুতিতে অ্যাকোয়াকালচার এবং উদ্ভিদ চাষের মধ্যে একটি নিখুঁত সংমিশ্রণ তৈরি করা যায়। মাছের বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা যায় এবং সাগরে ফেলার পরিবর্তে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা যায়। এমনকি পানির ব্যবহার কমিয়ে একটি বদ্ধ ব্যবস্থায় জল পুনঃপ্রবর্তন করা যায়।
সারা বছরের জন্য যেকোনো জলবায়ুতে অ্যাকোয়াপনিক্স টেকসইভাবে একটি পরিবারের জন্য তাজা মাছ এবং শাকসবজি সরবরাহ করতে সক্ষম। এমনকি একটি গ্রামের বসবাসকারী মানুষের জন্য বা বাণিজ্যিক কৃষি উদ্যোগে মুনাফা অর্জনের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, অ্যাকোয়াপনিক্স হলো সারা বছর ইনডোর ফার্মিংয়ের একটি দুর্দান্ত উদাহরণ। এটি যেকোনো জায়গায় করা যেতে পারে, যা তাজা স্থানীয় খাবার সরবরাহ করে যা কীটনাশক, হার্বিসাইড এবং রাসায়নিক সারমুক্ত। এটা নিরাপদ, সহজ, এবং মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী!
অ্যাকোয়াপনিক্সের উপযোগী মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী
এই ধরনের জলজ চাষে বিভিন্ন মিঠা পানির মাছ ব্যবহৃত হয়, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো তেলাপিয়া এবং বারামুন্ডি। কারণ তারা বৈচিত্র্যময় জলের অবস্থা সহ্য করতে পারে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে নিম্ন জলের তাপমাত্রার জন্য ট্রাউট (Trout) ধরনের মাছ চাষ করা যেতে পারে। অন্যান্য জলজ প্রাণীর মধ্যে শামুক এবং চিংড়িও চাষ করা যায়।
মাছকে বিশেষ ধরনের খাবার খাওয়ানো যায় যা পশুখাদ্যের দোকানে কিনতে পাওয়া যায় বা অন্যান্য খাবার যেমন জলের লেটুস এবং ডাকউইড ইত্যাদিও মাছের বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা যায়।
যে ধরনের উদ্ভিদের ফলন সম্ভব
অ্যাকোয়াপনিক্স সিস্টেমের জন্য যে ধরনের মাছ এবং গাছপালা নির্বাচন করা হবে, তাদের তাপমাত্রা এবং পিএইচ চাহিদা একইরকম থাকা উচিত। একটি সাধারণ নিয়ম হিসেবে উষ্ণ, তাজা জলের মাছ এবং পাতাযুক্ত ফসল, যেমন- লেটুস, সবুজ শাক এবং ভেষজ সাধারণত সব থেকে ভালভাবে খাপ খাওয়াতে পারে।
বেশিরভাগ বাণিজ্যিক চাষী পাতাযুক্ত ফসল ফলান, তবে অ্যাকোয়াপনিক্সে সব ধরনের গাছপালাই ফলানো যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লেটুস, সুইস চার্ড, কেল, কলার্ড, ভেষজ, গোলমরিচ, টমেটো, শসা, বিট, মূলা, গাজর, সবুজ পেঁয়াজ, মটরশুঁটি, মটর, কোহলরবি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, ফুলকপি, সূর্যমুখী, ভোজ্য ফুল, এবং ঘৃতকুমারী ইত্যাদি ফসলের নাম। এমনকি অ্যাকোয়াপনিক্স সিস্টেমে বিভিন্ন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফলের গাছ, যেমন- কলা, কমলা, লেবু, এবং ডালিম ইত্যাদি সারা বছরই জন্মানো যায়!
অ্যাকোয়াপনিক্সে ব্যবহৃত কয়েকটি প্রাথমিক পদ্ধতি
-
ডিপ ওয়াটার কালচার (ডিডব্লিউসি): ডিডব্লিউসি বা ভেলাভিত্তিক পদ্ধতিতে একটি ফোমের ভেলা ব্যবহার করা হয় যা মাছের বর্জ্য জলে ভরা একটি চ্যানেলে ভাসমান থাকে, যে জল কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য ফিল্টার করা হয়। বিভিন্ন গাছপালা ভেলার গর্তে স্থাপন করা হয় এবং যার শিকড়গুলো জলে অবাধে ঝুলে থাকে। এই পদ্ধতিটি সালাদ জাতীয় শাক এবং অন্যান্য দ্রুত বর্ধনশীল, অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিকর উদ্ভিদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এটি বড় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও বেশি ব্যবহৃত হয়।
-
মিডিয়াভিত্তিক অ্যাকোয়াপনিক্স: মিডিয়ার বৃদ্ধি জড় প্লান্টিং মিডিয়ার (প্রসারিত ক্লে পিলেট কিংবা শেল) মধ্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধির সাথে জড়িত। মিডিয়াটি একই সিস্টেমে জৈবিক পরিস্রাবণ (অ্যামোনিয়া থেকে নাইট্রেটে রূপান্তর) এবং যান্ত্রিক পরিস্রাবণ (কঠিন বর্জ্য অপসারণ) উভয়ই করে থাকে। মিডিয়াভিত্তিক সিস্টেমগুলো বাড়িতে কিংবা শখের বশে করা সিস্টেমগুলোর জন্য দুর্দান্ত, যাতে বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব। বিশেষ করে, কিছুটা বড় আকারে ফলদায়ক গাছপালা, শাক-সবজি, ভেষজ এবং অন্যান্য জাতের উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক।
-
নিউট্রিয়েন্ট ফিল্ম টেকনিক (এনএফটি): এনএফটি সিস্টেমগুলো পিভিসি পাইপের মতো একটি সরু নলের মধ্য দিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ পানি প্রবাহিত করে। গাছপালা এই পাইপে ছিদ্র করা গর্তে স্থাপন করা হয় এবং এই জলের স্রোতে শিকড়গুলো অবাধে ঝুলে থাকে। স্ট্রবেরি এবং অন্যান্য গুল্মের মতো সামান্য সমর্থনের প্রয়োজন— এমন উদ্ভিদের জন্য এই পদ্ধতি খুব ভাল কাজ করে। এনএফটি অব্যবহৃত স্থান ব্যবহার করার একটি দুর্দান্ত উপায়, কারণ সেসবে উদ্ভিদের ফলন যেকোনো জায়গায় সিলিং থেকে ঝুলিয়ে করা যেতে পারে।
-
ভার্টিক্যাল অ্যাকোয়াপনিক্স: অ্যাকোয়াপনিক্সের সবচেয়ে উপকারী দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো- খুব ছোট এলাকায় অবিশ্বাস্য পরিমাণে খাবার ফলানোর ক্ষমতা। ভার্টিক্যাল অ্যাকোয়াপনিক্স এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। এক্ষেত্রে টাওয়ার সিস্টেমে গাছপালা একে অপরের ওপর ফলানো হয়। টাওয়ারের উপরের দিক দিয়ে জল প্রবাহিত হয় এবং একটি ছিদ্রযুক্ত কাঠামোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেখান থেকে গাছের শিকড়গুলো পানি এবং পুষ্টি শোষণ করে নেয়। জল তারপর একটি খাঁড়িতে বা সরাসরি মাছের ট্যাঙ্কে পড়ে। কৃষির এই রূপটি প্রতিটি বর্গ ফুট জায়গার সর্বাধিক ব্যবহার করে এবং পাতাযুক্ত সবুজ শাক, স্ট্রবেরি এবং অন্যান্য ফসল— যেগুলোর বৃদ্ধির জন্য সমর্থনের প্রয়োজন হয় না এমন ক্ষেত্রে খুব ভালভাবে কাজ করে।
অ্যাকোয়াপনিক্সের উপকারি দিকসমূহ
- অ্যাকোয়াপনিক্স হলো একই সময়ে মাছ এবং সবজি চাষের একটি উপায়। মাছকে খাবার দেওয়া হয় এবং মাছের বর্জ্য আউটপুট হিসেবে পানিতে মিশে গাছপালার পুষ্টির চাহিদা মেটায়।
- সার ব্যবহার করার দরকার নেই। কারণ, মাছ গাছের জন্য প্রচুর পুষ্টি সরবরাহ করে।
- অ্যাকোয়াপনিক্সে ফসলের জন্য কম পানি ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অ্যাকোয়াপনিক্স বাগানগুলোতে মাটিতে করা বাগানের জন্য যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হয়, তার ১/১০ ভাগ পানি লাগে।
- বাগানে নিয়মিত কীটনাশক বা অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করা যায় না। কারণ, তাতে মাছের ক্ষতি হতে পারে।
- এর ফলে স্বাস্থ্যকর এবং জৈব সবজি পাওয়া যায়।
- অ্যাকোয়াপনিক্সে কোনো মাটিবাহিত রোগের সম্মুখীন হতে হয় না, কারণ সেখানে কোনো মাটি নেই।
- খুব ছোট জায়গায় গাছপালা ফলানো যায় এবং ভাল ফসল পাওয়া যায়।
- গাছপালা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কারণ, তারা মাছের বর্জ্য থেকে খুব পুষ্টিকর খাদ্য পেয়ে থাকে।
- নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও পরিবেশে গাছপালা ও মাছ উৎপাদন করা যায়।
- পানি একটি বদ্ধ সিস্টেমে ব্যবহার করা হয় এবং কার্যকরভাবে সঞ্চালিত হয়, ফলে পানি ব্যবহারের খরচ হ্রাস পায়৷
- সর্বোপরি, অ্যাকোয়াপনিক্স একটি টেকসই এবং অত্যন্ত উৎপাদনশীল পদ্ধতি এবং এখানে উৎপাদিত মাছ গ্রোথ হরমোন এবং অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশেও নানা পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অ্যাকোয়াপনিক্সের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিকের ড্রাম পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের ড্রাম লম্বালম্বিভাবে কেটে অর্ধেক করা হয়। এরপর নুড়ি, পাথর ও মাটি স্তরে স্তরে রেখে কচু, পেঁপে, ও বেগুন ইত্যাদির চারা রোপণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে মাছের চাষের ময়লা পানি প্রতিদিন দুবার করে ড্রামের নুড়ি পাথরের মাঝে দেওয়া হয় পাম্প করার মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় গাছের শিকড় প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে এবং পরিষ্কার পানি পুনরায় মাছের ট্যাংকে ফিরিয়ে আনা হয়। এ পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন অনেক লাভজনক ও কৃষকদের জন্য সহজে গ্রহণ করাও সম্ভব।
বাংলাদেশে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)-তে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষে গবেষণা ও পরীক্ষণ করা হয়েছে। মাটি ও সারের প্রয়োজন না হলেও মাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।