২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ। রবিবার সকাল, আনুমানিক ১০টা কি ১১টা বাজে। দুই দিনের সরকারি ছুটি শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন তলার কর্মকর্তারা অফিসে বসে চায়ের কাপ হাতে হালকা গল্পসল্প ও হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত। ছুটির আলস্য ঝেড়ে ফেলে কাজের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন সময় মাননীয় পরিচালক মহোদয়ের উপস্থিতিতে ১০ তলার কর্মকর্তারা সবাই একটু নড়ে চড়ে বসলো।
পরিচালক মহোদয় এসেছেন একটা ছোটখাটো সমস্যার কথা শুনে। শুধুমাত্র অল্প কিছু মানুষের জন্য উন্মুক্ত ব্যাংকের যে ‘অ্যাকাউন্টস ও বাজেটিং’ বিভাগ, তার প্রিন্টারটা কাজ করছে না। যে প্রিন্টারে দিনরাত ব্যাংকের লেনদেন সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি প্রিন্ট হয় সয়ংক্রিয়ভাবে, সেটিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত দুই কার্যদিবস যাবত কিছু কারিগরি ত্রুটির পর সেদিন কাজ করা একেবারেই বন্ধ করে দিল। টেকনিশিয়ান ডেকে ঠিক করতে করতে চলে গেল কিছু সময়। এরপর এক সময় প্রিন্টার চালুও হলো। দেখা গেল, অকার্যকর হওয়ার আগে প্রিন্টারে যে যে নথি প্রিন্ট করার কমান্ড দেওয়া হয়েছিল, তা এক এক করে প্রিন্ট হয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু, কি যেন ঠিক নেই।
কর্মকর্তারা যখন ব্যাংক ট্রান্সফার সংক্রান্ত নথিগুলো দেখছিলেন, একটা অস্বাভাবিক বিষয় তাদের নজরে আসে যা দেখে রীতিমত গা শিরশির হওয়ার জোগাড়। কিছু আর্থিক লেনদেনের নথি পাওয়া গিয়েছে যেগুলো ব্যংকের কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তার উপর লেনদেনগুলো হয়েছেও বিভিন্ন দেশের ব্যংক অ্যাকাউন্টে। এরকম আর্থিক লেনদেনের সংখ্যা ৩৫টি। সব মিলিয়ে অর্থের পরিমাণও নেহাত কম নয়। ৯৫১ মিলিয়ন ইউ এস ডলার, মানে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যা বর্তমান হিসেবে (৮৪ টাকা ধরে) প্রায় ৮০০০ কোটি বাংলাদেশি টাকার সমমূল্যের অর্থ।
যারা ইংরেজি চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত, তাদের কাছে ব্যাংক ডাকাতি নতুন কিছু নয়। ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র। সেগুলোর কোনো কোনোটি অনেক বিখ্যাতও। হয়তো কোনো একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ডাকাতি নিয়েও হলিউড পাড়ায় শোরগোল উঠবে। উঠবে না-ই বা কেন? এ যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক ডাকাতি। আর সাইবার অপরাধের হিসেবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ডাকাতি।
দেশটা যখন নিজের, তখন খারাপ লাগে বৈকি। যেখানে নানা অর্থনৈতিক সমস্যায় এখনো সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষদের জীবন যাপনই এক একটা ট্র্যাজেডি, সেখানে এমন অর্থনৈতিক সংকট আমাদের জন্য নিঃসন্দেহেই দুঃসংবাদ। তবে দুঃখের মাত্রা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসবে যখন জানা যাবে, এই ৯৫১ মিলিয়ন ইউএস ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৮৮ মিলিয়ন উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, বাকিটাও উদ্ধার করার প্রক্রিয়া চলছে।
ঘটনার সূত্রপাত
২০১৫ সালের মে মাস। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যনিলার কিছুটা বাইরে আরসিবিসি (রিযাল কমারশিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন) ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ৪ জন লোকের প্রবেশ ঘটে। তারা প্রত্যেকেই সেখানে একটি করে অ্যাকাউন্ট খোলে। যাতে জমা পড়ে মাত্র ৫০০ ডলার। অ্যাকাউন্ট খোলার পর এগুলোর কোনোটিতেই আর লেনদেন হয় না।
জানুয়ারি, ২০১৬। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো এক কর্মকর্তা তার নিত্যদিনকার দায়িত্বের অংশ হিসেবে একটি ইমেইল পেয়ে সেটি খুলে দেখে। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো মেইল মনে হয় না তার কাছে সেটি। সেদিনের মতো কাজ শেষ করে বাসায় পৌঁছায় সেই কর্মকর্তা।
চক্রান্তকারীদের পাঠানো সেই মেইলটি ছিল একটি ভাইরাস, যা মেইল খোলার সাথে সাথেই ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে একটি ক্ষতিকর প্রোগ্রাম ইন্সটল করে ফেলে। এই প্রোগ্রামটির মাধ্যমে ব্যাংকের অনলাইন নেটওয়ার্কে ষড়যন্ত্রকারীদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এটি তাদেরকে ব্যাংকের কার্যক্রম সম্বন্ধে জানার সুযোগ করে দেয়, এছাড়াও তারা লক্ষ্য রাখতে পারে এর কর্মকর্তাদের উপর। এরপর শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
১ মাস পর। ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। বৃহস্পতিবার। দুই দিনের সরকারি ছুটিতে কর্মকর্তারা প্রস্থান করলে সেই ষড়যন্ত্রকারীরা অনুপ্রবেশ করে ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে। এবারের অনুপ্রবেশটাই তাদের শেষবার, কেননা এর জন্যই এতদিন ধরে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তাদের কার্যক্রমের পরবর্তী ধাপে আসে আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তরের কাজটি সুকৌশলে সম্পন্ন করা। কারণ এর নিরাপত্তার মাত্রাটা যেমন তেমন নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অনলাইন নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অতিক্রম করে যাওয়া এক বিষয়, আর সেই তুলনায় আরো অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সামরিক পর্যায়ের নিরাপত্তাবলয় সমৃদ্ধ সুইফট নামের নেটওয়ার্ককে টপকে যাওয়া পুরোপুরি ভিন্ন বিষয়।
সুইফট হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তরের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। হ্যাকিং প্রতিরোধে এর শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে অর্থ স্থানান্তরের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এর ওপর সবার আস্থা অটুট। কিন্তু এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, সুইফট কিন্তু অর্থ স্থানান্তরের কাজটা করে না। বরং স্থানান্তর সংক্রান্ত পেমেন্ট অর্ডার দিয়ে থাকে। এরপর এই অর্ডারের উপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অর্থ স্থানান্তর করে থাকে।
আর এই সুইফটকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াতেই রয়েছে হ্যাকারদের আসল ক্যারিশমা। সুইফটের দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই তারা জানুয়ারিতে সেই মেইলটি পাঠিয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা সুইফটে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় লগইন তথ্য পেয়ে যায় আর সম্পন্ন হয় পরিকল্পনার ২য় ধাপ।
প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সরাসরি সুইফট আক্রমণ না করে কেন এত কাঠখড় পোড়াতে গেল হ্যাকাররা? তার উত্তর হচ্ছে, সুইফটের নিরাপত্তাজাল এতটাই দুর্ভেদ্য যে কেউ যদি সেটাকে পাশ কাটাতে সক্ষমও হয়, তার জন্য গুণতে হবে কড়া মাশুল, রেখে যেতে হবে ডিজিটাল পদচিহ্ন, যা থেকে পরে খুঁজে বের করা যাবে তাদের। সে দিক থেকে, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়াটাই তুলনামূলক সহজ এবং কম ঝুঁকির। তাই হ্যাকাররা সরাসরি সুইফটের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য না বানিয়ে বরং সুইফটের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আইডি ও পাসওয়ার্ড সংগ্রহেই মনোযোগী হয়।
আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রবেশের কিছু সময় পর ৩৫টি অর্থ স্থানান্তর অনুরোধ পাঠানো হলো নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। সেখানে আছে ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট আর সেফটি ডিপোজিটে জমা আছে বড় রকমের অর্থ। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় এই অনুরোধে।
যেহেতু এই নির্দেশনা সুইফটের মাধ্যমে এসেছে, যার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত প্রশ্নাতীত, কাজেই এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং, অর্থের স্থানান্তর ঠেকানোরও কোনো কারণ নেই। আর এর মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রীরা তাদের শেষ ধাপটিও সাফল্যের সাথেই উত্তরণ করে। এরপর তাদের জন্য করার আর কিছুই নেই। এখন শুধু পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ সম্পাদন হওয়া বাকি। ডিনামাইটের তারে আগুন ধরানোর কাজ শেষ। এখন শুধু বিকট শব্দে ফাটার প্রতীক্ষা।
আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মচারীদের সময় যখন কাটছে সাপ্তাহিক ছুটিতে সে সময় নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে চলছে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ব্যস্ততা। এ ব্যস্ততারই একটা অনুষঙ্গ হিসেবে চলছে সেই ৩৫টি অর্থ স্থানান্তর নির্দেশের প্রক্রিয়াকরণের কাজ।
দুদিন পর, রবিবর। অফিস খোলা। ছুটি কাটিয়ে এসে কর্মকর্তারা সেই প্রিন্টারের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাকে প্রথম দর্শনে একটি যান্ত্রিক ত্রুটি বলে মনে হয়েছিল, সেটি আদতে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না মোটেও। হ্যাকাররা ইচ্ছা করেই এটা করার ব্যবস্থা করেছিল, যাতে করে সুইফট থেকে পাঠানো অর্থ স্থানান্তরের নিশ্চয়তাসূচক বার্তা হাতে পেতে কর্তৃপক্ষের দেরি হয়। এতে যেটা হবে, তাদের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ বাস্তবায়নের জন্য কিছুটা সময় তারা হাতে পাবে।
প্রিন্টারের যান্ত্রিক ত্রুটি সারানোর পর পিলে চমক লেগে গেল কর্তাব্যক্তিদের। প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থের স্থানান্তর নির্দেশনা দেখে চোখ কপালে উঠার যোগাড়। সাথে সাথেই তারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাথে। কিন্তু, দিনটা ছিল রবিবার, আর পশ্চিমা দেশগুলোতে রবিবার থাকে সাপ্তাহিক ছুটি। কাজেই, অর্থ স্থানান্তরের এই নির্দেশনাগুলো থামানোর ব্যাপারে তাদের আর্তচিৎকার শোনার জন্য ওপাশে কেউ নেই। আর, ফেডারেল ব্যাংকের কর্মচারীরা সোমবারে এসে এটা দেখতে দেখতে করার কিছু থাকবে না।
বাংলাদেশের জন্য ভাগ্যই বলতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে ত্রুটির কারণে এমন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটেও সেরকম নয়। যার কারণে, তাদের স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার সিস্টেম ৩৫টির মধ্যে ৩০টি লেনদেনের নির্দেশনা আটকে দেয়, যেন এগুলো পুনরায় আরেকবার ব্যাংকের কর্মচারীদের হাতে যাচাই হয়।
লেনদেনের এই নথিগুলোতে জুপিটার স্ট্রিট শাখা থেকে ‘জুপিটার’ শব্দটি উঠে আসে, যা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সিস্টেমে কালো তালিকাভুক্ত একটি শিপিং কোম্পানির নামের একাংশ (Jupiter Seaways Shipping)। ঘটনাটি একেবারেই কাকতালীয়। হ্যাকারদের জন্য এটি বড় একটি ব্যর্থতার নামান্তর, কেননা এতে করে প্রায় ৮৭০ মিলিয়ন ডলারের লেনদেন তখন বাধাপ্রাপ্ত। এবং, নিশ্চিতভাবেই এটা কর্তৃপক্ষের হাতে পড়লে অনুমোদনের আর সম্ভাবনা নেই। কারণ, এ নথিগুলোতে বেশ কিছু লাল চিহ্ন রেখে গেছে স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার সিস্টেম, যাতে তা পরবর্তীতে মানুষের হাত ধরে পুনঃনিরীক্ষণ হয়।
লাল চিহ্ন রাখার মূলে যে কারণগুলো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এত বিশাল অংকের অর্থ কোনো ব্যাংকে না গিয়ে সরাসরি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে যাওয়া, যা এ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে একেবারেই অচিন্ত্যনীয়। আর, তার জন্য সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের থেকে বিষয়টার সত্যায়ন প্রয়োজন। অতঃপর বাংলাদেশ ব্যাংকের থেকে এই লেনদেনগুলো বাতিলের যথাযথ নির্দেশনা পাওয়ার সাথে সাথে নিউ ইয়র্ক কর্তৃপক্ষ এগুলো স্থগিত করে দেয়।
কিন্তু এই ৮৭০ মিলিয়ন ঠেকানোর পরও তখনো রয়ে গেছে ৫টি নির্দেশনা, যাতে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ১০১ মিলিয়ন ডলার। প্রাথমিক অবস্থায় পরিমাণের বিবেচনায় এটি ছোট অংক হলেও একেবারে কমও নয়। এগুলোর কী হলো?
৩০টা গচ্চা যাওয়ার পর অবশিষ্ট ৫টার মধ্যে প্রথমটা যায় শ্রীলঙ্কায়। প্যান এশিয়া ব্যাংকে শ্যালিকা ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, ডয়েচ ব্যাংকের ভায়া হয়ে। এতে আছে ২০ মিলিয়ন ডলার। এতে কিছু সন্দেহজনক বিষয় চোখে পড়ে এক কর্মচারীর। বিশেষত, একটা এনজিওর জন্য এত বড় অংকের অনুদান আসাটা বেশ অস্বাভাবিক। কাজেই সেই কর্মচারীও এটা সত্যায়নের জন্য পাঠায় ভায়া হয়ে আসা সেই ব্যাংকে।
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মতোই এটাও যাচাইয়ের সময় ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত হয়, ফাউন্ডেশনকে (Foundation) ফ্যান্ডেশন (Fandation) হিসেবে লেখার কারণে। তারপর একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিষয়টা উপস্থাপন করা হলে শেষ পর্যন্ত এই নির্দেশনাটিও স্থগিত হয়ে যায়। শ্যালিকা ‘ফ্যান্ডেশনের’ নামে পাঠানো এ অর্থ পাঠিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্ক অ্যাকাউন্টে। ভাগ্যাকাশে আবারও রোদের ঝলকানি। বেঁচে গেল ২০ মিলিয়ন ডলার।
এরপর বাকি থাকে ৪টা লেনদেনের নির্দেশনা, যাতে আছে ৮১ মিলিয়ন ডলার। এই ৪টা আর কোনো আলাদা জায়গায় পাঠানো হয়নি। পাঠানো হয়েছে সেই রিজাল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার সেই ৪টা অ্যাকাউন্টে যা ২০১৫ সালের মে মাসে খোলার পর থেকে নিষ্ক্রিয় ছিল। বলা যায় একেবারে ভোজবাজির মতোই হঠাৎ করেই যেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল এই ৪ অ্যাকাউন্টধারী। এরকম অকস্মাৎ এবং বিশাল পরিমাণ অর্থের লেনদেনের বিষয়টা কোনো এক ‘অজানা’ কারণে রিজাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে যায়!
যাই হোক, যেভাবে হঠাৎ করে তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়েছিল, তেমনি আচমকাই তারা এসে তাদের টাকা তুলে নিয়ে যায়। এরপর মানি লন্ডারিংয়ের সহজ সূত্র মেনে টাকাটা তারা খাটায় ক্যাসিনোতে, জুয়া খেলার আসরে। এখানে ইলেকট্রনিক পন্থায় অর্থের লেনদেনের কারণে টাকার সূত্র এবং তার সাথে এই টাকা বহনকারীর সূত্র হারিয়ে যায় চিরতরে।
প্রশ্ন থেকে যায়, অন্যগুলোর মতোই বাংলাদেশ ব্যাংক এই লেনদেনের নির্দেশনা থামানোর কোনো চেষ্টা কি করেনি, এমনকি সোমবারেও? যথাসাধ্য চেষ্টাই হয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে সময় ফিলিপাইনে চৈনিক নববর্ষ চলার কারণে ব্যাংক ছিল বন্ধ। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহায্যের আবেদন শোনার জন্য ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মতোই কেউ ছিল না ওপাশেও। কাজেই ঘটনা সংঘটনের ৫ দিন পরে রিজাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন অর্থের এই লেনদেন আটকানোর নির্দেশনা দেখে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে ৬৮০ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি টাকা। সময় নির্বাচনে চক্রান্তকারীদের এই দূরদৃষ্টি নিঃসন্দেহেই প্রশংসার দাবি রাখে।
পরবর্তীতে যখন সূত্র বা তথ্যের আশায় এই অ্যাকাউন্টগুলো যাচাই করে দেখা হচ্ছিল, তখন চোখে পড়ে যে অ্যাকাউন্টধারীরা ছদ্ম পরিচয়ে এই অ্যাকাউন্টগুলো খুলেছিল। এটা অবশ্য তেমন একটা বিস্ময় জাগানিয়া ব্যাপার না, এতে বরং এই সন্দেহই জোরালো হয় যে, এই জালিয়াতির সাথে ব্যাংকের ভিতরের এক বা একাধিক কর্মকর্তার যোগসাজশ আছে।
তদন্তের পর ডিং ঝিযে এবং গ্যাও শুহুয়া নামে দুজন চৈনিক ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, ধরে নেওয়া যায় যে তারাই ওই নকল অ্যাকাউন্টগুলো খোলার পেছনে দায়ী। পুরো পরিকল্পনা সফলায়নের দাবা বোর্ডে শুধুমাত্র প্রান্তিক সৈনিক হিসেবেই তাদের উপস্থিতি। তবুও আরো তথ্যের আশায় যথাযথ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের গ্রেপ্তারের আগেই তারা চীন অধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ম্যাকাউয়ে চলে যায়। যেখান থেকে তাদের সন্ধান পাওয়া নিতান্তই দুঃসাধ্য। আর এর সাথে সাথেই চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে। আসল পরিকল্পনা অনুযায়ী সাফল্যের হার তর্কসাপেক্ষ হলেও, তাদের অর্জনকে একেবারে ফেলনাও বলা যায় না।
হ্যাকাররা তাদের পদচ্ছাপ লুকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এরপরও সেই ম্যালওয়্যার ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে দেখার সুযোগ পান। আর এতে তাদের চোখে পড়ে, হ্যাকারদের হ্যাকিং কৌশল আর তাদের অবলম্বন করা পদ্ধতির সাথে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া এ ধরনের আরো বেশ কিছু সাইবার হামলার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। যা থেকে ধারণা করা হয়, এটা একটা সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ। এ চক্রের নাম দেয়া হয় ‘ল্যাজারাস’।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আরও গভীরভাবে এ হামলাগুলো পর্যবেক্ষণকালে একটা অবিশ্বাস্য বিষয় খেয়াল করেন। যা থেকে দেখা যায় হ্যাকারদের ব্যবহার করা একটি আইপি অ্যাড্রেস এর সাথে কিম জং উনের নর্থ কোরিয়ার নাম। মানে, হামলাগুলো চলাকালীন হ্যাকিং কার্যক্রমের কোনো একটা সময়ে তাদের কেউ না কেউ নর্থ কোরিয়া থেকে কাজ করছিল।
তার মানে এই নয় যে, নর্থ কোরিয়াই এ হামলাগুলোর পেছনে দায়ী বা এর ইন্ধনদাতা। অবশ্যই এটা খুবই সম্ভব যে, তাদের ফাঁসানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই নর্থ কোরিয়াকে এ হামলাগুলোর জন্য দায়ী করছেন, কেননা হ্যাকিংয়ে ব্যবহৃত কম্পিউটার কোডে তাদের ভাষার আলামত পাওয়া তো গেছেই, বেশ কিছুদিন যাবতই তারা এ ধরণের সাইবার ক্রাইম আর সাইবারসন্ত্রাসের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। বিশেষত, তাদের প্রধান বৈরীসম্পর্কের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাউথ কোরিয়া তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর, তার সাথে যুক্ত হয়েছে, তাদের চলমান পারমাণবিক বোমা তৈরির কার্যক্রম, যাতে প্রয়োজন ব্যাপক আকারের অর্থ। এটিও তাদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের পালে দিচ্ছে জোর হাওয়া। এসব যদি সত্যি হয়, তবে এটাই হবে একটা রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপে সংঘটিত ১ম সাইবার অপরাধ।