চীনের শরৎ-বসন্ত (খ্রিস্টপূর্ব ৭৭১-৪৭৬ অব্দ) যুগের উপসংহারকালে আবির্ভূত হন চীনের ইতিহাসের প্রথম দার্শনিক, সুচিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ কনফুসিয়াস। প্রায় ৩০০ বছর ধরে চলা শরৎ-বসন্ত যুগে শিল্প, সাহিত্য, দর্শনে বেশ সমৃদ্ধি ও স্থায়িত্ব অর্জন করে চীন। শিক্ষা-দীক্ষায় সমৃদ্ধি অর্জনকারী চীনে সে সময় এক শ্রেণীর চিন্তাবিদের উদ্ভব হয়। অভিজাত পরিবার থেকে উদিত হলেও এদের অধিকাংশই তাদের গুরুত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন যোগ্যতার ভিত্তিতে। তাই এই মেধাবী চিন্তাবিদরা হয়ে যান তৎকালীন চৈনিক রাজতন্ত্রী শাসকদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কেননা তারা তৎকালীন চীনের সমাজ কাঠামোকে নতুন নতুন ধারণা দিয়ে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। সেই সময় সমগ্র চীনের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকেরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় যা ‘ওয়ারিং স্টেট পিরিয়ড’ নামে পরিচিত। এমতাবস্থায় চীনে একটি শক্তিশালী সরকার পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আর এই সময়েই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন কনফুসিয়াস।
দ্য সুপিরিওর ম্যান
সে সময়কার চীনের বেশির ভাগ মেধাবী মধ্যবিত্ত তরুণের মতো তিনি একজন প্রশাসক হিসেবে অনুসৃত হলেন। সেখানে তার দায়িত্ব ছিল তার সংস্থার উন্নয়ন ঘটানো। তিনি তখনকার শাসক এবং জনগণের সম্পর্ক এবং ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে অবগত ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি নীতিবোধের ওপর ভিত্তি করে শাসন ব্যবস্থার একটি পরিপূর্ণ ছক আঁকলেন, চেষ্টা করলেন সমাজ সংস্কারের। চৈনিক রীতিনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত সে নীতিবোধ বা নৈতিক দর্শনের মূল বক্তব্য ছিল আনুগত্য, কর্তব্য এবং সম্মান। তিনি মনে করতেন সমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যেই এসব গুণের সম্মিলন থাকা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তিনি সকলকে উৎসাহিত করতে থাকেন।
তার দর্শন অনুসারে, পৃথিবীর কোনো মানুষই নিখুঁত নয় তবে মানুষ মহৎ কিছু গুণের চর্চার মাধ্যমে তার স্বীয় প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তিনি জনগণের মানসিক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের মানসিক পরিবর্তনকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন। এ ব্যাপারে তিনি মনে করতেন, একটি ভাল সমাজের জন্য একজন শাসকের সে সকল গুণ ধারণ করতে হবে, যে সকল গুণ তিনি তার জনগণের মধ্যে দেখতে চান।
তিনি শাসকের দয়াশীলতা এবং জনগণের আনুগত্যকে পিতা এবং পুত্রের সম্পর্কের সাথে তুলনা করেন। পিতা যেমন তার স্বীয় পুত্রের প্রতি সর্বদা দয়াশীল এবং দায়িত্বশীল, তেমনি বাধ্যগত পুত্রও তার পিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ।
তিনি পাঁচটি ধ্রুব সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন: ১) শাসক-জনগণ, ২) পিতা-পুত্র, ৩) স্বামী-স্ত্রী, ৪) জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ এবং ৫) বন্ধু-বন্ধু। এই সম্পর্কগুলোতে তিনি শুধুমাত্র প্রজন্ম, বয়স এবং লিঙ্গের ওপর জোর দেননি, এর পাশাপাশি তিনি উভয় পক্ষের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এখানে অধস্তনের প্রতি উর্ধ্বতনের দায়িত্ব যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই উর্ধ্বতনের প্রতি অধস্তনের। সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি চৈনিক রীতিনীতিকে বেশ গুরুত্বের সাথে প্রতিস্থাপন করতে বলেছেন। এই সম্পর্কের ধারণা সমাজে বিস্তৃত আকারে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে এটি সমাজে পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা সৃষ্টি করে যা সমাজকে আরও এক ধাপ উপরে নিয়ে যেতে সহায়তা করে।
রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন
কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শনে কিছুটা গোঁড়ামি লক্ষ্য করা যায় রাজতন্ত্র বা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া শাসককে যথার্থ বিবেচনা করার মাধ্যমে। সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য প্রদানকৃত পারিবারিক সম্পর্কের ধারণাটিতে অনুসারে পিতাকে পরিবারের প্রধান হিসেবে দেখা যাচ্ছে। চৈনিক ঐতিহ্য অনুসারে পরিবার প্রধান অর্থাৎ পিতার কথা বিনা বাক্যে মেনে নেয়া হয়। উপরোক্ত সম্পর্কগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে তিনি পরিবার এবং রাষ্ট্র উভয় স্থানেই পরিবারের কর্তা বা রাষ্ট্রপ্রধানকেই যথার্থ বিবেচনা করেছেন যা রাজতন্ত্র চর্চার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
তবে কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শনের সব ক্ষেত্রে শাসক প্রশ্নাতীত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে তা নয়। কোনো শাসক যদি দেশ পরিচালনায় অযোগ্য এবং ব্যর্থ হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে তাকে অপসারণ করার চিন্তার কথাও প্রকাশ করেন তিনি।
সে সময় শাসক এবং জনগণের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং প্রশাসকেরা। কেননা উভয় দিকেই তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যেমন সঠিক আনুগত্যের প্রশ্ন ঠিক, তার অপর দিকে অগাধ বিশ্বস্ততার বিষয়। কনফুসিয়াস বুঝতে পেরেছিলেন এই দুটি কঠিন বিষয় এক সুতোয় গাঁথার জন্য প্রয়োজন চীনের সবচাইতে মেধাবী এবং যোগ্য ছেলেদের, যারা হবে সর্বোচ্চ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। তবে তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন এসব মেধাবী ছেলেদের নিয়োগ সম্ভব হবে তখনই, যখন শাসক হবেন সর্বোচ্চ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী।
সামাজিক প্রথা, অপরাধ এবং শাস্তি
চৈনিক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রথাগত বিভিন্ন আয়োজনের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল ধর্মের বিশেষ প্রভাব। সেসব অনুষ্ঠানে মানুষ সামাজিক রীতিনীতি পালনের মাধ্যমেই তাদের উর্ধ্বতনের প্রতি একধরনের আনুগত্য প্রকাশ করতো এবং একই সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবদান প্রকাশ করতো তাদের অধস্তনের প্রতি।
কনফুসিয়াসের নৈতিক দর্শনের কোনোকিছুই ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত না হলেও তার লেখা নোটগুলোর অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন আদব-কায়দা এবং শিষ্টাচারের উপদেশে পরিপূর্ণ। তিনি সর্বদা মানুষকে এ সকল সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি উৎসাহিত করতেন। কারণ তিনি দেখতেন একমাত্র এসব আচার-অনুষ্ঠানে মানুষ প্রকৃতপক্ষেই সততা এবং নিষ্ঠার সাথে যার যার দায়িত্ব পালন করতো। কে বলবে এসব রীতিনীতির মাঝে হয়ত তিনি তার আদর্শের প্রতিবিম্ব দেখতে পেতেন!
তৎকালীন চীনে অপরাধের শাস্তি দেয়া হতো ধর্মীয় বিধান অনুসারে। কিন্তু কনফুসিয়াস এ ব্যাপারে আরও উদার চিন্তা-ভাবনা করলেন। তিনি বলেন, “যা তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো না, তা তুমি অন্যের সাথে করো না”।
তিনি মনে করতেন আইনের শাসন দিয়ে মানুষকে শৃঙ্খলিত করা যায় না। কারণ আইন যত কঠোর, মানুষের তা ভঙ্গ করবার ইচ্ছা আরও বেশি প্রবল। অনেক ক্ষেত্রে হয়ত মানুষ আইনের দ্বারা ভীত হয়ে অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে, কিন্তু এতে করে তার আত্মার উন্নয়ন ঘটবে না। কিন্তু মানুষ যখন ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পেরে আত্মার উন্নয়ন ঘটাবে, তখন মানুষ নিজে থেকেই অপরাধের পথ ছেড়ে দিয়ে নৈতিক জীবনযাপন করতে শুরু করবে।
কনফুসিয়াস জীবিত অবস্থায় চীনের অধিকাংশ রাজ্য তার রাজনৈতিক দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কেননা এতে সে সময়কার চৈনিক অভিজাত পরিবারগুলো তাদের ক্ষমতা রক্ষা নিয়ে ব্যাপক শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল কনফুসিয়াসের নৈতিক দর্শন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে তাদের শোষণের সুযোগ কমে যাবে।
জীবিত অবস্থায় একমাত্র চীনের লু রাজ্য তিনি বেশ কিছুদিন শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞাবলে অল্প দিনেই শান্তির রাজ্য পরিণত হয় লু। আর তার মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে সমগ্র চীনে তার দর্শন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মানুষ বুঝতে পারে সমাজে শান্তি আনয়নের জন্য কনফুসিয়াসের দর্শনের বিকল্প নেই। এমনকি একবিংশ শতাব্দীর এই সময়েও কনফুসিয়াসের তত্ত্ব মানব কল্যাণের স্বার্থে অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কনফুসিয়াসের জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ধারণা করা হয় চীনের লু রাজ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ অব্দে তিনি জন্ম নেন। অল্প বয়সে তার বাবার মৃত্যু হলে সে সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপটে উন্নত চাকুরেরূপে তিনি যোগ দেন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে। সেখানে তিনি তার নৈতিক দর্শনকে ভিত্তি করে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নেন। কিন্তু রাজ্য সরকার তা অগ্রাহ্য করলে তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি ভ্রমণ এবং তার অনুসারীদের শিক্ষা দান করেন। ভ্রমণ করতে করতে তিনি শেষ বয়সে লু রাজ্য শাসন করার সুযোগ পান এবং সেখানেই খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ অব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এর মাধ্যমে যবনিকাপাত হয় তথ্য, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মিশেলে প্রকৃত মহৎ ব্যক্তি কনফুসিয়াসের।
ভ্রমণকালে একবার কনফুসিয়াসের এক শিষ্য তাকে প্রশ্ন করছিলেন, আমাদের সমাজ জীবনে মাঝে মাঝে মহৎ মানুষের আবির্ভাব হয়। এই মহৎ মানুষের সাথে অন্য সাধারণ মানুষের তফাৎ কী? কনফুসিয়াস উত্তরে বলেন,
“একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ তাঁর পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছুকেই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কোনোকিছুই গভীরভাবে চিন্তা করে না। শ্রেষ্ঠ মানুষেরা মনে করেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় সবকিছু চালিত হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ ভাগ্যের হাতেই নিজেকে সঁপে দেয়। শ্রেষ্ঠ মানুষ সর্বদাই নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে বড় করে দেখে। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে জীবনকে আরও উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়াই থাকে তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষ সর্বদাই অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে বড় করে দেখে, নিজেকে মনে করে সর্বদোষ মুক্ত”।
ফিচার ইমেজ – goodnet.org