Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলার লোকজ খেলাধুলা: কানামাছি, রুমাল চুরি, গোলাপ টগর ও অন্যান্য

গত পর্বে আমরা আলাপ করেছিলাম বেশ কিছু শিশুতোষ খেলা নিয়ে। আজও থাকবে তেমন কিছু শিশুতোষ খেলার বিবরণ যেগুলো আমাদের শৈশবকে রঙীন করেছিলো। সাধারণত যেসব খেলা ছেলে-মেয়ে উভয়ই খেলে থাকে, সেগুলোর বিবরণ থাকবে প্রথমে। তারপর থাকবে এমন কিছু খেলার বিবরণ যেগুলো সাধারণত শুধু মেয়েদের খেলা। তো ফের শুরু করা যাক আমাদের শৈশবের ‍উদ্দেশ্যে যাত্রা…

কানামাছি

কানামাছি খেলাটি বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই প্রচলিত। বাড়ির উঠোনে বা মাঠে ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এ খেলা খেলে থাকে। এ খেলায় প্রথমে একজনের চোখ বাঁধা হয় কাপড় দিয়ে যেন সে কিছুই দেখতে না পায়, অর্থাৎ সে হয় কানা। অন্য খেলোয়াড়েরা মাছির মতো মাছির মতো চারদিক থেকে ঘিরে তার গামে মৃদু টোকা বা চিমটি দেয়, আর মুখে ছড়া কাটতে থাকে:

কানামাছি ভোঁ ভোঁ,
যাকে পাবি তাকে ছোঁ।

চোখবাঁধা অবস্থায় সে দুই হাত বাড়িয়ে তাদের একজনকে ধরার চেষ্টা করে। এ সময় সেও ছড়া কাটে:

আন্ধা গোন্ধা ভাই, আমার দোষ নাই।

কানামাছি ভোঁ ভোঁ

কানা যদি কাউকে ধরে ফেলে, তখন তার চোখ থেকে কাপড় খুলে ধরা পড়া খেলোয়াড়কে চোখ বেঁধে দেওয়া হয়। তখন সে হয় কানা আর এভাবেই খেলা এগিয়ে যেতে থাকে। এ খেলায় হার জিতের কোনো বিষয় নেই, আছে শুধু আনন্দ। ইউরোপে এ খেলাটি Blind Bee নামে পরিচিত।

একপা

কানামাছি খেলায় যেমন একজনকে অন্ধ বানিয়ে অন্যদের ধরতে চেষ্টা করা হয়, তেমনি একপা খেলায় একজন খোঁড়া হয়ে এক পায়ে দৌঁড়িয়ে অন্যদের ধরতে চেষ্টা করে। বাদবাকি নিয়ম কানামাছির মতোই। ইউরোপে এ খেলা লেম্ম্যান নামে প্রচলিত।

রাজার কোটাল

রাজার কোটাল কমবয়সী ছেলেমেয়েদের দলবদ্ধ খেলা। এতে একজন হয় মোড়ল আর অন্য একজন হয় কোটাল। মোড়ল ও অন্য খেলোয়াড়দেরা নিয়ে গোল হয়ে বসে একের পর এক বুড়ো আঙুল মুঠ করে ধরে। কোটাল তখন তাদের চারদিকে ঘুরতে থাকে। পরে মোড়ল ও কোটালের মধ্যে ছড়ার মাধ্যমে এ ছড়াটি কাটা হয়।

কানটার পিছে কে ঘুরে?

রাজার কোটাল।

কিসের জন্যে?

এক ছড়ি কলার জন্যে।

কাল যে নিয়া গেছিলা?

ঘোড়ায় মুতে দিয়াছে।

ধুয়ে ধুয়ে খাও নি?

ছি! হক! থু!!

তবে এক ছড়ি নিয়া যাও।

পরে কোটাল কলার কাঁদি কাটার অভিনয় করে একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে যায় এবং পুনরায় ঘুরতে থাকে; এ সময় আবার পূর্বের ন্যায় ছড়া কাটা হয়। এভাবে কোটাল সব খেলোয়াড়কে নিয়ে গেলে প্রথম রাউন্ডের খেলা শেষ হয়। এভাবে যতক্ষণ খুশি এ খেলা চলতে থাকে। কোথাও কোথাও এই খেলাটি কাঁঠাল কাঁঠাল নামেও খেলা হয়। তখন কোটাল মোড়লের কাছে একইভাবে কাঁঠাল চাইতে থাকে।

অ্যাঙ্গা অ্যাঙ্গা

অ্যাঙ্গা অ্যাঙ্গা ছোট ছেলেমেয়েদের দলবদ্ধ খেলা। এ খেলার জন্য বাড়ির উঠোন কিংবা মাঠে একটি বড় বৃত্ত অাঁকা হয়। একজন খেলোয়াড় এই বৃত্তের বাইরে থাকে, সে হয় বাঘ। আর অন্যরা বৃত্তের ভেতরে থাকে এবং তারা হয় ছাগল। বাঘ বৃত্তের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় আর ছড়া কেটে কেটে ভেতরে অবস্থানকারীদের ভোলানোর চেষ্টা করে। তখন বাঘ আর ছাগলের মাঝে এই ছড়াটি কাটা হয়:

বাঘ (ক্রন্দনের সুরে) – অ্যাঙ্গা অ্যাঙ্গা

ছাগদল (সমস্বরে) – কাঁদো ক্যা?

গরু হারাইছে

কি গরু?

নাঙ্গা গরু।

শিঙ্গি কি?

কুষ্টার অাঁশ।

একটা গান গাওছিন।

বাঘ তখন নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে গান গায়:

এতি চোর বেতি চোর,

এতি চোর বেতি চোর,

চলে আয় আমার সিয়ানা চোর।

গান শেষ করেই বাঘ লাফ দিয়ে বৃত্ত থেকে একটা ছাগল ধরে টানতে থাকে, অন্যরা তখন বাধা দেয়। বাঘ তাকে বৃত্তের বাইরে নিতে পারলে সে বাঘের দলভুক্ত হয়। শেষপর্যন্ত যে ঘরে থাকে সে পরবর্তী খেলায় বাঘ হওয়ার সুযোগ পায়! তার মানে বাঘ হওয়াটাই মহত্ত্ব এই খেলায়। উল্লেখিত ছড়া-গানটি বৃহত্তর যশোর এলাকায় প্রচলিত।

কিশোরীদের খেলা

বাঙালির সংস্কৃতি সামগ্রিকভাবে এমন যে, নির্দিষ্ট বয়স পর মেয়েদের চলাফেরা নির্ধারিত হয়ে যায়। ঘরোয়া পরিবেশে তাদের কাছে লুড়ু, কড়ি, তিন গুটি, পাঁচ গুটি, ছয় গুটি, দশ গুটি প্রভৃতি খেলা তাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর প্রায় প্রতিটি খেলার সাথে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন ছড়া-গান। আমাদের লোক-সাহিত্যে এ ছড়া গানগুলো অত্যন্ত মূল্যবান।

পাঁচ গুটি খেলার একটি ছড়া এমন:

‘তেলোটা কামিনী

গুটিকে যামিনী

ও তিনশো টাকা

চার শো দানা

পঞ্চমীটা কানা।।’

এছাড়াও মেয়েদের মধ্যে এক্কা দোক্কা, কুত কুত, পলাপলি, ফুল টোক্কা, শব্দ খেলা, শালিক পাখি নমষ্কার, সাত ধাপ্পা, সিঁন্দর টোক্কাটুক্কিি ইত্যাদি খেলার খুব চল রয়েছে।

কড়ি খেলা

কড়ি দিয়ে নানা রকম খেলা গ্রামীণমেয়েদের কাছে খুব জনপ্রিয়। তেমনি এক খেলার মাঝে এ ছড়া গানটি চলতে থাকে:

খুশুর খুশুর দুর্গা মাসুর

তিন তালিয়া মার কেলিয়া

কুমড়ার চাক ধাপ্পা দিয়া

হাতের কড়ি হাতে থাক।

কড়ি খেলা

কড়ি দিয়ে হরেক রকম খেলার মধ্যে আমরা যে খেলাটির কথা এখানে বলছি তাতে চারটি কড়ি প্রয়োজন হয়। এ খেলাটি সাধারণত দুজনে খেলা হয়। তবে চাইলে সর্বোচ্চ চার পাঁচজনেও খেলা যেতে পারে। এটি অত্যন্ত সরল একটি খেলা। কোনো মসৃণ স্থানে কড়ি চারটিকে হাত থেকে গড়িয়ে দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় টোকা দিয়ে আঘাত করে পয়েন্ট সংগ্রহ করা হয়। আঘাত করতে ব্যর্থ হলে বা কড়ি চালার পর এক সাথে লেগে থাকলে ঐ খেলোয়াড়ের দান নষ্ট হয়ে যায় এবং অন্যজন খেলা শুরু করে। এক্ষেত্রে নিজের মাথার চুল দিয়ে গ্রামের মেয়েদের প্রায়ই আপাত স্পর্শ করে থাকা গুটিকে পৃথক প্রমাণ করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। কড়ি চালার পর যদি তিনটি গুটির বুক উপরে থাকে তবে ঐ দান নষ্ট হয়। আর যদি চারটি গুটিই বুক উপরে থাকা অবস্থায় পড়ে, তবে প্রতি গুটির জন্য চারটি করে পয়েন্ট পাওয়া যায় এবং এই গুটি সংগ্রহ করা নিয়ে খেলোয়াড়দের মাঝে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়!

রুমালচুরি

রুমালচুরি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের একটি দলবদ্ধ খেলা। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এ খেলাটি মুড়াখেলা নামেও পরিচিত। প্রথমে একজনকে চোর নির্বাচন করা হয় আর অন্য সবাই গোল হয়ে বসে পড়ে। চোর একটি রুমাল হাতে নিয়ে চারদিক ঘুরতে থাকে এবং সুবিধামত একজনের পেছনে রেখে দেয়। সে টের না পেলে চোল পরের পাক ঘোরার সময় তার পিঠে কিল চাপড় মারে। তখন সে রুমাল নিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং চোরের ভূমিকা পালন করে। আগের খেলোয়াড় বর্তমান চোরের খালি জায়গায় বসে পড়ে।

গোলাপ টগর বা টুক্কা টুক্কি

গোলাপ টগর বা টুক্কা টুক্কি খেলা দেশের প্রায় সব জায়গাতেই কম বেশি প্রচলিত। তাই অঞ্চলভেদে নামের বিভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায় বেশ। কোথাও কোথাও এ খেলা বউরানী, আবার কোথাও চড়নখেলা নামে পরিচিত।

গোলাপ টগর কমবয়সী ছেলেমেয়েদের দলবদ্ধ খেলা। প্রথমে দু’জনকে রাজা করে সমান দুটি দল গঠন করা হয়। তারপর তারা বিশ পঁচিশ হাত দূরত্বে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। খেলার শুরুতে দলের রাজা ফুল, ফল, পাখি ইত্যাদির নামের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ছদ্মনাম রাখে। পরে সে বিপক্ষ দলের যেকোনো একজনের চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে ‘আয় রে আমার গোলাপ ফুল’, ‘আয় রে আমার টগর ফুল’ ইত্যাদি নামে ডাকে। সে তখন অতি সন্তর্পণে এসে যার চোখ বন্ধ তার কপালে মৃদু টোকা দিয়ে ফের নিজের অবস্থানে ফিরে যায়।

গোলাপটগর বা টোক্কা টুক্কি

ঐ খেলোয়াড় নিজের জায়গায় বসে গেলে দলনেতা অপর দলের খেলোয়াড়ের চোখ ছেড়ে দেয় এবং তাকে টোকা দেওয়া খেলোয়াড়কে সনাক্ত করতে বলা হয়। সে সফলভাবে সনাক্ত করতে পারলে সে লাফ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, আর তাতে ব্যর্থ হয়ে যে টোকা দিয়েছে সে তার জায়গা থেকে লাফ দেয় এবং সেখানে বসে পড়ে। এরপর অন্য রাজা একই ভাবে এ দলের কারো চোখ বন্ধ করে নিজের দলের কাউকে ডাক দেয়। এভাবে লাফ দিয়ে মধ্যবর্তী সীমানা অতিক্রম করে প্রতিপক্ষের জমি দখল না করা পর্যন্ত খেলা চলতে থাকে।

এক্কা দোক্কা

দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই প্রচলিত এক্কা দোক্কা খেলা। অবশ্য অঞ্চলভেদে এর নামের ভিন্নতা রয়েছে। কোথাও কোথাও একে সাতখোলা এবং চিরিয়া নামেও ডাকা হয়। বাড়ির উঠোন কিংবা খেলার  মাঠে মাটিতে দাগ কেটে আয়তাকার ঘর কাটা হয়। সে ঘরে আড়াআড়ি রেখা টেনে ছয়টি খোপ করা হয়। এর মধ্যে চার নম্বর ঘরটি হচ্ছে বিশ্রামঘর। নিচ থেকে ঘরগুলির নাম যথাক্রমে এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌক্কা, পক্কা ও লাষ্ঠি। ভাঙা হাঁড়ি বা কলসির গোলাকার টুকরা হচ্ছে খেলার উপকরণ; এটি চাড়া, ঘুঁটি, ডিগা, খোপলা ইত্যাদি নামে পরিচিত।

চাড়াটিকে এক এক করে প্রতিটি ঘরে ছুঁড়ে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পায়ের টোকা দিয়ে এমনভাবে বাইরে নিয়ে আসা হয় যেন তা কোনো দাগের ওপর না থেকে যায় কিংবা পাশের দাগ অতিক্রম করে না যায়। চাড়াটি কোনো দাগের ওপর থেমে গেলে বা পাশের দাগদুটির কোনো একটি অতিক্রম করে গেলে সে দান হারায়। তখন পরবর্তীজন দান পায়। সে সফলভাবে সবগুলো ঘর পার হয়ে আসতে পারে তার জিত হয়। গ্রাম বাংলায় এবং মফস্বলে এখনও এ খেলাটি বর্তমান। মেয়েরা একা একা কিংবা দল বেঁধে এক্কা দোক্কা খেলে থাকে।

জীবন ঘনিষ্ট খেলা

এছাড়াও শিশু কিশোরেরা জীবন ঘনিষ্ট নানান খেলা খেলে। রান্নাবাড়ি, পুতুল খেলা, বিয়ে বিয়ে এ ধারার অন্তর্গত। এ প্রসঙ্গে নিচের ছড়া-গানটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এটি পুতুল খেলার সময় গাওয়া হয়ে থাকে।

লাউ মাচার তলে লো জোড়া পুতুল বিয়া

বাজনা বাজায় ঝুমুর ঝুমুর দেখে আসি গিয়া

আম কাঁঠালের পিঁড়িখানি ঝিমিক ঝিমিক করে

তারি মধ্যে বাপে খুড়ায় কন্যা দান করে।।

রান্নাবাড়ি বা টোপাভাতি খেলা

এ সিরিজের অন্যান্য লেখা –

আমাদের লোকজ খেলাধুলা: নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, ঘোড়দৌড় ও অন্যান্য

আমাদের লোকজ খেলাধুলা: ডাংগুলি, গাইগোদানি, ওপেনটি বায়োস্কোপ ও অন্যান্য

তথ্যসূত্র

১) বাংলাপিডিয়া

২) বাংলাদেশের খেলাধুলা, রশীদ হায়দার, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

৩) থাম্বনেইলের ছবিটির আলোকচিত্রী ফেরদৌসী বেগম; www.flickr.com/photos/begumf/

Related Articles