কোশিশ চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং জয়া ভাদুড়ীর বাকশক্তিহীন দুই দম্পতির অভিনয় কিংবাআঁধি চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে কে মুগ্ধ হয়নি? সত্তর দশকে হিন্দি সিনেমার জগতে যখন শুধুই মারপিট আর এংরি ইয়াং ম্যানের যুগ চলছিল তখন ভিন্ন ধাঁচের গল্প, ভিন্ন ধাঁচের প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন আখ্যানভাগের এ দুটি সিনেমা দর্শকদের মনে আলাদা দাগ কেটেছিল।
বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকার গুলজার ছিলেন চলচ্চিত্র দুটির নির্দেশক। গীতিকার হিসেবে সাফল্য অর্জনের পর তিনি ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন। বলা যায় হিন্দি চলচ্চিত্রে কিছু পরীক্ষামূলক কাজের ক্ষেত্র তিনিই প্রথম তৈরি করেছিলেন। গান নির্মাণের ক্ষেত্রে তার অবদান অসামান্য। তার লেখা গানের প্রতিটি কলি থেকে যেন জীবনের গভীর ভাব প্রকাশ পায়। চারপাশে যা ঘটছে তা দিয়েই খুব সহজ করে সুন্দর সুন্দর গান লিখতে পারেন।
দৈনন্দিন জীবনের সুখ, দুঃখ, ভাব, রাগ, অভিমান, কষ্ট প্রভৃতি আবেগকে গানের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা যেন তার খেলা। চমৎকার আবৃত্তি করতে পারেন তিনি। আবৃত্তি এবং কোনো ঘটনার সংলাপ বলার ভঙ্গি যে কাউকে সেটা শুনতে বাধ্য করবে। চিত্রনাট্য তৈরিতেও তার জুড়ি মেলা ভার। উপমহাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ্-এর অভিনীত ‘মির্জা গালিব’ টেলিভিশন সিরিজের জন্য গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ, চিত্রনাট্য, নির্মাণ দায়িত্ব, গালিবের গানগুলোকে দর্শকদের উপযোগী করে তোলা ইত্যাদি কাজ একাই করেছিলেন তিনি। তার অবদানের কারণেই হয়তো আজও এ সিরিজের কথা মনে রেখেছে দর্শকরা।
দিল্লীতে পড়াশুনার শুরু হয় কবি গুলজারের। পরে বোম্বেতে একটি মোটর গ্যারেজে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির রংয়ের মিশ্রণ এবং রং মেলানোর কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি আলাদা নেশা ছিল। গ্যারেজে কাজ করার সময় রাতে কিছু করার ছিল না বলে সেখানেও বই পড়তেন। গ্যারেজের কাছেই ছিল একটি লাইব্রেরি। মাত্র চার আনায় সেখান থেকে বই নিয়ে পড়া যেত। সেখান থেকে গোয়েন্দা গল্প ও রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনী দিয়ে শুরু করেছিলেন। এরপর একদিন তার হাতে এলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যগ্রন্থ মালীর ইংরেজি অনুবাদ Gardener। এটি পড়ার পর গুলজারের বই পড়ার ভাব এবং ধরন পুরোপুরি বদলে যায়। এমনকি বই নির্বাচনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়।
এরপর তিনি পড়েন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলো। শরতের উপন্যাসগুলোতে তিনি বড় পরিবার এবং পরিবারের মানুষদের জটিল সম্পর্কগুলোকে দেখতে পান। একপর্যায়ে তিনি এসব উপন্যাসের চরিত্র এবং চরিত্রের ভাবের সাথে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার মিল খুঁজে পান। সেই তখন থেকে তিনি বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন। বাঙালিদের খুব পছন্দ করেন তিনি। বাংলা ভাষাকে মিষ্টি ভাষা বলে মনে করেন। বাঙালি এবং বাংলা ভাষার প্রতি আলাদা শ্রদ্ধাবোধ আছে তার মাঝে। বড় বড় অনুষ্ঠানে তাকে বাঙালি পোশাকে দেখা যায়। সাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে সব জায়গায় যান। তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রে কাজও শুরু করেন আরেক কিংবদন্তী বাঙালি বিমল রয়ের সাথে। বিয়েও করেন রাখী গুলজার নামে এক বাঙালিকে। রাখী গুলজার নিজেও চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তী অভিনেত্রী।
বিমল রয় ছাড়াও আরো অনেক গুণী মানুষদের সংস্পর্শে এসে তিনি কাজ করেছেন। সুরকার শচিন দেব বর্মণ, নির্দেশক হৃষিকেশ মুখার্জী তার মাঝে অন্যতম। বিমল রয়ের সাথে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার ঘটনাটি ছিল দারুণ। দেবু সেন নামে একজন কবি গুলজারকে একটি চলচ্চিত্রে কাজের জন্য বিমল রয়ের অফিসে নিয়ে যায়। অফিসের রুমে যাওয়ার পর গুলজারের সম্পর্কে সব জেনে বাংলায় দেবু সেনকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, বৈষ্ণব কবিতা কী, এর মর্ম কী, এসবের কিছু কি এই লোক বুঝবে? দেবু তখন বিমল রয়কে বলে, দাদা, উনি বাংলা বুঝেন, বাংলার অনেক গল্প-উপন্যাস তিনি পড়ে এসেছেন। এ কথা শুনে বিমল রয় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যান। এক সাক্ষাতকারে গুলজার বলেন, এখনো বিমল রয়ের মুখের সেই অপ্রস্তুত ভাব তিনি ভুলতে পারেন না। এরপর থেকেই গুলজার তার সাথে কাজ করা শুরু করেন। বিমল রয়ের কাছে গুলজার অত্যন্ত ঋণী, কারণ তিনিই প্রথম গুলজারের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাকে কাজ করতে ভরসা দিয়েছিলেন। এগুলো তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
কবি গুলজারের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো তিনি সাহিত্য বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। ভিন্ন ধারার সিনেমাগুলো তৈরি হতো ভালো কোনো সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস থেকে। গুলজারের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি আগে থেকেই সেসব গল্প-উপন্যাস পড়ে রেখেছেন। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের সাথে পরিচয় থাকার কারণে চরিত্রগুলোর আবেগ, অনুভূতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা থাকতো। সে কারণে চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে মূল গল্পের চরিত্রের সাথে মিলিয়ে অভিনয় করতে কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সমস্যা হতো না।
কোশিশ চলচ্চিত্রের একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এতে বোবা এবং বধিরদের কথা বলার যে সংকেতগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক। এ সম্পর্কে রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে তা অভিনয়ে আনা হয়। তখনকার সময়ে এরকম সিনেমা একদমই হতো না। কিন্তু গুলজার গতানুগতিক চলচ্চিত্র না বানিয়ে ভিন্ন ধাঁচের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতেন, যা দর্শকদের ভালো লাগতো। এগুলো সমালোচকদেরও পছন্দ হতো। বেশ কিছু চলচ্চিত্র অবশ্য অর্থনৈতিকভাবে সফলতার মুখ দেখেনি। তবে অর্থনৈতিকভাবে সফল না হলেও পরবর্তীতে সেগুলো ক্লাসিকের মর্যাদা অর্জন করেছে।
পড়াশোনা করা লোকজনদের খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন গুলজার। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেরে আপ্নে’তে কোনো পরিচিত মুখ নেননি। ভারতের National School of Drama থেকে অভিনয় শিখে আসা অভিনেতাদের নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। এ চলচ্চিত্রটি পরবর্তীতে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী চলচ্চিত্রের মর্যাদা অর্জন করে।
তার কবিতা এবং লেখনী নিয়ে কেউ কখনো নেতিবাচক মন্তব্য করেনি। যারা তার কবিতা ও গান পড়েছে কিংবা শুনেছে তারা একটি বিষয় স্বীকার করেছে- তার প্রতিটি লেখার কোনো না কোনো অংশের সাথে তাদের জীবনের কোনো একটি ঘটনার মিল রয়েছে। সাধারণ মানুষকে যেন পড়তে পারেন গুলজার। তিনি এমন এক কবি যাকে জনসাধারণের কবি বললে ভুল হবে না। চলচ্চিত্র জগতে তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি সাহিত্যকে জনসাধারণের জন্য নির্মাণ করতে পেরেছেন। আর তিনি এ কাজটি করেছেন তার সংলাপ, গান এবং চলচ্চিত্র দিয়ে।
একবার কবিতা লেখা নিয়ে তাকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল- কবি হতে গেলে এবং কবিতা লিখতে হলে কি কাউকে উদাস হতেই হবে? উদাসী না হলে কি কবিতা লেখা যাবে না? তখন কবি গুলজার চমৎকার একটি উত্তর দিয়েছিলেন- মানুষের জীবনে উদাসীনতা একটু বেশী সময় ধরে থাকে, আর সুখ কিংবা আনন্দ হয় অনেকটা ফুলঝুরি বা আতসবাজির মতো যেটা বেশী সময় থাকে না। নিমিষেই আলো দিয়ে ফুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু উদাসী অনেকটা আগরবাতির মতো। চারদিকে নিজের বাসনা বা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়।
একথা অনস্বীকার্য যে তিনি যা-ই লিখেন না কেন, সেটা গান হোক, সংলাপ হোক, গল্প কিংবা উপন্যাস-চিত্রনাট্য হোক, তার লেখা প্রতিটি শব্দই জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ফিচার ছবি- MyTeBox.com