গোপাল ভাঁড় বাংলা সাহিত্য এবং লোকগল্পের এক বিখ্যাত হাস্যরসাত্মক চরিত্র। চরিত্রটি দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের কথায়, গল্পে এবং লেখায় উঠে আসছে। প্রজন্মান্তরে বাচ্চারা গোপাল ভাঁড়ের গল্প পড়ে এবং বর্তমানে তার কার্টুন দেখে বড় হচ্ছে। এটি একটি বেশ মজাত চরিত্র, যদিও এই নামে সত্যি সত্যি কেউ ছিল কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
মধ্যযুগে নদীয়া অঞ্চলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১১ থেকে ১৭৮৩) সভায় নবরত্নের একজন ছিলেন এই গোপাল ভাঁড়। এই কিংবদন্তী চরিত্রটিকে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, বীরবল বা দক্ষিণ ভারতের তেনালিরামার সমকক্ষ একটি চরিত্র হিসেবে ধরা যায়।
বাহ্যিক দিক থেকে দেখলে গোপাল ভাঁড় দেখতে সুশ্রী না। তার মাথায় টাক, বিশাল ভুঁড়ি, উচ্চতাতেও সে খাটো লোক। কিন্তু গল্পের কোথাও তাকে কুৎসিত বলে উল্লেখ করা হয় নি, যেমন সক্রেটিসের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন দেখতে কুৎসিত।
গোপাল ভাঁড়ের চরিত্রের কিছু শক্তিশালী দিক আছে। সেগুলোতে শেখার মতো জিনিস পেতে পারেন যে কেউ।
প্রথমত, দেখে থাকবেন, গোপাল ভাঁড় চাটুকার না। সে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কিংবা নবাবের চাটুকারী করে নি কখনো। অন্য সভাসদরা যেখানে রাজার মন জুগিয়ে চলতেই সর্বদা ব্যস্ত, সেখানে গোপাল চলে তার নিজের খেয়ালে। সে রাজাকেও মুখের উপর সত্য বলে দিতে কোনো তোয়াক্কা করে না।
দ্বিতীয়ত, গোপাল ভাঁড় দরিদ্র শ্রেণীতে জন্ম নেয়া একজন লোক। অনেকে বলে থাকেন, তার ছিল নাপিত বংশ। কিন্তু গোপাল বুদ্ধিমান। অর্থ কিংবা ক্ষমতা না থাকলেও কেবল বুদ্ধির জোরেই সে প্রভাব বিস্তার করে। নবাব এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকেও সে বুদ্ধিতে হারিয়ে দিয়েছে অনেকবার। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মন্ত্রীমশাই গোপালকে সহ্য করতে পারেন না এমন দেখা যায় গল্পে। প্রতিবারই এই মন্ত্রীমশাইকে বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে ধরাশয়ী করে গোপাল।
তৃতীয়ত, গোপাল ভাঁড় সুবিধাবাদী না। আধুনিক সমাজে ও শিক্ষাব্যবস্থায় যত মানুষ তৈরী হয়, তাদের অনেকেই সুবিধাবাদী হয়ে থাকে। একজন সুবিধাবাদী মানুষ সামনে অন্যায় দেখলেও চুপ করে থাকবে, যদি কথা বললে তার ক্ষতি হবার কোন আশংকা থাকে! এটাকে তারা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। কোনো লোকের খারাপ কাজের চাইতেও খারাপ এদের অবস্থান। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ‘পৃথিবী ধ্বংস হবে খারাপ লোকের খারাপ কাজের জন্য নয়, ভালো লোকের নীরবতার জন্য।’ দার্শনিক নাসিব তালেব আরেকটু স্পষ্ট করে বলেন, ‘আপনি যদি কোনো ধোঁকাবাজকে দেখেন ও তাকে ধোঁকাবাজ না বলেন, তাহলে আপনিও ধোঁকাবাজ।’
অর্থাৎ যারা নিজেকে ভালো মনে করেন বা নিজে খারাপ কাজ করেন না, কিন্তু খারাপ কাজ দেখে নীরব থাকেন, এদের নীরবতা ভয়ংকর। এই ধরনের মানুষের কারণে সমাজে অস্থিরতা, অশান্তি এবং দুর্নীতি বজায় থাকে। গোপাল ভাঁড় এই সুবিধাবাদ মুক্ত। সে যখন দেখে রাজা কোনো কাজ করেছেন যা তার কাছে মনে হয়েছে অন্যায়, তখন সে তার বুদ্ধি দিয়ে প্রতিবাদ করে। রাজার কাজে প্রতিবাদ করলে রাজার অসন্তোষের শিকার হবে এই ভয়ে সে বিরত থাকে না। গোপাল ভাঁড়ের গল্পে বা কার্টুনে রাজার মন্ত্রী চরিত্রটি একজন সুবিধাবাদী, শঠ ও প্রতারক। এই মন্ত্রী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, অনেক টাকা বেতন পান, সামাজিক অবস্থান আছে; কিন্তু তিনি ব্যক্তিত্বহীন চাটুকার ও সুবিধাবাদী। কোন বাচ্চাই চাইবে না তার বাবা এমন একজন হোক।
চতুর্থত, গোপাল ভাঁড় শাস্ত্রে পন্ডিত ব্যক্তি এহেন উল্লেখ আছে অনেক গল্পে। একজন পন্ডিত ব্যক্তি হয়েও সে এক ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে চলেছে। পন্ডিতেরা যেমন রাজার সভাসদ হয়ে থাকেন, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বুদ্ধিচর্চা করেন বা ধর্ম শাস্ত্রের জ্ঞান বিতরণ করেন, গোপাল সে পথে হাঁটে নি। সে তার সাধারণ জীবনই যাপন করেছে এবং হাস্যরসের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার জ্ঞান ব্যবহার করে গেছে। সে খুব সিরিয়াস চরিত্র না, তার পদ্ধতি হালকা এবং মজার। কিন্তু কখনোই অগুরুত্বপূর্ণ নয়। সে অকাট্যভাবে ক্ষেত্রবিশেষে তার যুক্তি এমনভাবে প্রমাণ করে দেয় যে স্বয়ং রাজারও হার মানতে হয়। অর্থাৎ গোপাল দৃশ্যত হালকা পদ্ধতিতে কাজ করলেও তার যৌক্তিক অবস্থান হালকা নয়।
গোপাল ভাঁড়ের ধর্ম শাস্ত্র ও অন্যান্য শাস্ত্রে পান্ডিত্যের কারণ সে মনোযোগ দিয়ে ঐসব বড় গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেছে। আমাদের সমাজে এখন মানুষ চাকরির দরকার ছাড়া বই পড়ে না। গোপাল ভাড়ের কাছ থেকে বই পড়ার শিক্ষাও একজন নিতে পারেন। ভালো বই ঠিকমত পড়তে পারলে একজনের বিচারবুদ্ধি বাড়ে এবং সামাজিক শ্রেণী যা-ই হোক না কেন, সে গরীব বা দরিদ্র যা-ই হোক না কেন, সমাজে সে তার চিন্তার প্রভাব ফেলে যেতে পারে। যেমন, গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলো প্রায় দুইশত বছর ধরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার বাংলাভাষী মানুষের সাহিত্যে ও লোককথায় জীবন্ত হয়ে আছে।
পঞ্চমত, আমাদের এখানে দেখা যায় জ্ঞানী ব্যক্তি হলেই গুরুগম্ভীর হতে হয়, হাস্যরস অপছন্দ করতে হয়, এমন এক অলিখিত নিয়ম আছে। কিন্তু গোপাল ভাঁড় এমন না, সে হালকা হাস্য কৌতুকের মাধ্যমেই কাজ করে। অনেক বড় বড় সমস্যায় পড়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালের শরণাপন্ন হন। গোপাল হাস্য কৌতুকের মাধ্যমেই সেসব সমস্যার সমাধান করে দেয়।
গোপাল ভাঁড়ের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে যতই মতভেদ থাক, এ কথা নিশ্চিত যে এমন একজন লোক ছিলেন তখন যিনি অন্যদের চাইতে আলাদা। হতে পারে তার বর্তমান গল্পগুলোর অনেকগুলোই বানানো, কিন্তু তার মূল অনুপ্রেরণা এসেছে তার সত্যিকার গল্পগুলো থেকে। গোপাল ভাঁড়ের লেখা একটি কবিতার কথাও জানা যায় যা প্রকাশিত হয়েছিল যামিনীমোহন কর সম্পাদিত মাসিক বসুমতি পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫৩ বা ফেব্রুয়ারী ১৯৪৭ সংখ্যায়। এই কবিতাটির প্রাপ্তি গোপাল ভাঁড়ের কবিসত্তার বিষয়টিও আমাদের সামনে আনে।
গোপাল ভাঁড়ের চরিত্র এত জনপ্রিয় হবার প্রথম কারণ তার হাস্য কৌতুক এবং দ্বিতীয় কারণ তার অকপট সত্যভাষণ। এরকম আরেকটি চরিত্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেটি হলো হুমায়ূন আহমেদের হিমু। হিমু ও গোপাল ভাঁড়ের চরিত্র মিলিয়ে দেখলে একজন পাঠক অনেক মিল পাবেন।
গোপাল ভাঁড় যে সমাজে বাস করে সে সমাজের অন্যদের চাইতে সে ব্যতিক্রম। সে অদ্ভুত বুদ্ধির খেলা দেখায়। সে অবলীলায় ক্ষমতাধরের মুখের উপর সত্য বলে ও কৌতুক করে বেড়ায়। হিমু অবশ্য সেই মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বাস করা চরিত্র নয়, সে আধুনিক সমাজের চরিত্র। তার মধ্যেও ক্ষমতাশালীর মুখের উপরে অকপট সত্য বলার প্রবণতা আমরা দেখতে পাই। পোষাকের দিক থেকে উভয়ই হলুদ পোষাক পরে। হলুদ বা গেরুয়া রঙ হচ্ছে সন্ন্যাসের রঙ। উভয় চরিত্রের ভেতরেই একটা সন্ন্যাসী মন আছে, তাই তারা সব কিছুই হালকাভাবে দেখতে পারে।
মানুষ এসব চরিত্র পছন্দ করে কেন? কারণ বাস্তব জীবনে মানুষ এরকম কাজ করতে পারে না। তারা ক্ষমতাধরের বিপক্ষে সত্য বলতে পারে না, কারণ এতে তাদের ক্ষতি হবে। কিন্তু তাদের ভেতরের একটা অংশ চায় এরকম অকপট হতে। আধুনিক সমাজ সংসারে আবদ্ধ মানুষের ভেতরের একটা অংশ চায় সবকিছু হালকাভাবে দেখতে ও হাস্য কৌতুকে উড়িয়ে দিতে, কিন্তু বাস্তবতার খাতিরে সে পারে না। হিমু বা গোপাল ভাঁড় বা মালায়ালাম সিনেমার চার্লির মতো চরিত্র তাদের সেই অবচেতন ইচ্ছাকেই পূরণ করে দেয়। তাই এসব চরিত্র তাদের ভালো লাগে।
ফিচার ইমেজ © সনি আট টিভি চ্যানেল