আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম ১৮৭৭ সালে৷ এরপর প্রায় একশতক পরে, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে জন্ম ওয়ানডে ক্রিকেটে। তখনকার সময়ে টেস্ট ক্রিকেটের ন্যায় ওয়ানডে ক্রিকেটেও সাদা পোষাকে খেলা হতো। সময়ের পরিক্রমায় টেস্ট ক্রিকেট তার অতীত রুপে চলমান থাকলেও ওয়ানডে ক্রিকেটে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। নির্ধারিত ৬০ ওভারের পরিবর্তে ৫০ ওভার এবং সাদা পোষাকের পরিবর্তে রঙিন পোষাকে নিজেদের রাঙিয়ে মাঠে নামে প্রতিটি দল। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটাররা রঙিন পোষাক পরিধান করে মাঠে নামে।
তবে ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে প্রতিটি দলকে ক্রিকেট কাউন্সিল কর্তৃক বিভিন্ন রঙের একই ডিজাইনের পোষাকে খেলতে দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সাল হতে প্রতিটি দল তাদের জার্সিতে নিজেদের পছন্দ মতো রঙ ও নকশায় নিজেদের উপস্থাপন করে। প্রতিটি দল তাদের জার্সিতে নিজ নিজ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীক ছাড়াও স্বদেশের জাতীয়তাকে ফুটিয়ে তোলে এবং বিভিন্ন স্পনসর কোম্পানির ব্র্যান্ড লোগো ব্যবহার করে থাকে। আজ থাকছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পরিধানকৃত সেসব রঙিন পোষাক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
অস্ট্রেলিয়া
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম জাতীয় প্রতীক হিসেবে ফুলকে নির্ধারণ করেছিল অস্ট্রেলিয়া৷ সবুজ পাতায় সোনালী রঙের সেই ফুলটির নাম ছিল ‘গোল্ডেন ওয়াটল’। সেই অনুযায়ী তাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পোষাকে স্বদেশের প্রতীক হিসেবে জায়গা পায় উজ্জ্বল হলুদ ও সবুজ রঙ এবং তাদের ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকে জাতীয় পশু ক্যাঙ্গারুর ছবিও রয়েছে। রঙিন পোষাকে অস্ট্রেলিয়া মোট সাতটি বিশ্বকাপ খেলেছে। তার মধ্যে চারটিতেই তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে এবং আরেকটিতে হয় রানার্স-আপ।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ থেকে অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে স্থায়ীভাবে পাঁচটি তারকা স্থান পায়৷ পরীক্ষামূলকভাবে ২০১০ সালের শেষেরদিকে সম্পূর্ণ সবুজ পোষাকেও তাদের খেলতে দেখা যায়। তবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তারা যেন হলুদ ও সবুজের মাঝেই বেশ পরিচিতি লাভ করে এসেছে।
বাংলাদেশ
লাল-সবুজের আদলে যেন বাংলার বাঘের গর্জন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়। প্রতিটি বিশ্বকাপেই বাংলাদেশের জার্সিতে সবুজ-শ্যামল শস্যক্ষেতের মাঝে ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকে ফুটে উঠেছে গর্জনকারী বাঘের প্রতিচ্ছবি। ছদ্মনামের সাথে যেন পোষাকের এক অভিন্ন বন্ধন, সাথে লাল ও হলুদের সমারোহ।
মূলত জাতীয় পতাকা ও জাতীয় পশু বাঘের অবয়বই প্রকাশ পায় বাংলাদেশের পোষাকে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পোষাকে লাল-সবুজের মাঝে বোর্ডের প্রতীক থেকে প্রাপ্ত গর্জনকারী বাঘের জলছাপও দেখা যায়৷
ইংল্যান্ড
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে আকাশী নীল জার্সিতে দেখা গিয়েছিল। এরপর থেকে কখনো আকাশী গাঢ় নীল বা কালোর কাছাকাছি গাঢ় নীলের সাথে লাল স্ট্রাইপ ছিল, যাতে তাদের জাতীয় পতাকার সাথে বেশ সাদৃশ্য ফুটে ওঠে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের পোষাকে বড় আকারের তিনটি সিংহের ওপর রাজার মকুট সদৃশ সাদা রঙের জলছাপ দেখা যায়, যা তাদের ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকের প্রতিচ্ছবি।
গত বিশ্বকাপের জার্সিতে কালচে নীলের ওপর সিংহের পা সদৃশ কালো রঙের ছাপ দেখা যায়৷ জাতীয় পতাকার ন্যায় পোষাকে দীর্ষ ৩৬ বছর পর আবারো নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ জয়ের লড়াইয়ে নামবে ইংল্যান্ড। পারবে কি তারা নতুন ইতিহাস গড়তে?
ভারত
ভারতের প্রথম বিশ্বকাপের রঙিন পোষাক ছিল বেগুনি আভাযুক্ত নীল রঙের অন্ধকার ছায়া। এরপর থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপেই তাদেরকে আকাশী নীল রঙয়ের পোষাকে খেলতে দেখা যায়৷ ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপটি ভারতের সবচেয়ে স্মরণীয় একটি আসর ছিল। সেবার তাদের পোষাকে ছিল আকাশী-নীল রঙের উপর কৌণিকভাবে বোর্ডের প্রতীকের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ‘Y’ অক্ষরের মতো উজ্জল হলুদ রঙ। এবং কলারও ছিল হলুদ রঙের।
ঠিক পরের বিশ্বকাপে তাদের জার্সিতে ভারতের জাতীয় পতাকার অবয়ব বাঁকাভাবে ছাপানো ছিল এবং ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকটি জার্সির বুকের বা’পাশে ছিল। তবে সর্বশেষ ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে তাদের পোষাকটি উজ্জল নীল রঙের ছিল, এছাড়া অন্য কোনো রঙের ছাপ ছিল না।
নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ড তাদের সমসাময়িক ভক্তদের কাছে সাধারণত ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’ নামেই পরিচিত। তবে পূর্বে তাদের পোষাক বর্তমানের ন্যায় কালো রঙের ছিল না। ১৯৯২ এবং ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে তারা ধূসর বর্ণের পোষাক পরিধান করেছিল, যা ১৯৮০-১৯৮১ সিজনে অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় তাদের প্রতিবেশী ট্রান্স-তাসমান থেকে পাওয়া। এরপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপ আসরে নতুনভাবে তাদের জার্সিতে কালো রঙের আবির্ভাব ঘটে৷
পরের বছর সেই পোষাকেই তারা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা অর্জন করে। এরপর থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপ আসরেই তারা কালো পোষাকে খেলে থাকে এবং তাদের জাতীয় প্রতীক ফার্ন পাতা ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সর্বশেষ বিশ্বকাপ আসর ২০১৫ সালে তাদের পোষাকে কালোর সাথে উজ্জল নীল রঙও প্রকাশ পায়।
পাকিস্তান
১৯৯২ সাল। প্রথমবারের মতো রঙিন পোষাকে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ আসরটি। আর সেবারই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে পাকিস্তান। সেই হিসেবে পাকিস্তানী ভক্তদের কাছে ১৯৯২ সালের জার্সিটি তাদের জন্য সর্বকালের সেরা হয়েই থাকবে। পাকিস্তানের জার্সিতে কখনো হালকা ও কখনো গাঢ় সবুজ রঙের সমারোহের দেখা মেলে৷
১৯৯৯ সালের জার্সিতে হালকা সবুজের উপর গাঢ় সবুজের বড় একটি তারকা দেখা গিয়েছিল। তাদের ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকটিও একটি তারকার প্রতিচ্ছবি বহন করে। ঐ বিশ্বকাপটিও পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো। তবে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জার্সিতে হালকা-গাঢ় সবুজের মাঝে একটি চাঁদ ও তারকার প্রতিচ্ছবি ছিল। সর্বশেষ ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের জার্সির সাথে ১৯৯২ সালের জার্সির বেশ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিটি বিশ্বকাপ জার্সিই রঙিন। বর্ণবাদের কারণে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ১৯৯২ সালে সবুজ জার্সিতে প্রথমবারের মতো তারা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করে। এরপর থেকে তারা সবুজ-হলুদের সমারোহে সজ্জিত হয়। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের পোষাকে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের জাতীয় পতাকার ‘Y’ আকৃতির উল্টো প্রতিচ্ছবি হলুদ রঙে ছাপায়।
ঘরের মাটিতে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে সবুজের মাঝে বাঘের ধারালো রেখার জলচাপ ছিল। তাদের ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকে জাতীয় পতাকার নীচে তাদের জাতীয় ফুল প্রোটিয়ার অস্তিত্ব দেখা যায়, যা তাদেরকে ভক্তদের কাছে ‘প্রোটিয়া’ নামে পরিচিত করে তোলে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও গাঢ় সবুজ ও হলুদ রঙে সজ্জিত ছিল তাদের পোষাকটি।
শ্রীলঙ্কা
১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের ফলে সেই পোষাকটি শ্রীলঙ্কান ভক্তদের সর্বকালের সেরা পোষাক হিসেবে ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তবে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কান জাতীয় পতাকায় থাকা সিংহের ন্যায় বড় একটি জলছাপ তাদের জার্সি জুড়ে জায়গা পেয়েছিল। তাদের ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকটিও তলোয়ার বিশিষ্ট একটি সিংঘের প্রতিচ্ছবি দিয়ে সাজানো।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপ জার্সিতেও বৃত্তের ভেতরে সিংহের জলছাপের প্রতিচ্ছবি আবির্ভূত হয়েছিল। এবং তাদের প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপের জার্সিতেই নীলের মাঝে হলুদের সমারোহ ছিল। তবে সর্বশেষ বিশ্বকাপ আসরে ত্রিভুজ আকৃতির ছাপে সাগরের নীলে ছেয়ে গিয়েছিল তাদের পোষাকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সির রঙ ছিল তাদের টেস্ট ম্যাচের ক্যাপের ন্যায়। তখন থেকেই তাদের জার্সির প্রাথমিক রঙ হিসেবে গাঢ় মেরুন বর্ণটি পরিচিতি লাভ করে। এছাড়াও কলার ও পার্শ্বে হলুদ এবং সবুজ রঙের ব্যবহারও দেখা যায়।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো তাদের পোষাকে নারকেল গাছের অন্তরালে সূর্যের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। পরবর্তীতে সেই গাছ ও সূর্য তাদের ক্রিকেট বোর্ডের প্রতীকে প্রকাশ পায়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও তারা গাঢ় মেরুন বর্ণের সাথে হলুদ রঙের কলার ও পাড় বিশিষ্ট পোষাকে মাঠে নেমেছিল।