আপনার কি কখনো কখনো খুব অস্থির লাগে, নিজের উপর বিরক্তিবোধ হয় যে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়েছেন কোনো ‘কাজের কাজ’ না করে?
নিশ্চয়ই হয়। অনেক সময়ই হয়তো দেখা যায় একটি ছুটির দিন আপনি ঠিক করে রেখেছেন বাসায় বসে বিশ্রাম নেবেন, কিন্তু একই সাথে এমন কিছু একটা করবেন যাতে মনের খোরাক পাওয়া যায়, আত্মোন্নয়ন বা দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়। সেটি হতে পারে বই পড়ে, কোনো সিনেমা দেখে, কিছু লেখালেখি করে, নতুন কয়েকটি শব্দ শিখে, কিংবা অন্য যেকোনো ভাবে। কিন্তু দিনশেষে দেখা যায় আপনি পরিকল্পনা মাফিক কিছুই করে উঠতে পারেননি। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের উপর আপনার প্রচণ্ড রাগ লাগে, গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হতে হয়।
অথচ আজকাল আত্নোন্নয়ন, মনের খোরাক জোগানো কিংবা ‘প্রোডাক্টিভ’ কাজ করা কিন্তু খুবই সহজ হয়ে গেছে। আপনার হাতে যদি ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় এবং একটি ইন্টারনেট সংযোগসহ ডিভাইস থাকে, তাহলেই আপনি দেখে ফেলতে পারেন খুবই চমকপ্রদ কোনো বিষয় বা ধারণার উপর আলোকপাত করা একটি টেড টক।
টেড টক কী?
টেড টক সম্পর্কে জানার জন্য আপনাকে মূলত জানতে হবে টেড কী। এটি একটি অলাভজনক সংগঠন যারা নিবেদিত রয়েছে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উদ্ভাবনী ধারণা ও উদ্দীপক আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে দিতে, আর তা-ও মাত্র ১৮ মিনিট বা তার কাছাকাছি সময়ব্যাপী বক্তৃতার মাধ্যমে।
টেড (TED) হলো তিনটি ইংরেজি শব্দের আদ্যক্ষর: Technology (প্রযুক্তি), Entertainment (বিনোদন) এবং Design (নকশা)। তবে টেডের বিস্তৃতি কেবল এই তিনটি বিষয়েই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্ভাব্য সকল বিষয়ের উপরই নতুন ও বিচিত্র সব বক্তৃতা তৈরির চেষ্টা করে। এই বক্তৃতাগুলো তথ্যবহুল তো বটেই, পাশাপাশি অনুপ্রেরণাদায়ীও। ফলে দর্শকশ্রোতা নিত্যনতুন সৃজনশীল ভাবনার সাথে যেমন পরিচিত হয়, তেমনই নিজেদের জীবনে সেগুলোকে প্রয়োগের ব্যাপারে প্রণোদিতও হয়। কিন্তু কোনোভাবেই টেডের এই বক্তৃতাগুলোকে তথাকথিত ‘মোটিভেশনাল স্পিচ’-এর সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
কেন জনপ্রিয় টেড টক?
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে টেড সম্মেলনের মাধ্যমে লাইভ অডিয়েন্সের সামনে বক্তৃতাগুলো প্রদান করে থাকেন টেডের বক্তারা। টেডের প্রায় প্রতিটি বক্তৃতাই ১৮ মিনিট বা তার কাছাকাছি সময় দীর্ঘ; অর্থাৎ সময়টা খুব সংক্ষিপ্তও নয় যে দর্শকশ্রোতারা সেগুলো থেকে খুব বেশি কিছু লাভ করতে পারবে না, আবার সময়টা খুব লম্বাও না যে দর্শকশ্রোতারা একটানা লেকচার শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে উঠবে। বরং এমন একটি সময়ব্যাপী প্রতিটি বক্তৃতা ব্যাপ্ত যে সেটি থেকে দর্শকশ্রোতা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বেশ ভালো ধারণা পেয়ে যায়, অথচ শ্রেণিকক্ষে কাটানো বিরক্তিকর সময়ের অভিজ্ঞতা তাদের হয় না।
এ কারণে টেডের বক্তৃতাগুলো সম্মেলনে উপস্থিত দর্শকশ্রোতাদের মন তো জয় করেই, পাশাপাশি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে এটি জয় করে নিয়েছে ইন্টারনেট দুনিয়াকেও। টেডের সব বক্তৃতাই হয়তো হিট হয় না, কিন্তু কিছু কিছু বক্তৃতা দর্শকশ্রোতাদের সাথে এত গভীর ও শক্তিশালী আবেগিক সংযোগ স্থাপন করতে পারে যে, অল্প সময়ের মধ্যেই সেগুলোর ভিডিও ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতিতে ভাইরাল হয়ে যায় সেগুলো, লাভ করে তুমুল জনপ্রিয়তাও।
পথচলার শুরুটা
টেডের পথচলার কাহিনী শুরু হয়েছিল সেই ১৯৮৪ সালে, অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জন্মেরও বছর পাঁচেক আগে। একটি সম্মেলন হিসেবে এটি যাত্রা শুরু করেছিল মন্টেরে, ক্যালিফোর্নিয়ায়; রিচার্ড সল উরম্যান নামের এক স্থপতির হাত ধরে।
উরম্যান চেয়েছিলেন টেড হবে সেই “আল্টিমেট ডিনার পার্টি”, যেটির আয়োজকের ভূমিকায় থাকবেন তিনি নিজে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি সিলিকন ভ্যালি, হলিউডসহ যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাঙ্গনের শ্রেষ্ঠতম সব বক্তাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেই সম্মেলনে।
আজকের দিনে টেড সম্মেলনগুলোতে বক্তারা যা বলেন তা সাধারণত স্ক্রিপ্টেড হয়ে থাকে, বহুদিন ধরে সেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে অনুশীলনের মাধ্যমে বক্তারা নিজেদেরকে দর্শকশ্রোতার সামনে উপস্থাপনের যোগ্য করে তোলেন। কিন্তু উরম্যানের প্রকৃত টেড ধারণায় স্ক্রিপ্টিংয়ের কোনো ব্যাপার ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন টেড সম্মেলনগুলো হবে একেকটি “অ্যান্টি কনফারেন্স” — সেখানে থাকবে না কোনো বিরক্তিকর পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড কিংবা এক ঘণ্টার একঘেয়ে লেকচার। এর বদলে তিনি চেয়েছিলেন তুখোড় মেধাসম্পন্ন মানুষেরা মঞ্চে উঠে স্রেফ তাদের ধারণার কথা বাকিদের সামনে তুলে ধরবেন, তারা কথা বলবেন সেইসব বিষয় নিয়ে যেগুলো তাদেরকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করে।
১৯৮৪ সালের প্রথম টেড সম্মেলনটিতে বক্তারা আলোচনা করেছিলেন কমপ্যাক্ট ডিস্ক উৎপাদন ও এর কার্যপ্রণালী এবং একটি ই-বুক রিডার নিয়ে। এছাড়াও সেখানে ছিল লুকাসফিল্মসের ত্রিমাত্রিক গ্রাফিকস ডিজাইন এবং ফ্র্যাক্টাল গণিতবিদ বেনোয়া ম্যান্ডেলব্রটের একটি উপস্থাপনা। কিন্তু নামজাঁদা সব বক্তাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও, টেডের প্রথম সেই সম্মেলনটি ছিল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ।
ছয় বছর পর…
প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠে ১৯৯০ সালে উরম্যান আবার চেষ্টা করেন টেড সম্মেলন আয়োজনের, এবং সেবারই প্রথম টেডের বক্তৃতা ১৮ মিনিট ফরম্যাটে উপনীত হয়। এছাড়া সেবার সবার জন্য উন্মুক্ত করার বদলে সম্মেলনটি সীমাবদ্ধ রাখা হয় কেবল শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক ও মেধাবীদের জন্য, যে কারণে ওই বছর টেড সম্মেলনের টিকিট পাওয়া অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছিল বিশাল সম্মানের স্মারক।
টেড সম্মেলনে বক্তাদের তালিকা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং সেখানে সংযুক্ত হতে থাকে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সঙ্গীতশিল্পী, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, লোকহিতৈষী ব্যক্তিত্বসহ আরো অনেকে। একই সমান্তরালে টেড সম্মেলনে অংশগ্রহণের প্রতি মানুষের আকর্ষণও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, যদিও এটি শুধু নিমন্ত্রিত গুটিকয়েক মানুষের মাঝেই সংক্ষিপ্ত থাকে।
মালিকানার হাতবদল
টেড সম্মেলন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল গণমাধ্যম উদ্যোক্তা ক্রিস অ্যান্ডারসনেরও। তিনি ২০০০ সালে উরম্যানের সাথে দেখা করে কথা বলতে চান টেড সম্মেলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ততদিনে উরম্যানও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন টেড নিয়ে কাজ করতে করতে। তাই অ্যান্ডারসনের সাথে একটু চুক্তি করেন তিনি, এবং ২০০১ সালে অ্যান্ডারসনের অলাভজনক সংগঠন স্যাপলিং ফাউন্ডেশন নিয়ে নেয় টেডের মালিকানা।
নতুন ‘কিউরেটর’ অ্যান্ডারসন সর্বাত্মক চেষ্টা করতে থাকেন টেডকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার, যেটি কোনোদিনই উরম্যানের লক্ষ্য ছিল না। অ্যান্ডারসন প্রথমে চেষ্টা করেন টেডকে টেলিভিশনে নিয়ে আসতে। কিন্তু তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারপরও অ্যান্ডারসন মনোযোগী হন অন্যভাবে টেডের বিস্তারের। তিনি উদ্বোধন করেন টেড গ্লোবালের, যেটির অধীনে টেড সম্মেলনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। এছাড়া টেড বক্তৃতাগুলোর মানোন্নয়নের দিকেও তার ছিল সজাগ দৃষ্টি, যেজন্য তিনি বছরের সেরা বক্তার জন্য ১ মিলিয়ন ডলার অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
ইউটিউবের ভূমিকা
টেড আজ যে অবস্থানে পৌছেছে, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ইউটিউবের। ২০০৬ সালে ইউটিউবের মাধ্যমে অনলাইন ভিডিও শেয়ারিং ধারণাটি জনপ্রিয় হতে শুরু করলে, সেটিকে কাজে লাগান অ্যান্ডারসন। ‘টেড টক’ নামে একটি পরীক্ষামূলক ভিডিও পডকাস্ট শুরু করেন তিনি। সেটি সফল হলে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন “ideas worth spreading” শিরোনামে টেড সম্মেলনের সেরা বক্তৃতাগুলোকে বিনামূল্যে অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেয়ার। তখন থেকে অনলাইনই হলো টেডের বক্তৃতাগুলো দর্শকশ্রোতার কাছে পৌঁছানোর বৃহত্তম মাধ্যম।
অনলাইনে সব বড় কিছুর শুরু হয় একটি কিছু ভাইরাল হওয়ার মধ্য দিয়ে। টেডের ক্ষেত্রেও সেটি হয়েছিল। টেডের প্রথম ভাইরাল ভিডিওটির কৃতিত্ব ছিল স্যার কেন রবিনসনের। ২০০৬ সালেই তিনি “Do schools kill creativity?” শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেন, যেটি আকস্মিকভাবে টেডকে সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করে। এটিই ছিল টেডের প্রথম ভিডিও যা এক মিলিয়নের বেশি মানুষ দেখে, যা তখনকার দিনে ছিল অবিশ্বাস্য এক অর্জন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় টেড আজ এতটাই জনপ্রিয় যে, মিলিয়ন ক্লাবে প্রবেশ করা বক্তাদের জন্য ডাল-ভাত হয়ে গেছে।
যেভাবে ‘তৈরি’ করা হয় বক্তাদের
একটি জিনিস নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, সব পাবলিক স্পিকারই কিন্তু শ্রেষ্ঠ মননের অধিকারী হন না। আবার নিজ আগ্রহের বিষয়ে সর্বোচ্চ মানুষটির পক্ষেও সবসময় মঞ্চে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষের সামনে কথা বলা সম্ভব হয় না। কিন্তু টেডের সম্মেলনগুলোতে আমরা দেখি একদমই ভিন্ন চিত্র। সেখানকার বক্তারা জ্ঞান ও মননে যেমন সর্বোচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন, তেমনই আবার পাবলিক স্পিকার হিসেবেও তাদের তুলনা হয় না।
মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, টেড কর্তৃপক্ষ কীভাবে এমন মানুষদের খুঁজে বের করে যারা জ্ঞান ও মেধায় অতুলনীয়, আবার কথা বলার পারদর্শিতাও তাদের দারুণ?
প্রকৃতপক্ষে, টেড কর্তৃপক্ষ এমন মানুষদের খুঁজে বের করে যতটা, তারচেয়ে নিজেরাই ‘তৈরি’ করে বেশি। আর সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে স্বয়ং টেড কিউরেটর ক্রিস অ্যান্ডারসনের। তিনি লং বিচ, ক্যালিফোর্নিয়ার অর্ধ-বার্ষিক টেড সম্মেলনগুলোর জন্য নিজে বেছে নেন বক্তাদের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো মঞ্চে উঠে, ভরা মজলিসে কথা বলতে অভিজ্ঞ, কিন্তু বেশিরভাগই একদম মুখচোরা, অন্তর্মুখী, বড় জমায়েতে কথা বলার পূর্ব-অভিজ্ঞতা যাদের নেই বললেই চলে।
কিন্তু আমরা অনলাইন ভিডিওগুলোতে দেখি, এই মানুষগুলোই কী সুন্দর গড়গড় করে কথা বলে যাচ্ছেন, তাদের মাঝে এতটুকু সংকোচ বা অস্বস্তিও দেখা যাচ্ছে না। এটি সম্ভব হয়, কারণ মূল অনুষ্ঠানের আগে তাদের নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে কাজ করা হয়। তাদের বক্তৃতার জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার আগে প্রচুর গবেষণা করা হয়, বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বারবার সেই স্ক্রিপ্টের সম্পাদনা করা হয়, এবং সবশেষে টেড কোচরা হাতে ধরে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন সবার সামনে কথা বলার উপযুক্ত হয়ে ওঠার।
একটি ‘অবিস্মরণীয়’ টেড টক প্রদানের কিছু টোটকা
২০১৩ সালে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন টেড কিউরেটর অ্যান্ডারসন, যেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন একটি ‘অবিস্মরণীয়’ টেড টক প্রদানের কিছু সহজ উপায়। তার সেই লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, একটি টেড টক সৃষ্টির প্রস্তুতি শুরু হয় মূল সম্মেলনের ছয় থেকে নয় মাস আগেই। এবং তখনই বক্তারা নির্ধারিত বিষয়বস্তুর উপর তাদের বক্তৃতার একটি কাঠামো তৈরি করে নেন, অর্থাৎ কীভাবে তারা বক্তৃতা শুরু করবেন, আর কীভাবেই বা ইতি টানবেন।
এছাড়াও তার অন্যান্য পরামর্শের মধ্যে ছিল:
- বক্তৃতার আঙ্গিক হতে হবে কোনো ব্যক্তিগত যাত্রা বা অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণার মতো। একটি সফল টেড টক হতে হবে এমন যেন দর্শকশ্রোতাদের কাছে সেটিকে ছোটখাটো কোনো ‘অলৌকিক ঘটনার’ মতোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, এবং সেটি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়ার মতো শক্তিশালী হয়।
- একসাথে সব বিষয়কে কভার করতে যাওয়ার বদলে, বিশেষ কিছু বিষয়ের উপর ফোকাস করতে হবে। ব্যাখ্যা প্রদান আরো আকর্ষণীয় হয়ে যাবে যদি আপনি বাইরের কোনো উদাহরণ না এনে, নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন।
- টেলিপ্রম্পটার ব্যবহার করা যাবে না। অন্য অনেক সম্মেলনেই টেলিপ্রম্পটার ব্যবহার করা হয়, কিন্তু টেডের সম্মেলনগুলোতে এই জিনিসটিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এখানে গুরুত্বারোপ করা হয় বক্তাকে নিজের বক্তব্যের পুরোটা মনে রাখা বা মুখস্ত করে ফেলাকে। তবে যদি বক্তা ভীত হন বা ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নোট কার্ডে লিখে নেয়া যেতে পারে।
- বক্তৃতা প্রদানকালে দর্শকশ্রোতার সাথে আই কনট্যাক্ট বা চোখের যোগাযোগ খুব জরুরি। তাই কথা বলার শুরুতেই দর্শকসারির বিভিন্ন জায়গায় বসা পাঁচ-ছয়জন মানুষকে বেছে নেয়া যেতে পারে, যাদের সাথে চোখাচোখি হলেও আপনি অস্বস্তিবোধ করবেন না, বরং পুরো বক্তৃতাটাই ওই কয়েকজন মানুষের সাথে আই কনট্যাক্ট করেই শেষ করে দিতে পারবেন।
- বক্তৃতা প্রদানকালে খুব বেশি হাঁটাচলা বা নড়াচড়া করা যাবে না। অনেক বক্তাই কথা বলার সময় ভীতি কাটাতে মঞ্চের একদিক থেকে অন্যদিকে হেঁটেচলে বেড়াতে থাকেন। কিন্তু এতে দর্শকশ্রোতাদের পক্ষে তার কথায় মনোনবেশ করা কঠিন হয়ে যায়। তাই সবচেয়ে ভালো হয় এক জায়গাতেই স্থির থেকে, হাতের ইশারা, অঙ্গভঙ্গি, মৌখিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিজেও সহজ হওয়া, সেই সাথে দর্শকশ্রোতাদের জন্যও আপনার বক্তৃতাকে সহজবোধ্য করে তোলা।
- পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড বা ভিডিওর উপর খুব বেশি নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। সেগুলোর পরিমিত ব্যবহার করতে হবে। কেবল যেসব জায়গায় শুধু মুখে বলেই ব্যাখ্যা করা বা উদাহরণ দেয়া সম্ভব না, সেসব ক্ষেত্রেই স্লাইড বা ভিডিও দেখাতে হবে।
টেডের বক্তাদেরকে উৎসাহিত করা হয় মূল সম্মেলনের আগে কোনো ছোটখাটো জমায়েতের সামনে তাদের বক্তৃতা প্রদান করতেও, যেন তারা প্রাথমিক মঞ্চভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেন, এবং মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
এই কয়েকটি নিয়ম মেনে চললে যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অন্তর্মুখী মানুষের পক্ষেও পাবলিক স্পিকিং করা সম্ভব, ২০১২ সালে সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সুসান কেইন। বর্তমানে তিনি বিবেচিত হন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত অন্তর্মুখী ব্যক্তি হিসেবে।
টেড সম্মেলনের প্রকারভেদ
টেডের সম্মেলনগুলোর নানা রকমফের রয়েছে। সাধারণ টেড সম্মেলন বলতে কেবল ওই সম্মেলনগুলোকেই বোঝানো হয়, যেগুলো সরাসরি টেড কর্তৃপক্ষের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনগুলোকে বলা হয় টেড কনফারেন্স কিংবা টেড গ্লোবাল।
তবে এর বাইরেও প্রতি বছর টেডের ব্যানারে এমন আরো অনেক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেগুলোর আয়োজক সরাসরি টেড কর্তৃপক্ষ নয়। এ ধরনের সম্মেলনগুলোকে বলা হয় টেডএক্স (TEDx)। এখানে ইংরেজি x দ্বারা বোঝানো হয়ে থাকে স্বাধীনভাবে আয়োজিত টেড সম্মেলন। কেউ যদি নিজের বিশ্ববিদ্যালয় বা এলাকায় টেডের মতো অনুষ্ঠান করতে চায়, তাহলে তাকে টেড কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাইসেন্স (বিনামূল্যে) নিতে হয়, এবং টেডের যাবতীয় নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়। এ ধরনের সম্মেলনেও দর্শকশ্রোতারা অনেকটা আসল টেড সম্মেলনের মতো অভিজ্ঞতাই পেয়ে থাকে। বাংলাদেশেও ইদানিং আয়োজিত হচ্ছে টেডএক্স।
টেড কিংবা টেডএক্স সম্মেলনগুলোতে একটি বিষয় কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, তা হলো—এগুলোতে কখনোই কোনো বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে বক্তা হিসেবে সুযোগ দেওয়া হয় না। অর্থাৎ ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কখনোই বক্তারা কথা বলতে পারেন না।
নিজের প্রতিষ্ঠানে বা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় টেডএক্স সম্মেলন আয়োজন করার জন্য যে লাইসেন্স আয়োজকদেরকে নিতে হয় তার জন্য আয়োজক অথবা টেড কর্তৃপক্ষ কাউকেই অন্যকে কোনো ধরণের অর্থ প্রদান করতে হয় না। ঠিক একইভাবে টেডএক্স সম্মেলনে আমন্ত্রিত বক্তারা যেমন আয়োজকদের কোনো টাকা দেন না, তেমনই আয়োজকরাও বক্তাদের বক্তব্যের জন্য কোনো অর্থ প্রদান করেন না।
এছাড়া ২০১২ সালের মার্চ থেকে কার্যক্রম শুরু হয় টেড এড-এর, যার উদ্দেশ্য খুব অল্প সময়ের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরি করে সবাইকে জ্ঞানের কাছাকাছি নিয়ে আসা।
টেডের সমালোচনা
টেডের জনপ্রিয়তা নতুন কোনো বিষয় নয়। ২০১২ সাল নাগাদই টেডের ভিডিওগুলো অনলাইনে এক বিলিয়নের বেশি দেখা হয়ে গিয়েছি; এবং এরপর থেকে এর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তারপরও, অন্য আর সব জনপ্রিয় গণমাধ্যমের মতো, টেডকেও হতে হয়েছে নানাবিধ সমালোচনায় জর্জরিত।
টেডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, এটি ‘এলিটিস্ট’ অর্থাৎ কেবল অভিজাত শ্রেণির জন্য। এর কারণ, টেড শুধু তাদের বক্তাদেরই কিউরেট করে না, একই কাজ করে তাদের প্রধান বার্ষিক সম্মেলনগুলোর ক্ষেত্রেও। লং বিচে অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলো এখনো সকলের জন্য উন্মুক্ত নয়, কেবল আমন্ত্রিতরাই সেখানে যোগদান করতে পারে, যা সমালোচকদের তাতিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
অবশ্য টেড কর্তৃপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনেরও যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। তাদের মতে, তারা এ কাজ করে কেবলই নিশ্চিত করতে যেন দর্শকসারিতে সব শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি থাকে। টিকিটের বিনিময়ে প্রবেশাধিকার বিতরণ করা হলে সকলের পক্ষে সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ সম্ভব হতো না, কেবল ধনীরাই অংশ নিতে পারত। তাছাড়া তাদের আরো একটি যুক্তি হলো, শেষ পর্যন্ত সব টেড টকই তো তারা ইন্টারনেটে বিনামূল্যে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।
টেডের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ তাদের আত্মপ্রশংসামূলক সম্মেলনগুলো নিয়ে। এছাড়া অনলাইনে ভাইরাল ভিডিওগুলোকেও তারা “বিশ্বকে বদলে দেয়া ধারণা” হিসেবে প্রচার করে থাকে। সমালোচকদের মতে, আসলে টেডের এসব ভিডিওর নাকি কোনো বড় ধরনের প্রভাবই নেই।
আসলেই কি টেডের কোনো প্রভাব রয়েছে?
টেডের বক্তাদের জীবন বা ক্যারিয়ারে অবশ্যই টেডের বিশাল প্রভাব রয়েছে। টেডের সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য বক্তারা কোনো অর্থ পান না বটে, কিন্তু যে সম্মান ও পরিচিতি তারা পান, তা তাদেরকে সাহায্য করে টেডের বাইরেও বড় ধরনের বিভিন্ন প্রস্তাব পেতে। যেমন লং বিচে অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলোর বাইরে ওঁত পেতে থাকেন ধনাঢ্য বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা বা লোকহিতৈষীর দল, যারা টেডের বক্তাদেরকে তাদের ধারণার বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রদান করতে প্রস্তুত থাকেন। টেডের বক্তৃতা জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর সৃষ্টিশীল মানুষদের সৃষ্টিকর্মের কাটতি বেড়ে যাওয়ারও বহু নজির রয়েছে।
আবার টেডে বক্তৃতা দেয়ার পর অনেক পরিচিত তারকার নতুন কোনো দিকও কিন্তু উদ্ভাসিত হয়। যেমন আমরা বলতে পারি শাহরুখ খানের কথা। অবশ্যই টেডে অংশ নেয়ার আগেও বিশ্বব্যাপী অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন তিনি, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার কোটি কোটি ভক্ত-অনুরাগীও রয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালে টেডে বক্তৃতা দেয়ার পরই যে অনেকে নতুন করে তার চরিত্রের আরো নানা উজ্জ্বল দিকের সাথে পরিচিত হতে পেরেছে, তার গুণমুগ্ধ ভক্তে পরিণত হয়েছে, সে কথাও অস্বীকার করা যাবে না।
তবে টেডের সবচেয়ে বড় ভূমিকা অবশ্যই ব্যক্তি পর্যায়ে, যেগুলো হয়তো পরিসংখ্যান দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়, টেডের ভিডিওগুলো দেখেই অনেক মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছে, বিভিন্ন নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করে তারা সমৃদ্ধ হচ্ছে, খুব সহজেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন এমন সব জিনিস তারা জেনে ফেলছে যেগুলো অন্য কোনোভাবে তাদের পক্ষে কোনোদিন জানাই হতো না।
মোদ্দা কথা, ইন্টারনেট দুনিয়ার অসংখ্য অপ্রয়োজনীয়, আবর্জনাসম, সস্তা-চটুল কনটেন্টের ভিড়ে, টেডের ভিডিওগুলো যেন জ্ঞানপিপাসু মানুষদের জন্য তাজা বাতাসের জোগান দিয়ে চলেছে। তাই টেড আসলেই গোটা বিশ্বকে বদলে দিক বা না দিক, অগণিত ব্যক্তিবিশেষের জীবনকে অবশ্যই বদলে দিচ্ছে, করে তুলছে আরো পরিপাটি ও পরিকল্পিত।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/