সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই ব্যাপারে পরিবার, স্কুল কিংবা আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় শিক্ষা দিয়েছেন। তবে এই সম্পর্কে একেবারে সরকারি আইন ও কড়াকড়ি ব্যবস্থা কিংবা হস্তক্ষেপের ব্যাপারটা সকলের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। যেখানে আইন প্রণয়ন করে চুরি, ডাকাতি, এমনকি খুন-খারাবি কমাতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়, যেখানে আমজনতার নিরাপত্তা হয় প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে ভালো ব্যবহারের জন্য আলাদা আইন অনেকের কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা একটা স্বপ্নের মতো। তবে এর প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা করলে সব দেশেই এর প্রয়োগ করা উচিত।
আচ্ছা, এবার আমরা এমন একটি স্থান সম্পর্কে জানবো যেখানে ইতোমধ্যেই এরকম আইন-কানুনের প্রচলন রয়েছে। বলছি, যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হাওয়াইয়ের কথা। বিশেষ করে হাওয়াইয়ের রাজধানী হনলুলুতে এমন আইন লক্ষ্য করা যায়। হাওয়াইয়ের চমৎকার সমুদ্রসৈকত এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট হন পর্যটকরা। এখানে প্রতি বছর নয় লক্ষ পর্যটকের সমাগম ঘটে। পর্যটকরা হাওয়াইয়ে আসার পর সর্বপ্রথম যে শব্দটি শুনতে পান তা হয়তো ‘অ্যালোহা’। আর তা না হলেও এখানে অবস্থানকালে প্রায়ই এ শব্দটি শুনতে পাওয়া যায়। তবে শব্দটির ব্যবহার এবং অর্থ শুধুমাত্র একটি বিশেষ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়।
অতি ভালো ও সুন্দর ব্যবহারকে বিভিন্ন শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এর একটি হলো অ্যালোহা। এই অ্যালোহার বিষয়টি হাওয়াইয়ের আইনের একটি অংশ। অ্যালোহার ‘অ্যালো’ অংশটির অর্থ মুখোমুখি এবং ‘হা’র অর্থ জীবনের দম। অর্থের ব্যাখাটি দেন হাওয়াইয়ের ইতিহাসবিদ এবং ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের এথনিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ডাভিয়ানা পোমাইকাই মেকগ্রেগর।
তবে তিনি এটাও জানান যে, এর শাব্দিক অর্থ মূল বিষয়টিকে পুরোপুরি ব্যাখা করতে পারে না। ‘হ্যালো’ এবং ‘গুডবাই’ বলার পরিবর্তে হাওয়াইবাসী ব্যবহার করেন ‘অ্যালোহা’ শব্দটি। তবে এটা আরও বেশি অর্থবহ। এটি হাওয়াই প্রদেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক সংকেত প্রকাশ করে, যা দ্বারা জ্ঞান ও উদারতাকে বোঝানো হয়। সঙ্গীতশিল্পী পিলাহি পাকি অনেকভাবেই এই শব্দটির ব্যাখা দিয়েছেন। তার মতে, ‘অ্যালোহা’ হলো এমন কিছু যার অস্তিত্ব আছে এবং তা অনুভবও করা যায়, তবে ছুঁয়ে দেখা যায় না। আর এর সাথে মূলত মনস্তাত্ত্বিক বিষয় জড়িত। অ্যালোহাকে বলা হয় জীবনযাত্রার একটি আদর্শ ব্যবস্থা।
হাওয়াই যখন ভিয়েতনামের সাথে দ্বন্দ্বে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক অরাজকতায় জর্জরিত তখন পিলাহি পাকি আমজানতার সামনে এক আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়ার সময় অ্যালোহা সম্পর্কে বলেন। সবাইকে আবার নতুন করে এর অর্থ বুঝিয়ে বলেন।
‘অ্যালোহা’ (ALOHA) শব্দটির প্রত্যেকটি ইংরেজি বর্ণ দ্বারা কী বোঝানো হয় তা ব্যাখা করেন। পরবর্তীতে তার এই বক্তৃতাই হাওয়াইয়ের অ্যালোহা আইন তৈরি করার মূল মন্ত্রণা হিসেবে কাজ করে। ১৯৮৬ সালে ‘দ্য অ্যালোহা স্পিরিট ল’ সরকারিভাবে গৃহীত হয়। এই আইন সবাইকে শান্তিতে একসাথে থাকতে এবং কাজ করতে উৎসাহিত করে।
এবার পিলাহি পাকির ‘অ্যালোহা’ ব্যাখা করা নিয়ে একটু বলা যাক।
‘অ্যালোহা’ (ALOHA) এর ‘A’ দিয়ে ‘আকাহাই’ বোঝানো হয়, যার অর্থ উদার মানসিকতার সাথে কোনো কিছু বোঝার চেষ্টা করা বা চিন্তা করা। ‘L’ দিয়ে ‘লোকাহি’ বোঝায়। অর্থাৎ ঐক্য এবং ঐকতান বজায় রেখে চলা। ‘O’ দিয়ে ‘ওলু ওলু’-কে প্রকাশ করা হয়, যার মানে নিজের চিন্তা এবং এর সাথে অনুভূতির ক্ষেত্রেও ভারসাম্য বজায় রাখা। পরবর্তী বর্ণ ‘H’ সূচিত করে ‘হা আলা’কে। এর অর্থ নম্র থাকা। নম্রতাও প্রকাশ করতে হবে ভদ্রতার সাথে! সবশেষে ‘A’ দিয়ে বোঝনো হয়ে থাকে ‘আহোনোই’, মানে ধৈর্যশক্তিকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তা শেখা, একাকী ধৈর্যের সাথে কীভাবে চলতে হয় তা বোঝা। এককথায়, ধৈর্যশীল বা অধ্যবসায়ী হওয়া। দ্য হাওয়াইয়ান সিভিক ক্লাব অব ওয়াহিয়াওয়ার মতে, অ্যালোহা হলো যে প্রক্রিয়ায় আমরা চলি। প্রত্যেকটা দিন আমরা যেভাবে অতিবাহিত করি। অর্থাৎ অতি সাধারণভাবে শান্তিতে জীবন চলার সঠিক নিয়মই হলো অ্যালোহা।
১৯৮৬ সালের পূর্বে অ্যালোহা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ছিল না। তবে তা এর আগেও সকলে মেনে চলতো। আর এর মূল উৎস হাওয়াইয়ের সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে। ‘অ্যালোহা’র বিষয়টি আসলে নিজেদের প্রয়োজনেই তাদেরকে মানতে হয়। বিশ্বের বাকি দেশগুলো থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবেই পশ্চিমের দিকে অবস্থান করছে হাওয়াই। বিশ্বের সবচাইতে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী হাওয়াইয়ের অধিবাসীরা। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রায় ২,৪০০ মাইল দূরে এবং জাপান থেকে ৪,০০০ মাইলেরও বেশি দূরে অবস্থান করছে এই দ্বীপপুঞ্জ।
দ্বীপগুলো বেশ ছোট ছোট, যা একদিনেই ঘুরে দেখা সম্ভব। তাছাড়া দ্বীপগুলোর মাঝে কোনো ব্রিজ তৈরি করা সম্ভব হয়নি এবং বারবার এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়া যেমন সময়সাপেক্ষ তেমন বিপজ্জনকও বটে। তবুও পূর্বের যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে এখন তা বেশ উন্নত। শত শত বছর আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন আরও অনুন্নত ছিল, তখন হাওয়াইয়ের সাথে বহির্বিশ্বের কোনো যোগাযোগই ছিল না। এমন অবস্থায় নিজেদের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ যে নিজেদেরই ধ্বংস বয়ে নিয়ে আসবে তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল হাওয়াইবাসী। তাই এই বিচ্ছিন্ন আমেরিকান অঙ্গরাজ্যে শান্তি রক্ষার্থে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার লক্ষ্যে অ্যালোহা প্রয়োগ করা হয়। অনেকটা উপায় না পেয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো ব্যাপার আর কী।
ম্যাকগ্রেগর এ সম্পর্কে বলেন,
বিচ্ছিন্ন অবস্থান এবং সীমিত সম্পদের কারণে এই দ্বীপপুঞ্জের পূর্বপুরুষেরা সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। হাওয়াইবাসীর জন্য শ্রমের একমাত্র উৎস ছিল সেখানকার অধিবাসীরাই। তাই সেখানে দলগত কাজ করার প্রয়োজনীয়তা ছিল। এছাড়া এখানকার অধিবাসীদের অনেকটা যৌথ পরিবারে থাকতে হতো, যার জন্য সকলের মধ্যে ভালবাসা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের জন্ম হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ এই হাওয়াইবাসীর প্রতিবাদ করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। যেমন- দ্বীপের মুখ্য নেতা যদি ‘অ্যালোহা’ মেনে না চলতো, অর্থাৎ বাকিদের সাথে বিনয়ের সাথে আচরণ না করতো এবং তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতো, তাহলে এই শান্তিপ্রিয় অধিবাসীরাই সেই নেতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতো। এরকম প্রতিবাদের কথা আধুনিক অ্যালোহা আইনেও রয়েছে।
হাওয়াই স্টেট অ্যাটর্নির অফিসের তথ্য মোতাবেক, এই আইনটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতীকী। তবে এর মানে এই না যে, এর প্রয়োগ করা হয় না। অনেকেই মনে করেন যে, হয়তো রাজনীতি এবং ব্যবসায়িক কাজের সাথে যারা জড়িত, তাদের উপর এর প্রয়োগ একদমই নেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য নয়। হাওয়াইয়ের প্রথম ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ডায়না ভাওলা এ বিষয়ে বলেন,
যদি কোনো ব্যবসায়ী কিংবা সরকারি কর্মকর্তা অ্যালোহা অনুসারে না চলেন, তাহলে তারা নিজেদের ব্যবসা কিংবা সরকারি ক্ষমতা হারাতে পারেন এবং জনসম্মুখে শাস্তি পেতে পারেন। সুতরাং অ্যালোহা না মানলে এর পরিণাম ভোগ করতেই হবে। আমজনতা, নেতৃবৃন্দ এবং সকল সরকারি কর্মকর্তার জন্য এই আইন পালন করা বাধ্যতামূলক।
সবকিছুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। অ্যালোহারও কিছু খারাপ দিক রয়েছে। হাওয়াই ইনুইকা স্কুলের সহাকারী অধ্যাপক ওয়েন্ডেল কেকাইলোয়া পেরি এ বিষয়ে তার মতামত জানান। তিনি অ্যালোহা আইন নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা করেছেন। তাই এ সম্পর্কে তার জ্ঞানের পরিধিও বেশি। তার মতামতের প্রেক্ষিতে অ্যালোহা স্পিরিট আইন হাওয়াইয়ের সকলকে একই ধরনের আচরণে উদ্বুদ্ধ করে।
সময় অনুকূলে থাকলে অবশ্যই অ্যালোহা একটি ভালো ব্যবস্থা। তবে সময় প্রতিকূলে গেলে এর পরিণাম খারাপও হতে পারে। অনেক সময় নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে গেলে ও অন্যায়ের বিরোধিতা করতে গেলে তা নাশকতার নামে আখ্যায়িত করতে পারে শক্তিশালী দল। আর এজন্য সাধারণ জনগণ অত্যাচারের শিকারও হতে পারে। তবে অ্যালোহার মূলভাবটি সকলের মঙ্গলের জন্যই উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর প্রয়োগ ঠিকমত করা গেলে তা অবশ্যই সবার জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে, নতুবা এই অ্যালোহাই হয়ে দাঁড়াবে অভিশাপের নামান্তর।