কোভিড – ১৯ পরিসংখ্যান
এই লেখাটি প্রস্তুতির সময় (২৪ মার্চ ২০২০ দুপুর ১২:২০) সারা বিশ্বে ৩,৮১,৭৬১ জন মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত এবং ১৬,৫৫৮ জন এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। প্রতিদিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানবসভ্যতার জন্য থেকে এর চেয়ে ভয়ংকর সংবাদ আর কী হতে পারে? ঠিক এরকম না হলেও কাছাকাছি একধরনের ভাইরাস পৃথিবী দেখেছিল ২০০২-০৩ সালে। সেই ভাইরাসের নাম ছিল সার্স (SARS – Severe Acute Respiratory Syndrome)।
কোভিড-১৯ এবং সার্স-এর তুলনা
সার্স প্রথম চীনে ছড়িয়ে পড়ে ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে। এর পরপরই চীনের বাইরেও ২৬ টি দেশে খুব জলদি এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৮ মাস মানুষকে উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে এ ভাইরাস প্রায় ৮,০০০ জনের মধ্যে প্রবেশ করে, যার ফলে ৭৭৪ জন মারা যায়। জুলাই ২০০৩ এর মধ্যে এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হয়। এই ভাইরাসের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল চীন, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং কানাডা (বিশেষ করে টরোন্টো)।
সার্সকে সামলানো গিয়েছিল কিছু কঠোর পদক্ষেপের কারণে; যেমন: তীক্ষ্ণ নজরদারি, আক্রান্তদের ত্বরিতগতিতে আলাদা করে নেওয়া, নিশ্ছিদ্র কোয়ারেন্টাইন-ব্যবস্থা এবং মানুষ থেকে মানুষে যেন না ছড়ায়- সেদিকে কঠোর ব্যবস্থা। শেষের পদক্ষেপটি সবচেয়ে জরুরি ছিল এবং এখানেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। সেসময় কোনো ভ্যাক্সিন বা নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল না বিধায় গতানুগতিক জনস্বাস্থ্যের মাপকাঠি দিয়ে বিষয়টি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
একই ধরনের ভাইরাস হলেও ২০১৯ এর করোনা ভাইরাস আরও ভয়ংকর রূপ নিয়ে এসেছে, যার ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি সাংঘাতিক বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমান পরিসংখ্যান হিসেব করে যদি দেখা যায়, তাহলে রোগীর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার হার থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে গেছে।
চীনের উহান থেকে সৃষ্ট এই ভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাওয়ার পর চীনের অবস্থা সবচেয়ে বেশি শোচনীয় ছিল। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে চীন মোটামুটি এই ভাইরাসের সংক্রমণ হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত তা বজায় আছে।
কিন্তু মার্চের শুরু থেকে হঠাৎ করেই চীনের বাইরের বিভিন্ন দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়া শুরু হয় এবং এখনও এই বৃদ্ধির হার অব্যাহত আছে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর অবস্থা বেশি শোচনীয়। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, মোট আক্রান্তের ৪০ শতাংশ এখন ইউরোপভুক্ত দেশগুলো।
গবেষকদের মতে, সার্স ও করোনা- এই দুই ভাইরাসেরই আবির্ভাব ঘটে বাদুড় থেকে। এরপর তা মানুষে ছড়িয়ে পড়ে এবং দুটো ভাইরাসের ডিএনএ-তে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মিল পাওয়া গেছে।
কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো সার্স ২০০৩ এর সময়?
দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস নামক জার্নালে প্রকাশিত ‘ক্যান উই কন্টেইন দ্য কোভিড-১৯ আউটব্রেক উইথ দ্য সেম মেজারস অ্যাজ ফর সার্স?‘ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বিস্তারিতভাবে সার্স ২০০৩ এর সময়কার বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপমূলক কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়, যা সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে দেওয়া হলো-
১) আইসোলেশন বা অন্তরণ ছিল প্রথম পদক্ষেপ। ৬-১১ দিনের মধ্যে বা এর আগেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে উপাত্ত-পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে, ৪ দিনের মধ্যে রোগীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। যতদিন পর্যন্ত সার্সের প্রাদুর্ভাব দূর না হয়েছে, ততদিন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীকে বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
২) কোয়ারেন্টাইন বা সঙ্গনিরোধ ছিল আরেকটি পদক্ষেপ। কিন্তু এ পদ্ধতির কিছু কিছু পদক্ষেপ ছিল অনুকরণীয়। যাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল, তাদের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। যারা বাসায় ছিল, তাদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে নিয়মিত খোঁজ নেয়া হচ্ছিল।
চীন এবং হংকং– দুটো দেশেই পুলিশ চেক বসানো হয়েছিল এবং যাদের এই ভাইরাস আক্রমণ করেছিল বা যাদের সংক্রমিত হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা ছিল, তাদের বাসার সামনে ভিডিও ক্যামেরা বসানো হয়েছিল পর্যবেক্ষণের জন্য। চীন সরকার বেইজিংকে পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল এবং প্রায় ৩,৫০০টি জায়গা, যেখানে সচরাচর জনগণের ভিড় হয়ে থাকে, সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
৩) সিঙ্গাপুরের পদক্ষেপ ছিল প্রশংসনীয়। সেখানকার প্রতিটি স্কুলে তাপমাত্রা মনিটর করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকটি পাবলিক ভবনে তাপমাত্রা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একশোটির বেশি ‘ফিভার (জ্বর) ক্লিনিক’ বসানো হয়েছিল। মিডিয়া থেকে বারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উৎসাহ দেওয়া হচ্ছিল সাধারণ জনগণকে।
৪) আক্রান্ত প্রতিটি দেশের সার্স নির্মূল করার শক্ত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল।
৫) হাসপাতালগুলোতে দক্ষ নার্সিং ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আক্রান্তদের জন্য পুরোপুরি আলাদা রুম, চিকিৎসক এবং নার্সদের জন্য পিপিই বা পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টের ব্যবস্থা, হাসপাতালের কর্মী এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাক্ষাৎ শিথিলকরণ ইত্যাদি ছিল খুবই মৌলিক ব্যবস্থা।
ইনফেকশন কন্ট্রোল রুম তৈরি করা হয়েছিল। আক্রান্ত রোগীর সাথে সাক্ষাতের সময় বা চিকিৎসার সময় গ্লভস, গাউন, আই প্রটেকশন এবং এন-৯৫ মাস্ক পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। সেসময় হাসপাতালে রোগী পরিদর্শক বা ভিজিটরদের আসা-যাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
৬) হাসপাতাল কর্মীদের ওপরও নজরদারি রাখা হয়েছিল। সিঙ্গাপুরে হাসপাতাল কর্মীদের তাপমাত্রা দিনে দু’বার করে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল।
তবে কিছু কিছু পদক্ষেপ আছে, যা ২০০২ সার্সের সময় নেওয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু এবারের মহামারীর সময়ে নেওয়া গেছে। যেমন- ২০০২ সালের এই ভাইরাস আক্রমণের পর সচেতন হতে চীন বেশি সময় নিয়ে ফেলেছিল।
২০০২ এর শেষের দিকে সার্সের আবির্ভাব ঘটলেও পদক্ষেপ নিতে ২০০৩ চলে আসে এবং এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল চীনা এক সেনা-চিকিৎসকের কারণে। যদিও এই বিলম্বের কারণে পরবর্তীকালে চীন সরকার থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা করা হয়।
কিন্তু ২০১৯ সালের করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত করার পর চীনের বিজ্ঞানী এবং ডাক্তাররা খুব দ্রুত এই ভাইরাসের জেনেটিক ইনফরমেশন বের করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দিয়ে দিয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যেই। তার ঠিক দশদিন পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সেই তথ্য জিন ব্যাংকে দেওয়া হয়। এই জিন ব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক তথ্যভাণ্ডার, যা গবেষণার কাজে উন্মুক্ত। বিভিন্ন গবেষণার পর বোঝা যায় যে, এই ভাইরাস আসলে সার্সের মতোই এবং কোনো পশু থেকে বিস্তার লাভ করেছে।
ভ্যাক্সিন তৈরির পদক্ষেপ
করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন বা টিকা কবে নাগাদ তৈরি হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। টিকা তৈরির কাজ অনেক সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য অনেকগুলো ট্রায়ালের প্রয়োজন। কমপক্ষে এক বছর তো লাগবেই!
তবে অনেক কোম্পানি চেষ্টা করছে সার্স-এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবং এই করোনা ভাইরাসের জেনেটিক কোড সম্পর্কে জেনে টিকা তৈরি করতে। ২০০৩ এর তুলনায় এখন জিন সিকোয়েন্সিংয়ের দক্ষ পদ্ধতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস এর মডেরনা (Moderna Inc.) নামক এক বায়োটেকনোলোজি কোম্পানি টিকা তৈরি করার দাবি করেছে এবং উপযুক্ত অনুমতি নেওয়ার পর সিয়াটলেই এই টিকা পরীক্ষা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরকম আরও অনেক প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানি যত দ্রুত সম্ভব টিকা তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছে।
ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, সার্সের মতো হলেও বিস্তারের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ অনেক বেশি শক্তিশালী। খুব দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে যে কোনো দেশেই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই অন্যান্য দেশের শোচনীয় অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ প্রথম থেকেই যদি ঠিক ঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে খুব দ্রুত এই ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যেতে পারে।
সার্স-এর সময়কার শিক্ষা নিয়ে এবার তাইওয়ান, হংকং এবং সিঙ্গাপুর তুলনামূলক ভালো প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। চীনের তুলনায় এই দেশগুলোতে ভাইরাসের বিস্তার হার অনেক কম। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত ৩৩ জন (২৪ মার্চ ২০২০ দুপুর ১২:২০) আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। এখন থেকে যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং দেশের প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে সচেতন থাকে, তাহলে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দূর করা সম্ভব।