১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের মধ্য দিয়ে ‘ক্রিকেট’ বাংলাদেশের আনন্দ-বেদনার অংশ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ক্রিকেট আসন পেতে বসেছে বাঙালির অন্তরে। খেলাটা এখন এই ব-দ্বীপের জনতার অস্থিমজ্জায়, মস্তিষ্কের কোটরে, শিরা-ধমনীতে বসতি গড়েছে।
২২ গজে টাইগারদের সাফল্যই এর মূলে। আবার যুগের তালে প্রযুক্তির প্রসারও কম-বেশি ভূমিকা রেখেছে এই প্রসিদ্ধিলাভে। এই ক্রিকেট খেলেই মাশরাফি বিন মর্তুজা গোটা দেশে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছেন। সাকিব আল হাসানরা যশ-খ্যাতি, প্রতিপত্তি পেয়েছেন। গোটা দেশকে এক সুতোয় গেঁথে নিখাদ আনন্দের বেলায় ভাসানোর আশ্চর্য ক্ষমতা এখন ক্রিকেটের হাতে।
শুধু বিনোদনের খোরাক নয়, ক্রিকেট এখন পেশা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যে, পরিবার মনে করতো ছেলেটা ক্রিকেট খেলছে মানে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষের নেতিবাচক ভাবনার কপাট খুলে গেছে। হালের বাংলাদেশে অনেক পিতা-মাতাই স্বপ্ন দেখেন, তার সন্তান ক্রিকেটার হবে। কোটি জনতার গুণমুগ্ধ তারকা হবে। সাকিব-তামিম-মুস্তাফিজদের মতো ক্রিকেট মাঠে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়বে। তার সন্তানের হাত ধরে দেশের বিজয় নিশান উড়াবে ক্রিকেট দুনিয়ার অলিতে-গলিতে।
প্রথমবারের মতো আইসিসি যুব বিশ্বকাপ জিতে দেশের ক্রিকেট জোয়ারকে কয়েকগুণ বেগবান করেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। গত ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে আকবর আলীর নেতৃত্বে ভারতকে হারিয়ে বিশ্বজয় করে বাংলাদেশ যুব দল। শিরোপার বিচারে দেশের ইতিহাসে এটিই হয়তো সবচেয়ে বড় অর্জন।
যুবাদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব ক্রিকেটের প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। নিজের সন্তানকে ক্রিকেটার বানানোর আগ্রহী মানুষেরও অভাব নেই দেশজুড়ে। অপ্রিয় হলেও সত্যি, সন্তানকে ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার সঠিক পদ্ধতির সন্ধান না পেয়ে এখনও অনেকে হাপিত্যেশ করেন।
জাতীয় ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) খেলোয়াড় তৈরির একটা প্রথাগত উপায় হিসেবে পরিগণিত হয় সবসময়। কিন্তু সেখানে আসন সংখ্যার সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে সিংহভাগেরই সুযোগ হয় না। যদিও এবার বিশ্বকাপজয়ী যুব দলে ৮ ক্রিকেটারই এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র।
দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) আপামর জনতার জন্য ক্রিকেট প্রতিভা বিকাশের দুয়ার খুলে রেখেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সর্বস্তরের মানুষ সেখানে শামিল হতে পারে।
আজকের আয়োজনে আমরা জানাবো, অমিত প্রতিভাধর-উৎসুক ক্রিকেট বিদ্যার্থীদের ক্রিকেটার হওয়ার জন্য বিসিবির বিদ্যমান প্রক্রিয়াগুলোর আদ্যোপান্ত। যেভাবে বয়সভিত্তিক দলগুলোর জন্য ক্রিকেটার বাছাই করে থাকে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগ, তৃণমূল থেকে তুলে আনে আকবর আলী-শরীফুলদের মতো প্রতিভাবানদের, এবং কীভাবে তাদের পরিচর্যা করে। বলা বাহুল্য, যুবাদের বিশ্ব জয়ে প্রংশসিত হয়েছে বিসিবির এই বিভাগের কার্যক্রম, এবং ক্রিকেটারদের পরিচর্যায় বিসিবির এই বিভাগের পরিকল্পনার সাফল্য এখন পরীক্ষিত।
বয়সভিত্তিক পর্যায়ে প্রতিভা অন্বেষণের কয়েকটি প্রক্রিয়া রয়েছে বিসিবির। যার মধ্যে প্রধান দু’টি উপায় হচ্ছে জাতীয় স্কুল ও বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা। এছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একাডেমির হাত ধরেও আপামর জনতা যুক্ত হতে পারে বিসিবির প্রতিভা বাছাইয়ের মহাযজ্ঞে। এরপর হাতেখড়ির পর্যায় থেকে পেশাদারিত্বের আঙ্গিনায় আনার কাজটাও নিয়ন্ত্রণ করে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগ।
এই বিভাগের ম্যানেজার আবু ইমাম মোহাম্মদ কাউসার ধাপে ধাপে সবিস্তারে জানিয়েছেন বিসিবির এসব প্রক্রিয়ার কথা।
জাতীয় স্কুল ক্রিকেট
দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট জাতীয় স্কুল ক্রিকেট। এই সম্পর্কে গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ম্যানেজার বলেছেন,
‘স্কুল ক্রিকেট সারা দেশেই হয়। প্রায় ৫৪০-৫৪২টা স্কুল খেলে। স্কুল ক্রিকেটে প্রতিটি জেলাতেই একটা প্রতিযোগিতা হয়, ৪ থেকে ৮টা স্কুল খেলে। ওখান থেকে জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়। চ্যাম্পিয়ন স্কুলটা বিভাগীয় পর্যায়ে চলে যায়। আমি যদি চট্টগ্রাম বিভাগের কথা বলি, ওখানে ১১টি জেলা। ১১টা জেলা থেকে জেলা চ্যাম্পিয়ন দল আসে। তারপর আমরা একটা নকআউট টুর্নামেন্ট করি। দেখা যাচ্ছে, কাছাকাছি যেসব জেলা আছে, যেমন কুমিল্লা হয়তো চাঁদপুরের সঙ্গে নকআউট খেলে, লক্ষ্মীপুর হয়তো নোয়াখালীর সঙ্গে নকআউট খেলে। এভাবে আকারটা ছোট হতে থাকে। পরে চারটা টিম নিয়ে সেমিফাইনাল হয়। এবং ফাইনালের মাধ্যমে একটা বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দল বের হয়ে আসে।’
স্কুল ক্রিকেটের পরবর্তী ধাপ নিয়ে বিসিবির এই কর্মকর্তা বলেছেন,
‘প্রতিটি বিভাগ থেকে একটা করে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দল আসে। ঢাকা থেকে দুটো দল আসে। ৭-৮ দলের অংশগ্রহণে জাতীয় পর্যায়ে স্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতা করি। তারপরই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দল বের হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেও একটা পর্যবেক্ষণ থাকে প্রতিভা বাছাইয়ের। দেখা যাচ্ছে, কোনো স্কুল চ্যাম্পিয়ন নয়, কিন্তু ওই দলে প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে। ওইসব প্রতিভা খুঁজে বের করে আমাদের জেলা কোচরা। পরে তারা যখন নির্দিষ্ট জেলা দলগুলো গঠন করে, তখন স্কুল ক্রিকেটের প্রতিভাবানদেরও সুযোগ দেয়া হয়।’
বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা
বিসিবির বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা প্রতিটি জেলাতেই অনুষ্ঠিত হয়। অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮ তিনটি দল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পরে বিভাগীয় প্রতিযোগিতা হয়। জেলাগুলোর অংশগ্রহণে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দল তৈরি হয়।
বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিভা বাছাইয়ের ধরন নিয়ে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ম্যানেজার বলেছেন,
‘ধরেন, প্রতিটি বিভাগেই অনূর্ধ্ব-১৪ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। জেলাগুলো একটা আরেকটার সাথে খেলছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের কাজ হচ্ছে, চ্যাম্পিয়ন নয়, প্রতিভাবান ছেলেগুলোকে দেখা। ওই ছেলেগুলোকে দেখে বিভাগীয় কোচের মাধ্যমে একটা প্রাথমিক তালিকা তৈরি হয়। যেমন, চট্টগ্রামে ১১ জেলার বাছাইকৃত ছেলেদের ডাকা হয়। ধরা যাক, ৫০ জন ডাক পেয়েছে। তারপর একটা বাছাই ক্যাম্প হয় চারদিনের। ওই ক্যাম্পের পর দলটাকে ১৭-১৮ জনে নামিয়ে আনা হয়। এদের নিয়ে আবার ১০ দিনের একটা স্কিল ক্যাম্প হয়। এটা প্রতিটি বিভাগেই হয়। প্রত্যেক বিভাগ স্কিল ক্যাম্পের পরই তাদের দল গঠন করে এবং বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।’
বিভাগীয় প্রতিযোগিতা থেকে তৈরি হয় ন্যাশনাল পুল, যা ওইসব প্রতিভাবানদের পাইয়ে দেয় বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের ঠিকানা। এই সময়ের প্রক্রিয়া নিয়ে আবু ইমাম মোহাম্মদ কাউসার বলেন,
‘বিভাগীয় পর্যায়ে আমাদের ১০টা দল হয়। বিভাগ সাতটা হলেও ঢাকায় উত্তর, দক্ষিণ এবং মেট্রো এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়; ঢাকা দক্ষিণ মানে ফরিদপুর অঞ্চল, ঢাকা উত্তর মানে ময়মনসিংহ অঞ্চল, আর ঢাকা মেট্রো। ১০ দলের দুই গ্রুপে ভাগ করে প্রতিযোগিতা হয় তিনটি বয়সভিত্তিক (অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮) দলেই। পার্থক্য হলো, অনূর্ধ্ব-১৪ কিংবা অনূর্ধ্ব-১৬তে আমরা দুই দিনের ম্যাচ খেলি। অনূর্ধ্ব-১৮তে তিনদিনের ম্যাচ খেলি। দুই গ্রুপের সেরা দুই দল সেমিফাইনাল খেলে। পরে ফাইনালের মাধ্যমে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দল আসে।’
বয়সভিত্তিক এই প্রতিযোগিতার পর নির্বাচক ও অভিজ্ঞ কোচরা মিলে ৪২ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করেন। এদের তিন দলে ভাগ করে একটা চ্যালেঞ্জ সিরিজ আয়োজন করা হয়। সিরিজের পর স্কোয়াড ২৪ জনে নামিয়ে আনা হয়। এদেরকে তিন সপ্তাহের ক্যাম্পে পাঠানো হয়। দু-চারজন বাদ পড়ে ক্যাম্প থেকে। এরপর তিনটি বয়সভিত্তিক দলকে আন্তর্জাতিক সিরিজ, যেমন শ্রীলঙ্কায়, কলকাতায়, মুম্বাইয়ে, কেরালার দলগুলোর সঙ্গে খেলানো হয়।
বিসিবির এই কর্মকর্তা আরও বলেন,
‘অনূর্ধ্ব-১৪ ক্যাম্প থেকে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৫ দল, অনূর্ধ্ব-১৬ ক্যাম্প থেকে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৮ ক্যাম্প থেকে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দল গঠন করা হয়। তিনটা গ্রুপ থেকে তিনটা জাতীয় দল হয়। কারণ, ততদিনে ওদের বয়সটাও একটু বাড়ে।’
উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়া সারা দেশেই অবলম্বন করা হয়। রাজধানী ঢাকার অভ্যন্তরে অবশ্য বিসিবি বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমির নির্ভর করে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। ঢাকার তিনটি বয়সভিত্তিক দলে সাধারণত আসে একাডেমিগুলোর ক্রিকেটাররা। রাজধানীতে অনেক একাডেমি থাকলেও বিসিবির তালিকাভুক্ত আছে প্রায় ৬০টি।
একাডেমি থেকে ক্রিকেটার বাছাইয়ের প্রক্রিয়া জানাতে গিয়ে গেম ডেভেলপমেন্ট কমিটির এই ম্যানেজার বলেন,
‘ঢাকায় আমরা জোনে জোনে ভাগ করি। ধানমণ্ডিতে একটা জোন করি, ওই এলাকার একাডেমিগুলোকে আমরা দু’দিন সময় দেই। তারা তাদের নির্বাচিত ৫ থেকে ১০ জন খেলোয়াড় নিয়ে আসে। তখন তাদেরকে আমরা নেটে বোলিং-ব্যাটিং করাই। এসময় আমাদের কোচিং স্টাফরা থাকে, একটা বাছাইয়ের মতো হয়। ওই বাছাই শেষে তারা একটা স্কোয়াড করে। তারপর আমরা চারদিনের ক্যাম্প করি। পরে আবার ১০ দিনের স্কিল ক্যাম্প। এটা শেষ হলে এরা বিভাগীয় দলে চলে যায়।’
ক্রিকেট একাডেমিগুলোর বিসিবির তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য ন্যূনতম কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন, অন্তত একাডেমির একটা প্র্যাকটিসের জায়গা থাকতে হবে, সেটা ভাড়া হলেও সমস্যা নেই। প্র্যাকটিসের বাকি সুবিধাদিও থাকতে হবে। কোচিং স্টাফ পর্যাপ্ত ও মানসম্মত থাকতে হবে। তাছাড়া একাডেমির ম্যানেজমেন্টে কারা কারা আছে, এটাও দেখা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কি না, দেখার বিষয় সেটাও।
এভাবেই আগামীর তারকাদের সন্ধান পায় বাংলাদেশের ক্রিকেট। বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের হাত ধরে ধাপে ধাপে বিকশিত হয় দেশের প্রতিভাধর ক্রিকেটাররা।