আকর্ষণশক্তিটা সম্ভবত তার চোখ দুটোর কোণে লুকানো। মাত্র একবার সেই চোখ দুটোর দিকে তাকালেই নজর ফিরিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। হঠাৎ মনে হবে দম বন্ধ হয়ে আসছে, তা-ও আপনি মুহূর্তের জন্যও চোখের পলক ফেলতে পারবেন না। কারণ, ততক্ষণে আপনি নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছেন। এতটাই অসীম ক্ষমতা সেই চোখ দুটোর!
যার চোখ নিয়ে বলছিলাম— তিনি টনি লিউং। পুরো নাম টনি লিউং চিউ-ওয়াই। যদি আপনি সত্যিকার অর্থেই সিনেমা ভালোবাসেন, একজন সত্যিকারের সিনেমাপ্রেমী হয়ে থাকেন, তাহলে নামটির সঙ্গে অপরিচিত হওয়ার কথা না। কেনই বা অপরিচিত হবেন? সিনেমা ভালোবাসেন, অথচ টনি লিউংকে চেনেন না, এটা একপ্রকার অপরাধই ধরা যায়। তিনি তো শুধু এশিয়ায় নয়, গোটা বিশ্বের সেরা অভিনেতাদের একজন। তার প্রায় প্রতিটি সিনেমা দেখে আপনি তার অভিনয়সত্তাকে নতুন করে জানবেন, বারবার মুগ্ধ হবেন।
শৈশব
শৈশবটা খুব সুখকর ছিল না তার। বড় হয়েছেন ৬০-এর দশকে, হংকংয়ে। তার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর, তখন জুয়াড়ি বাবা পরিবারকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে অন্যত্র চলে যান। এর পূর্বেও তাকে নিয়মিত বাবা-মায়ের ঝগড়ার সাক্ষী হতে হয়। বাবার উপর ভরসা কখনোই না থাকলেও বাবা ছাড়া বড় হতে হবে এটা সম্ভবত টনি মেনে নিতে পারেননি। এটা ছিল তার জীবনের বড় একটা ধাক্কা, যার ফলস্বরূপ তিনি একদম বদলে যান। সবসময় দুষ্টুমিতে মেতে থাকা এক শিশু থেকে পরিণত হন একদম চুপচাপ স্বভাবের একজনে। স্কুলে কথাবার্তা বলাও একেবারে বন্ধ করে দেন। সেটা ক্ষোভে নাকি দুঃখে তা একমাত্র তিনিই জানেন।
টনিরা ছিলেন এক ভাই, এক বোন। বাবা চলে যাওয়ার পর, একা মায়ের নিরলস পরিশ্রমে বেড়ে ওঠেন তারা। পরে ২০০২ সালে তার হিরো নামক চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় এক সাক্ষাৎকারে তাকে ‘হিরো’ শব্দের সংজ্ঞা দিতে বললে তিনি সহজ ভাষায় বলেন, ‘আমার মা’। তবে, মায়ের শত চেষ্টা সত্ত্বেও সংসারের টানাপোড়েনে তার পড়ালেখা খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি।
সংসারের হাল ধরতে তাই টনি স্কুল ছেড়ে এক রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেন। কিন্ত, তার নিজের ভবিষ্যত বলেও তো একটা বিষয় রয়েছে। রেস্তোরাঁর সামান্য বেতনে তো সংসারই ঠিকমতো চলে না। তখন তার বয়স মাত্র ১৬। হঠাৎ একদিন ভাগ্যক্রমে দেখা হয় শাওলিন সকারখ্যাত তারকা স্টিফেন চাওয়ের সাথে। অবশ্য তখন স্টিফেন চাও-ও বেকার ছিলেন। চাওয়ের অনুপ্রেরণায় তিনি একটি অডিশন দিতে রাজি হলেন, অডিশন দিয়ে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিতও হয়ে গেলেন।
উত্থান
অডিশন দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর ছোটখাট অনুষ্ঠানে কাজ করতে করতে সুযোগ পেয়ে গেলেন হংকংয়ের ছোটপর্দার স্বর্গ টিভিবি-তে। টিভিবি-কে বলা হয় হংকং সিনেমার অ্যাকাডেমি। হংকং-এর প্রায় সকল অভিনেতাই টিভিবি থেকে ইন্ডাস্ট্রিতে উঠে এসেছেন। টিভিবি থেকে যারা আসেন তাদের অভিনয়ও দারুণ হয়, কারণ টিভিবিতে তখন শুধু আজকালকার মতো তথাকথিত ‘ফ্লাওয়ার বয়েজ’দের নিয়ে নাটক হতো না। তখন টিভিবিতে একইসাথে মানসম্মত নাটক হতো, আবার নতুনদের অভিনয়ও শেখানো হতো। টিভিবিতে অভিনয় করতে করতে টনি লিউং চিউ-ওয়াই বনে যান সেখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখদের একজন। এরপর অন্য সবার মতো টিভিবি থেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসেন টনি। এসেই যে রাজত্ব করতে শুরু করেন, তা নয়। শুরুতে পার্শ্ব-অভিনেতার ভূমিকায় কাজ করতে লাগলেন। এখানেও বাজিমাত। ‘পিপল’স হিরো’ ও ‘মাই হার্ট ইজ দ্যাট ইটার্নাল রোজ’-এ অভিনয়ের জন্য যথাক্রমে ১৯৮৮ এবং ১৯৯০ সালে জিতে নেন হংকংয়ের অস্কার খ্যাত হংকং ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসে সেরা পার্শ্ব-অভিনেতার পুরষ্কার।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি
তাইওয়ানের বিখ্যাত পরিচালক হাউ সিয়াও-সেন নির্মিত ‘অ্যা সিটি অভ স্যাডনেস’ ১৯৮৯ সালে মুক্তি পেলে টনি প্রথমবারের মতো হংকংয়ের বাইরে খ্যাতি লাভ করেন। চলচ্চিত্রটি নির্মিত ১৯৪৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারির ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে। চলচ্চিত্রটি ছিল মান্দারিন ভাষায়। কিন্ত, টনি মান্দারিন জানতেন না। তবুও, হাউ সিয়াও-সেন টনিকেই প্রধান চরিত্রের জন্য পছন্দ করেন। তিনি টনির মাঝে এমন কিছু দেখতে পেয়েছিলেন, যা অন্য আর কারো মধ্যে খুঁজে পাননি। তাই, টনির যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য তিনি চরিত্রকে একাধারে বোবা ও বধির বানিয়ে দেন। সেই বছর ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অ্যা সিটি অভ স্যাডনেস’ সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার তথা গোল্ডেন লায়ন জেতে, আর সমালোচকরা মুগ্ধ হন টনির অসাধারণ অভিনয়ে। পরবর্তীতে অবশ্য টনি লিউং আর হাউ সিয়াও-সেন আরেকবার একসাথে কাজ করেন, সেটা ‘ফ্লাওয়ার্স অব সাংহাই’ চলচ্চিত্রে।
ব্রেকথ্রু রোল
‘অ্যা সিটি অভ স্যাডনেস’ টনিকে প্রথমবারের মতো আন্তজার্তিক খ্যাতি এনে দিলেও অনেকে মনে করেন জন ইউ নির্মিত ১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হার্ড বয়েল্ড’-এ তার রোল তার ক্যারিয়ারের ব্রেকথ্রু রোল। ‘হার্ড বয়েল্ড’-এ তিনি আরেক অভিনেতা চাও ইয়ান ফ্যাটের পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করলেও সব লাইমলাইট নিজের দিকে টেনে নেন। সেখানে একটি দৃশ্য রয়েছে, যেখানে টনির চরিত্র ভুলবশত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করে, সেই দৃশ্যে তার প্রতিক্রিয়া একজন অভিনেতা হিসেবে তার সব গুণকে তুলে ধরে।
ওং কার-ওয়াই ও টনি লিউং
টনি তার ক্যারিয়ারে পরিচালকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার কাজ করেছেন ওং কার-ওয়াইয়ের সাথে। ওং কার-ওয়াইও অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন টনি লিউংয়ের সাথে। ওং কার-ওয়াই এখন পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মোট দশটি, যার সাতটিতে টনি অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ডেইজ অভ বিয়িং ওয়াইল্ডে, ক্যামিও রোল ও অ্যাশেজ অব টাইমে পার্শ্ব-ভূমিকা বাদে বাকি সবগুলোতে প্রধান চরিত্র হিসেবে রয়েছেন তিনি। শুরুতে ওংয়ের ‘Main Man’ আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা লেজলি চিউং হলেও পরবর্তীতে সেই জায়গা নিয়ে নেন টনি লিউং। টনি ও ওং দুজনে যেন একে অপরের পরিপূরক। তাদের একত্রে নির্মিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো ইন দ্য মুড ফর লাভ, হ্যাপি টুগেদার, ২০৪৬, এবং চাংকিং এক্সপ্রেস। বলা বাহুল্য, ‘দ্য গ্র্যান্ডমাস্টার’ বাদে বাকি ওংয়ের বাকি যে কয়টি চলচ্চিত্রে টনি মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, প্রতিটির জন্য তিনি হংকং ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’-এর জন্য তিনি ২০০০ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতা নির্বাচিত হন।
ইনফার্নাল অ্যাফেয়ার্স ট্রিলজি
যদি জিজ্ঞেস করা হয়, একবিংশ শতাব্দীতে হংকংয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী চলচ্চিত্রের নাম কী? উত্তরটা খুবই সহজ, ‘ইনফার্নাল অ্যাফেয়ার্স’। ২০০৩ সালে একই ট্রিলজির অন্য দুটি চলচ্চিত্রের সাথে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্র রীতিমতো হংকং সিনেমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। দুই পরিচালক অ্যালান মাক ও অ্যান্ড্রু লাউ কর্তৃক নির্মিত ট্রিলজির প্রথম ও শেষ পর্বে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন টনি লিউং। প্রথমটিতে অভিনয়ের জন্য জিতে নেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। পরবর্তীতে কিংবদন্তি পরিচালক মার্টিন স্করসেসি ‘দ্য ডিপার্টেড’ নামে ট্রিলজিটি পুনরায় নির্মাণ করেন, যেখানে টনি লিউংয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও।
অভিনয় যখন চিকিৎসা
“অভিনয় সবসময় আমার ক্ষেত্রে নিজের লুকায়িত আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হয়ে এসেছে। যদি আমি অভিনয় না করতাম, তাহলে আমি হয়তো পাগল হয়ে যেতাম। আমাদের অভিনয় ক্লাস চলাকালে আমি কান্না করার সুযোগ পেতাম, অন্যরা ভাবতো আমি অভিনয় করছি। কিন্ত না, আমি সত্যিই কাঁদতাম।”
টনির জন্য অভিনয় শুধুই অভিনয় নয়, বরং এর চেয়ে বেশিকিছু। ৬ বছর বয়সে বাবা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সেই লাজুক ছেলেতে পরিণত হওয়া, যে কিনা কখনো নিজের আবেগ প্রকাশ করতো না, যে নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতে চাইত, অভিনয় জগতে পদার্পণের পর অবশেষে সেসব সময়ের চাপা ক্ষোভ, চাপা দুঃখের প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পায় সেই ছেলেটি। অভিনয় তাকে সেই সুযোগ করে দেয়। অভিনয়কে তাই বাস্তবতার সাথে তার ‘Coping Mechanism’ বলা যেতে পারে।
বহুমুখীতা
টনি তার ক্যারিয়ারে একাধারে মেইনস্ট্রিম ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ইন্ডি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে এসেছেন। হংকং সিনেমা যখন সাফল্যের চূড়ায়, প্রতি বছরে সেখানে প্রায় ২০০টির মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, তখন একজন তারকা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। ১ বছরে ৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, এরকম নজিরও রয়েছে তার। চরিত্রের প্রয়োজনে হয়েছেন প্রণয়কাতর পাণিপ্রার্থী থেকে শুরু করে পুলিশ, গুণ্ডা, সাংবাদিক, লেখক, কবি, আলোকচিত্রকর, খুনি, ও ভিক্ষু। তার অমায়িক বৈশিষ্ট্যগুলো রোমান্টিক ধারার জন্য একজন নিখুঁত অভিনয়কারী বানালেও, তিনি সেগুলো আড়াল করে একইসাথে হিংস্র, বর্বর চরিত্রেও অভিনয়ে পটু। যেকোনো চরিত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করতে প্রতিদিন তিনি চল্লিশ-পঞ্চাশবারের মতো সেই চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট পড়েন, এমন অধ্যবসায়ী এক অভিনেতা তিনি ।
“আমি একজন অভিনেতা হতে চাই, মানুষজনের শ্রদ্ধার পাত্র কিংবা একজন তারকা হতে চাই না, শুধু একজন সাধারণ অভিনেতা হিসেবেই থাকতে চাই।”
খ্যাতি কিংবা অর্থের লোভ তাকে কোনোদিন গ্রাস করতে পারেনি। তাই তো অন্য এশীয় অভিনেতারা যেখানে হলিউডে এসে সচরাচর এশীয়দের নিচু করে দেখানো ভূমিকাগুলোয় অভিনয় করেন, সেখানে তিনি এশীয়দের নিচু করে দেখায় এমন যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করতে একেবারে নারাজ। সেজন্য স্টুডিওগুলো তাকে যত মোটা অঙ্কের প্রলোভনই দেখাক না কেন। তাই তো ২০০৫ সালে একজন আমেরিকান এজেন্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেও দীর্ঘ ১৫ বছর পর ‘শ্যাং চি এন্ড দ্য লিজেন্ড অভ দ্য টেন রিংস’-এ অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো হলিউডে পদার্পণ করেন তিনি।
টনি লিউং চিউ-ওয়াই জীবনের সংগ্রাম থেকে শুরু করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সংগ্রাম কোনো কিছুতেই হারেননি। তিনি সবসময়ই জিতে এসেছেন, তবে সেটা বিনয়ের সাথে। সেই ১৯৮৯ সালে সারিনা লাউয়ের সাথে প্রেম, ২০২১ সালে এসেও তারা একসাথে। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে একসাথে। মাঝে সারিনা লাউয়ের অপহরণ, আপত্তিকর ছবি প্রকাশ হওয়া, এগুলোকেও জয় করে জীবনযাপন করেছেন টনি, কিন্তু তারপরেও কোনো একটা কিছু এখনও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনও তিনি বলেন, জীবন থেকে অনেক কিছু পাওয়ার ছিল তার, কিন্তু জীবন তাকে সেটা দেয়নি। থাক না কিছু না পাওয়া, জীবনে সবসময় কিছু না পাওয়া রয়েই যায়। স্বয়ং টনি হয়তো সেটা আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন, ভালো জানেন। তবে তাদের মতো মানুষ শত বছরে একবার আসে- এটা চিরন্তন সত্য। তারা নিজেদের প্রতিটি পদক্ষেপে স্থাপন করে যান দৃষ্টান্ত, অনুপ্রাণিত করেন লাখো-কোটি মানুষকে। তাই ভালো থাকুক টনি লিউং চিউ-ওয়াই এবং তার মতো মানুষেরা।