চ্যাপ্টার ওয়ান
২০১৪ সালে মুক্তি পায় জন উইক মুভি সিরিজের প্রথম পর্ব। সিনেমার গল্পে এত বেশি অসাধারণত্ব না থাকলেও ত্রুটিহীন ও ক্যালিগ্রাফি সম্পন্ন ধুন্দুমার অ্যাকশনের কারণে সকলের মনেই তা স্থান করে নেয়।
জন উইক ছিল একজন হিটম্যান। আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোনো সংস্থার হয়ে খুনোখুনি সংক্রান্ত কাজ করতো অর্থের বিনিময়ে। তবে ভেতরে একটা নরম সত্ত্বা ঠিকই বজায় ছিল তার। ভালোবাসার মানুষটির টানে একসময় তাই সে ছেড়ে চলে আসে অন্ধকার সেই জগৎ।
জন উইকের প্রথম সিনেমায় দেখা যায়, ভালোবাসার যে মানুষটির জন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিল সেই মানুষটিই দুর্ঘটনায় কিংবা পরিকল্পিতভাবে মারা যায়। ভালোবাসার মানুষটি চলে গেলেও তার স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে অল্প অল্প করে ভালোবাসা খুঁজে নিয়ে বাঁচতে থাকে প্রাক্তন এই হিটম্যান। প্রেয়সীর অনুপস্থিতিতে তার একাকীত্ব দূর করতে প্রেয়সীর কাছ থেকে সে উপহার পায় খুব চমৎকার একটি কুকুরছানা।
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল, কিন্তু সমস্যা বাধায় ‘কানে বাতাস লাগা’ এক ছেলের অদূরদর্শী আচরণ। বাপের যদি অঢেল টাকা থাকে আর সন্তান যদি লাগামহীন গরুর মতো ছাড়া থাকে তাহলে কাউকেই চোখে লাগে না। সামনে যাকে দেখে তাকেই ছোট বলে মনে করে। বাপের টাকা আছে, তাই সমস্ত দুনিয়াটাই যেন তার। তেমনই একদিন তার সামনে এসে পড়লো জন উইক। উইকের গাড়ির চমৎকার বডি ও ক্ষমতাবান ইঞ্জিন দেখে মুড়িমুড়কির মতো কিনে ফেলতে চায় ছেলেটি। উইক গাড়ি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় সে ও তার বন্ধু এক গাধাসুলভ কাজ করে বসে। রাতে উইকের বাসায় গিয়ে ঘুমের ঘোরে তাকে পিটিয়ে আসে। আসার আগে আদরের কুকুরটিকেও মেরে দিয়ে আসে।
ঐ যে স্মৃতি, আবেগ আর মায়ার একটা অংশ ছিল তার মাঝে, সেখানে পড়লো ঘা। কংক্রিটের মেঝের নীচে কবর দিয়ে রাখা অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি বের করে সেগুলো নিয়ে ঐ ছেলে এবং ঐ ছেলের দলবলকে এমন প্যাঁদানি দেয় যে পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ড টিম দফারফা হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থেই তাদের বাপের নাম ভুলে যায়। জন্মের শিক্ষা হয় তাদের, মনে থাকলে কোনোদিন জন উইককে ঘাঁটাতে আসবে না। অনেক ক্ষমতাবান শক্তিকে জন্মের শিক্ষা দেয়া এবং বাপের নাম ভুলিয়ে দেবার জন্য কেমন এবং কী পরিমাণ অ্যাকশন থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয়? যতটুকু প্রয়োজন মনে হয় তার থেকে কোনোদিক থেকেই কম নেই এই মুভিটিতে। সেজন্যই সাধারণ গল্প হওয়া সত্ত্বেও এই মুভিটি মানুষের মনে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল।
চ্যাপ্টার টু
এবার ২০১৭ সালে মুক্তি পায় চ্যাপ্টার টু। যে জন উইক তার গাড়ি চুরি ও স্মৃতির কুকুরকে মেরে ফেলার জন্য এতকিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, এক এজেন্ট এসে সেই জন উইকের বাসায় বোমা মেরে সব উড়িয়ে দেয়। বোমার আগুনে তার ভালোবাসার স্ত্রীর সকল ছবি ও স্মৃতি পুড়ে যায়। এই বেকুব তো দেখা যায় আগেরটার চেয়েও তারছেঁড়া। এখন উইক সাহেব এই ঘূর্ণিঝড় কীভাবে সামলাবে? এরপরই শুরু হয় John Wick: Chapter 2 এর কাহিনী। অপরাধের জগত থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। অনেকটা বাংলা সিনেমার “ওরা আমাকে মানুষ হতে দিলো না” ডায়ালগের মতোই!
জন উইকের অসাধারণত্ব
বর্তমানে নির্মিত অ্যাকশন মুভির অ্যাকশনগুলো তেমন শিল্পমণ্ডিত হয় না। অ্যাকশনের মাঝেও যে আর্ট আছে, অ্যাকশনের মাঝেও যে কোরিওগ্রাফিক সৌন্দর্য আছে তা অনেকদিন পর দেখা গিয়েছে জন উইক সিরিজের মুভিগুলোতে। দুটি পর্বই অ্যাকশনের অসাধারণত্বে ভরপুর। অনেকগুলোর মাঝে ছোট একটি উদাহরণ দিই, দোদ্যুল্যমান ক্যামেরা বা Shaky Cam নামে চলচ্চিত্রে বহুল প্রচলিত একটি টেকনিক আছে। এই টেকনিক ব্যবহার করে চিত্রগ্রহণ করলে চিত্রে কিছুটা কম্পনের ছাপ থাকে, দুলে দুলে কাঁপে। অ্যাকশন মুভিগুলোতে লাথি, ঘুসি, আছাড়, গুলিসহ বিভিন্ন প্রকারের মারামারিই হয়। সেসব মারামারির দৃশ্যে যদি ক্যামেরাকে মৃদু বা মাঝারী মানে দোলানো হয় তাহলে অ্যাকশনের দৃশ্যগুলো বেশি বাস্তবসম্মত হয়।
মারামারি করছে, শব্দ হচ্ছে, আশেপাশের এলাকা নড়াচড়া করছে এমন পরিবেশের দৃশ্যে ক্যামেরা যদি কিছুটা সঙ্গতিপূর্ণভাবে নড়াচড়া করে তাহলে তা বাড়তি উপযোগ যোগায়। দর্শকের চোখ একধরনের কৃত্রিম নড়াচড়া ও অস্থিরতার অভিজ্ঞতা পায়, যা বাস্তবে ঘটনাস্থলে থাকলে অনুভূত হতো।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখনকার বেশিরভাগ একশন মুভিতে যাচ্ছেতাইভাবে শ্যাকি ক্যাম টেকনিকটি ব্যবহার করা হয়। এতে অপ্রয়োজনীয়ভাবেই দৃশ্য নড়াচড়া করে। ফলে তা দর্শকের জন্য উপকারী না হয়ে আরও ক্ষতির কারণ হয়। দর্শকের মনোযোগ বিনষ্ট হয়, মুভি দেখতে বিরক্তি জমে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে এটি অসুস্থও করে ফেলতে পারে দর্শককে।
তবে জন উইক এদিক থেকে একেবারেই আলাদা। ক্যামেরাকে স্থির রেখেও যে মারমার কাটকাট অ্যাকশন মুহূর্ত দৃশ্যায়ন করা যায় এবং সেই অ্যাকশনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে জন উইক। এর আগে এরকম চমৎকার অ্যাকশনের আমেজ পাওয়া গিয়েছিল ম্যাট্রিক্স ট্রিলজিতে। উল্লেখ্য ম্যাট্রিক্স ট্রিলজিতেও অভিনয় করেছিলেন জন উইকের নায়ক কিয়ানু রিভস।
বিরক্তি ধরিয়ে দেবার মতো কোনো কাহিনী নেই, নেই কোনো বাহুল্য। এরকম মুভি চোখের জন্য বেশ আয়েশকর। সেজন্যই দর্শক মুভি দুটি লুফে নিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো সফল মুভির সিক্যুয়েল প্রথম মুভিটির মতো অসাধারণ হয় না। কিন্তু জন উইকের বেলায় হয়েছে। প্রথমটির ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয়টিও ভালো হওয়াতে মুভি পাড়ায় জন উইক নিয়ে একটা হাইপ তৈরি হয়েছিল। আর হবেই বা না কেন? মুভিতে মাঝে মাঝে এমন সব ক্লিপ আছে যা একেবারেই অনন্য। স্পয়লার ঠেকিয়ে এরকম দুই একটি ক্লিপ উল্লেখ করছি-
► চ্যাপ্টার টু-তে মারামারির এক পর্যায়ে শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য জন উইকের ধারেকাছে যখন মারার উপযোগী কোনোকিছুই ছিল না তখন হাতে তুলে নেয় একটি পেন্সিল। পেন্সিলের মাধ্যমে খুঁচিয়ে একজন মানুষকে মেরে ফেলা এত সহজ না। কিন্তু এক এবং অদ্বিতীয় জন উইক শত্রুকে মারার জন্য পেন্সিলকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে যে ঐ মুহূর্তে দর্শককে থ হয়ে থাকতে হয়েছে দুই মিনিট। এর আগে রিভলভার, ভারি অস্ত্র, বোমা, গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে যত ধরনের অ্যাকশন দৃশ্য হয়েছে তাদের সবগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে পেন্সিল দিয়ে খুন করার ঐ দৃশ্য।
এই পেন্সিল নিয়ে মুভিপাড়ায় একটা উপ-হাইপ উঠে গিয়েছিল। যেমন ফেসবুক কেন্দ্রিক সিনেমার একটি বাংলাদেশী গ্রুপে এক ব্যক্তি প্রশ্ন রেখেছিল- জেসন বর্ন, জন উইক ও জেমস বন্ড যদি পারস্পরিক ফাইট লাগে তাহলে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে? অনেকে মন্তব্য করেছিল জন উইকের হাতে শুধু একটা পেন্সিল দিয়ে দিন, এরপর কী হবে এবং এই ফাইটে কে টিকে থাকবে তা আর না বলে দিলেও চলবে। উল্লেখ্য জেসন বর্ন ও জেমস বন্ডও অ্যাকশন মুভির অপ্রতিরোধ্য নায়ক।
► প্রথম ভাগে ১৫/২০ টা তাগড়া জোয়ান শত্রুকে পিটিয়ে তক্তা করে যখন মেঝেতে শুইয়ে রাখে তখন পুলিশ আসে। এসে এই দৃশ্য দেখে ‘কিছুই দেখিনি’ ধরনের দুই তিন বাক্যে কথা বলে বিদায় নিয়ে চলে যায়। পুলিশ হতে আরম্ভ করে সবাই-ই তার শুভাকাঙ্ক্ষী।
► এই সিরিজে লেনদেনের ব্যাপার আলাদা। এই আধুনিক যুগেও এখানে স্বর্ণমুদ্রার মাধ্যমে বিনিময় ব্যবস্থা প্রচলিত। তাদের মাফিয়া জগত নিজেরা নিজেরা একটি অর্থব্যবস্থা চালু করে রেখেছে, যার বিনিময়মাধ্যম হচ্ছে স্বর্ণমুদ্রা।
ত্রুটি-বিচ্যুতি
সমালোচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায় অনেক ত্রুটিই আছে জন উইকের উভয় মুভিতে। এখানে নায়ককে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে বলা যায় সে একজন সুপারহিরো। শুধু উড়ার ক্ষমতা বাদে সব ক্ষমতাই আছে তার। একা একজনই শত শত শত্রুকে মেরে শেষ করে ফেলে। গোলাগুলির সময় শত্রুরা এক এক করে আসে, যেন সামনে এলে এক এক করে মারতে পারে। কিন্তু সত্যিকার বাস্তবতা এমন হবে না। সকল স্থানের সকল স্থাপনার সকল অলিগলি তার জানা আছে, তাই কোন দিক থেকে কে এসে আক্রমণ করবে তা যেন আগে থেকেই জন উইক জানে। তাই পেছন থেকে কেউ আক্রমণ করার আগেই ফিরে গুলি করে শুইয়ে দেয় তাদের। দেয়ালের ওপারে কে আছে এটাও আগে থেকেই জানে জন উইক এবং সে অনুসারে অস্ত্র চালনাও করে। এগুলো অস্বাভাবিক।
গাড়িতে প্রচুর ধাক্কা খায় বা একসিডেন্ট হয়। তাতে গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে গেলেও জন উইকের চেতনার কোনো হেরফের হয় না। মাথা সমান উঁচু থেকে আছাড়ও খায়। এরকম আছাড়ে মেরুদণ্ডের কশেরুকা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবার কথা, কিন্তু জন উইক মুহূর্তের মাঝেই উঠে গিয়ে আবার মারামারিতে লিপ্ত।
কাউকে খুন করে ফেললে আশেপাশের মানুষের কোনো গত্যন্তর হয় না। মার্কেটে দোনাকে অবলীলায় গুলাগুলি করা যায়। চাইলেই কোনো পরিচ্ছন্নকর্মী পিস্তল নিয়ে তাকে ধাওয়া করে। এসব দেখে মানুষের বা প্রশাসনের কোনোই মাথাব্যথা হয় না। এরকম অনেক অনেক সীমাবদ্ধতা পাওয়া যায় এখানে। আর গল্পের প্লটের ত্রুটি তো আছেই।
তবে কেউ যদি অ্যাকশন মুভিতে এধরনের লজিক খুঁজতে যায় তাহলে অধিকাংশ মুভিতেই আনন্দ খুঁজে পাবে না। জন উইককে বাস্তবতা দিয়ে বিচার না করে অ্যাকশন হিসেবে কতটা সফল এই বিবেচনায় বিচার করা হয় তাহলেই সবচেয়ে ভালো হবে।
তথ্যসূত্র
১. videouniversity.com/articles/shaky-cam/ ২. slashfilm.com/cool-stuff-john-wick-2-pencil-gremlins-back-to-the-future-star-wars-alien-more/ ৩. কৃতজ্ঞতা: ফেসবুকের মুভি লাভার্জ পোলাপাইন, সিনেমাখোরদের আড্ডা, মুভি অ্যান্ড সিরিজ এডিকটেড গ্রুপ ৪. ফিচার্ড ছবি: Everyeye Cinema