ডার্বি!
শব্দটি শুধু হার-জিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দুই নগরী, দেশ ছাড়িয়ে এর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। দুটি ক্লাবের ইতিহাস, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সম্মান- সব কিছু জড়িয়ে থাকে একটি ডার্বি ম্যাচে। আজ আমরা জানবো ফুটবল ইতিহাসের সেরা দশটি ডার্বি সম্পর্কে।
১০. মিলান ডার্বি: এসি মিলান বনাম ইন্টার মিলান
ইতালিয়ান লিগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব ইন্টার মিলান ও এসি মিলানকে নিয়ে হওয়া এই ডার্বির উত্তেজনা ছুঁয়ে যায় পুরো বিশ্বজুড়ে। সিরি আ’র অন্যতম সফল এই দুই দল মিলে নিজেদের ট্রফি ক্যাবিনেটে সর্বমোট ৩৬টি স্কুদেত্তো ও ১০ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি যোগ করেছে।
১৯০৮ সালে এসি মিলানই মিলান শহরের প্রতিনিধি হিসেবে ইতালিয়ান লিগে খেলা শুরু করে। কিন্তু বিদেশি খেলোয়াড়ের চুক্তি নিয়ে অভ্যন্তরীণ ঝামেলা নিয়ে ক্লাবটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই থেকে সেই বছরই জন্ম হয় ইন্টার মিলানের। দুই দলের স্টেডিয়াম এক হওয়াতে খেলার উত্তেজনার পারদও থাকে তুঙ্গে।
বিশেষ করে ‘৬০ এর দশকে মিলান ডার্বি নিয়ে উত্তেজনা ছিলো চোখে পড়ার মতো। দুই দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২২২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে ইন্টার মিলান জিতেছে ৭৯টি এবং এসি মিলান ৬৭টি।
দুই ক্লাবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও বেশ কিছু খেলোয়াড় খেলেছেন দুই ক্লাবের হয়েই। তাদের মধ্যে রবার্তো ব্যাজ্জিও, এডগার ডেভিডস, প্যাট্রিক ভিয়েরা, লিওনার্দো বনুচ্চি, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, হার্নান ক্রেসপো, ক্লারেন্স সিডর্ফ, ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি, আন্দ্রেয়া পিরলো, রোনালদো নাজারিও প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
৯. রুহর ডার্বি: বরুশিয়া ডর্টমুন্ড বনাম শালকে
জার্মানির রুহর এলাকা থেকে আসা দুই ক্লাবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা একেবারে তুঙ্গে। প্রথমদিকে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড শালকের সাথে পেরে না উঠলেও ১৯৪৭ সালে প্রথমবারের মতো জয় তুলে নেয় ডর্টমুন্ড।
‘৬০ এর দশকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় দুই ক্লাব একই কাতারে নেমে আসে। বিশেষ করে ১৯৬৩ সালে দুই দলের মধ্যে ডার্বিগুলো আরো বেশি উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে।
যুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির শিল্প অবস্থা কিংবা ইতিহাস ও সংস্কৃতি সব কিছু মিলিয়ে দুই দলই একে অপরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। প্রথমদিকে ডর্টমুন্ড তেমন সুবিধা না করতে পারলেও দুই দলের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে ডর্টমুন্ডই। ডর্টমুন্ডের ৫০টি জয়ের বিপরীতে শালকের জয় ৪৫টি। লিগ টাইটেলে ডর্টমুন্ডের ৮ ট্রফির বিপরীতে শালকের ট্রফি ৭টি। খুব কম সংখ্যক খেলোয়াড়ই দুই দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন। সর্বশেষ খেলোয়াড় হিসেবে দুই ক্লাবেই খেলেছেন কেভিন প্রিন্স বোয়েটাং।
৮. গ্রেনাল ডার্বি: গ্রেমিও বনাম ইন্টারন্যাসিওনাল
ব্রাজিলের বিখ্যাত দুই ক্লাব গ্রেমিও ও ইন্টারন্যাসিওনালের নামের সাথে মিল রেখে এই ডার্বির নামকরণ করা হয়েছে গ্রেনাল ডার্বি। প্রতি ডার্বিতে ব্রাজিল ছেয়ে যায় রঙিন উৎসবে।
লাতিন আমেরিকার ফুটবল উৎসব নিয়ে বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তার উপর তা যদি হয় ডার্বি তা হলে তো কথাই নেই। ১৯০৩ সালে গ্রেমিও প্রতিষ্ঠিত হলে সেই বছরই প্রথম এই ডার্বি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গ্রেমিও বেশ ধনী ক্লাব বিধায় প্রথমদিকে তেমন পাত্তা পেত না ইন্টারন্যাসিওনাল। কিন্তু বর্তমানে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে ইন্টারন্যাসিওনালই। দুই দলের মধ্যে হওয়া ৪১৬ ম্যাচে ইন্টার জয় পায় ১৬০টিতে আর গ্রেমিও জয় তুলে নেয় ১৫৫টি ম্যাচে। তবে গ্রেমিও তিনবার কোপা লিবার্তোদোরোস জিতলেও ইন্টারন্যাসিওনাল জেতে দুবার।
৭. ম্যানচেস্টার ডার্বি: ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যানচেস্টার সিটি
পুরো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জুড়েই রয়েছে বেশ কিছু জনপ্রিয় ডার্বি। নর্থ-লন্ডন ডার্বি, মার্সিসাইড ডার্বি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব ডার্বি ছাড়িয়ে উত্তেজনার পারদ বেশি ওঠে ম্যানচেস্টার ডার্বিতে। বিশেষত গত এক দশকে এই ডার্বির জনপ্রিয়তা বেড়েছে কয়েকগুণ। এর পেছনে অবশ্য মূল কারণ ম্যানচেস্টার সিটির উত্থান।
২০০৮ সালে ম্যানচেস্টার সিটির মালিকানা বদলের পর থেকেই পরাশক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠে সিটিজেনরা। পরবর্তী বছরেই ইউনাইটেড বাহিনীকে ৪-৩ গোলে হারায় সিটিজেনরা। ২০১১/১২ মৌসুমে ওল্ড ট্রাফোর্ডে গিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৬-১ ব্যবধানে হারিয়ে ম্যানসিটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। যদিও শিরোপা কিংবা ইতিহাস সবদিক দিয়েই যোজন যোজন এগিয়ে আছে রেড ডেভিলরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের হিসেবে সিটিজেনদের বিপক্ষে তেমন সুবিধা করতে পারেনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আর সেজন্যই দিনকে দিন এই ডার্বির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে।
৬. উরুগুইয়ান ক্লাসিকো: ন্যাসিওনাল বনাম পেনারল
ইংল্যান্ডের বাইরে সবচেয়ে পুরনো ডার্বি হিসেবে খ্যাত উরুগুয়ের এই দুই ক্লাবের লড়াই। ১৯০০ সাল থেকে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হবার পর থেকে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ৫০০ বারের চেয়েও বেশি। দুটি ক্লাবই রাজধানী মন্টিভিডিওকে ঘিরে তৈরি। উরুগুইয়ান লিগে এই দুই দলের দাপট এতটাই প্রকট যে, ১০৮টি লিগ শিরোপার মধ্যে ৯০টিই ভাগাভাগি করে নিয়েছে এই দুই দল। এই দুই ক্লাব মিলে জিতেছে ৮টি কোপা লিবার্তোদোরোস শিরোপা।
দুই দলের মধ্যে অফিসিয়াল ৩৫৮টি ম্যাচের মাঝে পেনারল জিতেছে ১২৬টি এবং ন্যাসিওনালের জয় ১১১টিতে। দুই দলের লড়াই মানেই উত্তেজনা। ২০১৪ সালের এক প্রীতি ম্যাচ ঘিরে দুই দলের খেলোয়াড়েরা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই ঘটনার জের ধরে ৯ জন খেলোয়াড় রাত কাটিয়েছেন হাজতে এবং ১৭ জন খেলোয়াড় হয়েছিলেন বহিষ্কৃত।
৫. ইন্টারকন্টিনেন্টাল ডার্বি: ফেনারবাচে বনাম গ্যালতাসারাই
তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনটি ক্লাব- বেসিকতাস, ফেনারবাচে এবং গ্যালতাসারাই। কিন্তু এদের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ফেনারবাচে এবং গ্যালতাসারাইয়ের মাঝে। এই ডার্বির আরেক নাম ইন্টারকন্টিনেন্টাল ডার্বি। গ্যালতাসারাই ক্লাবটি মানচিত্র অনুযায়ী ইউরোপে পড়লেও ফেনারবাচে পড়েছে এশিয়ার অংশে।
এই ডার্বি উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে ১৯৯৬ সাল থেকে। সেবার টার্কিশ কাপ ফাইনালে ফেনারবাচের মাঠে গিয়ে গ্যালতাসারাই জয় তুলে নেওয়ার পর তৎকালীন গ্যালতাসারাই কোচ গ্রায়েম সৌনেস ম্যাচ শেষে গ্যালতাসারাইয়ের পতাকা কিক অফের জায়গাটায় পুঁতে দেন। তাতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে ফেনারবাচে।
দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে ফেনারবাচের জয় ১০৩টিতে। অন্যদিকে গ্যালতাসারাই জিতেছে ৮১ ম্যাচে। তবে ফেনারবাচের চেয়ে দুটি টার্কিশ লিগ বেশি জিতেছে গ্যালতাসারাই।
৪. ডার্বি ডেলা ক্যাপিটাল: লাজিও বনাম রোমা
অন্যান্য সব ডার্বিতে লিগের প্রধান দুই দলের লড়াই দেখা গেলেও এই ডার্বিতে রোমা এবং লাজিও দুই দলই সিরি আ তে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। দুই দল মিলে জিতেছে মোটে ৫টি স্কুদেত্তো। তারপরও এই দুই দলের চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতার পেছনে রয়েছে ইতিহাস।
১৯২৭ সালে ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি রোমার গোড়াপত্তন করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিলো দক্ষিণ ইতালির ফুটবল প্রাধান্যের ইস্তফা টানা। তাঁর এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদস্বরুপ সেই সময় লাজিও খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই সময় থেকেই দুই দলের ম্যাচগুলোয় দেখা যায় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা বিদ্যমান আজও।
৩. দ্য ওল্ড ফার্ম ডার্বি: সেল্টিক বনাম রেঞ্জার্স
প্রিমিয়ার লিগ থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ মুল্লুকে সবচেয়ে জনপ্রিয় ডার্বিটি স্কটিশ লিগে। গ্লাসগো শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দুই ক্লাব সেল্টিক ও রেঞ্জার্সের দ্য ওল্ড ফার্ম ডার্বিটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডার্বি। এই দুই দলের সাথে জড়িয়ে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতাও।
গ্লাসগো শহরে ক্যাথলিক এবং প্রোটেসট্যান্ট দুই ধরনের অনুসারীই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রোটেসট্যান্টরা অনেক ক্ষেত্রেই ক্যাথলিকদের দ্বারা নিপীড়িত। আর এদিকে সেল্টিক ক্লাবটি ক্যাথলিকভিত্তিক হলেও রেঞ্জার্স ক্লাবটি প্রোটেসট্যান্টদের দলে। তাই এই দুই দলের লড়াই শুধু খেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
শিরোপার সংখ্যায় সেল্টিককে ছাড়িয়ে উপরে রয়েছে রেঞ্জার্স। রেঞ্জার্সের সর্বমোট ১১৫টি শিরোপার বিপরীতে সেল্টিকের ট্রফি কেবিনেটে রয়েছে ১০৫টি শিরোপা।
২. এল ক্লাসিকো: বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ
ইতিহাস, ঐতিহ্য, গুরুত্ব, গুণাগুণের দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ডার্বি হিসেবে পরিচিত এই এল ক্লাসিকো, যা দেখার জন্য তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন সারা বিশ্বের ফুটবল সমর্থকেরা।
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৩৬ সালে কাতালুনিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন। সেই থেকে কাতালুনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করা বার্সেলোনার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদভিত্তিক ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের।
ম্যাচ চলাকালীন সময়ে এল ক্লাসিকোতে খেলোয়াড়দের হাতাহাতি কিংবা দর্শকদের মারামারি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বার্সেলোনা ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার দরুণ লুইস ফিগোর দিকে শুকরের মাথা ছুঁড়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে এক ম্যাচে। সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়েরা বার্সেলোনা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদে খেলার সুবাদে ম্যাচ হয়ে ওঠে আরো চিত্তাকর্ষক।
১. সুপার ক্লাসিকো: বোকা জুনিয়র্স বনাম রিভার প্লেট
নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বিখ্যাত ডার্বিটি সুপার ক্লাসিকো। আর্জেন্টিনার দুই ক্লাব রিভার প্লেট ও বোকা জুনিয়র্স ‘প্রতদ্বন্দ্বিতা’ শব্দটিকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তাই বিশ্বের যেকোনো ফুটবলপ্রেমীই চোখ বন্ধ করে এই ডার্বিটিকে স্থান দিবে এক নাম্বারে।
অন্যান্য ডার্বির মতোই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে সমাজের শ্রেণী বিভাজনের ফলে। বোকা জুনিয়র্স ছিলো সমাজের নিচু স্তর ও খেটে খাওয়া মানুষের দল। অন্যদিকে উঁচু শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলো রিভার প্লেট। দুটি ক্লাবের উৎপত্তিই আর্জেন্টাইন রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সকে ঘিরে।
অফিসিয়ালভাবে ২৪৮ ম্যাচে বোকার জয় ৮৯টিতে এবং রিভার প্লেটের জয় ৮২ ম্যাচে। লিগ শিরোপায় আবার এগিয়ে রিভার প্লেট। তারা ৩৬টি শিরোপা জিতলেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা জিতেছে ৩৩টি শিরোপা। তবে মর্যাদাবান কোপা লিবার্তোদোরোসে রিভার প্লেটকে টেক্কা দিয়েছে বোকা। গত বছরে ফাইনালে এই রিভার প্লেটের কাছে লিবার্তোদোরোস ফাইনাল হারলেও বোকার ঝুলিতে রয়েছে ৬টি শিরোপা, যেখানে রিভার প্লেট জিতেছে ৪টি।
আক্ষরিক অর্থেই এই ডার্বি ঘিরে এত সহিংসতা হয় যে, প্রতি ম্যাচেই নিয়োজিত করা হয় সহস্রাধিক পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মী।