দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে। ইউরোপের অবস্থা করুণ; অর্থনীতি তলানিতে, অবকাঠামো বিধ্বস্ত। তদুপরি যুদ্ধে হেরে যাওয়া দেশগুলোর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে বিপুল অংকের দেনা। এই ভঙ্গুর অর্থনীতি দিয়ে তারা নিজেদের দেশকে নতুন করে সাজাবে নাকি দেনা পরিশোধ করবে? এরকম একটা অবস্থায় বিশ্বনেতাদের মনে হলো, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ভবিষ্যতে এভাবে আর হুমকির মুখে ফেলা যায় না। কারণ অর্থনৈতিক প্রভাব অনেকটা বাটারফ্লাই ইফেক্টের মতো, পৃথিবীর এক প্রান্তের অর্থনীতিতে কোনো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে তার রেশ গ্রহের বিপরীত প্রান্তের সুদূরে অবস্থিত দেশটিতেও লাগবে।
বিশ্ব অর্থনীতির এই টানাপোড়েনের লাগাম ধরতে ৪৫টি দেশের নেতৃবৃন্দ ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস নামক স্থানে জড়ো হন। লক্ষ্য এমন কিছু বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যেগুলোর কাজ হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল নিয়ে কাজ করা। একটি বৈশ্বিক, সর্বজনীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা এবং প্রয়োজনে অর্থনৈতিক সংকটে একে অপরকে সাহায্য করা। সেই ব্রেটন উডস সম্মেলনে জন্ম হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংকসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেগুলো সম্মিলিতভাবে ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশনস নামে পরিচিত।
আইএমএফ কেন গঠন করা হলো?
আজকের আইএমএফ যেখানে বৈশ্বিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে, জন্মলগ্নে তার উদ্দেশ্য কিন্তু এমনটা ছিল না। বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দ চেয়েছিলেন, বিভিন্ন দেশের মধ্যকার যেসব সংঘাত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা যুদ্ধ ডেকে আনে সেগুলো নিরসনে কাজ করবে আইএমএফ। পাশাপাশি তারা চেয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম থাকুক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, অর্থাৎ ১৯১৮ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সময়টুকু ইন্টার-ওয়ার পিরিয়ড নামে পরিচিত। এ সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল ছিল অস্থিতিশীল; উচ্চমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি, বৈশ্বিক বাণিজ্যে সীমাবদ্ধতা, বিদেশি শেয়ারবাজারে ফটকাবাজি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক রিজার্ভে উত্থানপতন, সোনার সঙ্কট, মুদ্রামান কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক অর্থনীতি। এ সমস্যা সমাধানে একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তথা আইএমএফ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। আইএমএফ-এর প্রতিষ্ঠাতারা স্বর্ণ বিনিময়কে আদর্শ মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেন যা গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড নামে পরিচিত (gold exchange standard)।
গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড
গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো দেশের মুদ্রাব্যবস্থার (কয়েন, ও কাগজের নোট) মান স্বর্ণের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে মুদ্রাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণের সমান হিসেবে মাপা হয়। আইএমএফ-এর গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ডে প্রতিটি দেশ তাদের মুদ্রার মান ডলারের সাপেক্ষে নির্ধারণ করত। আর ডলারের মূল্যমান ছিল সরাসরি স্বর্ণের সাথে সংযুক্ত। তখন এক আউন্স স্বর্ণের দাম ধরা হয়েছিল ৩৫ ডলার। আইএমএফ-এর সদস্য দেশগুলো ডলার ও স্বর্ণের রিজার্ভ সংরক্ষণ করত এবং তারা মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ সংগ্রহ করতে পারত।
তবে বর্তমান সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড অপ্রচলিত। তার বদলে ফিয়াট মানি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যেখানে মুদ্রামান কোনো দৃশ্যমান ভোগদ্রব্যের সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হয় না বরং স্বয়ং সরকার এর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। ডলার, ইউরো সহ বিশ্বের বেশিরভাগ মুদ্রা এখন ফিয়াট কারেন্সি হিসেবে বিবেচিত হয়।
একটি ব্যর্থ পদ্ধতি
গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী একটি দেশকে তার দেশের প্রতি একক মুদ্রার জন্য একটি স্বর্ণমান নির্ধারণ করতে হতো। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্বর্ণের রিজার্ভ রাখতে হতো। এই পদ্ধতির ব্যতিক্রম ঘটলে দেশের রিজার্ভে থাকা স্বর্ণের পরিমাণ কমে যেত। এক দেশের রিজার্ভড স্বর্ণ আরেক দেশের হাতে চলে যেত। ফলে যে দেশ স্বর্ণ হারাত তাদের মুদ্রামান কমে যেত আর হারানো স্বর্ণ যে দেশে প্রবেশ করত সে দেশের মুদ্রামান বেড়ে যেত। এ সমস্যা তৈরি হওয়ার নানা কারণ ছিল, যেমন, একটি দেশ যদি রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করত কিন্তু আমদানি ব্যয় নিজের অর্থনীতি দিয়ে বহন করতে না পারত, তাহলে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণের রিজার্ভ হারাতে শুরু করত। তত্ত্বীয়ভাবে, গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার কথা থাকলেও বাস্তবে এ পদ্ধতিটি পরবর্তীসময়ে একটি ব্যর্থ পদ্ধতি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। কারণ দেখা যায়, যেসব নিয়মকানুন ঠিক করা হয়েছিল তা বহু দেশই মানেনি। বরং অনেকক্ষেত্রেই তারা নিয়মগুলো লঙ্ঘন করেছিল।
আইএমএফের উদ্দেশ্য
১৮৯টি দেশ বর্তমানে আইএমএফ-এর সদস্য। বৈশ্বিক এই অর্থনৈতিক মোড়ল সংস্থাটি বিভিন্ন দেশকে ঋণ প্রদানের বাইরেও বেশ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। সংক্ষিপ্ত আকারে আইএমএফ-এর উদ্দেশ্য সমূহ-
আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতা: এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে আর্থিক সহায়তাকাঠামো গড়ে তোলা। অর্থ, পরামর্শ, মেধাশক্তি ইত্যাদি সরবরাহ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধান করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে আর্থিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল সংস্থাটি।
বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা: সদস্য দেশগুলোর মুদ্রামান নির্ধারণ, বৈদেশিক মুদ্রার পারস্পরিক মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি নিশ্চিত করার জন্য সুশৃঙ্খল বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যিক বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধি সাধনও সংস্থাটির আরেকটি মৌলিক উদ্দেশ্য। এ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থার প্রয়োজনীয় বৃদ্ধি ও উন্নয়নের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো যেন উচ্চমাত্রায় আয় করতে পারে ও বেকারত্ব দূর করতে পারে তা নিয়ে কাজ করে আইএমএফ।
বিনিময় ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ দূরীকরণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অনেক দেশই নিজেদের ইচ্ছেমতো আন্তর্জাতিক বিনিময় ব্যবস্থা ও মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণ করত। আইএমএফের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে এ ধরনের দেশভিত্তিক আলাদা-আলাদা বিনিময়হার দূরীভূত করা বা সহজ করা যাতে অবাধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়।
বহুমুখী বাণিজ্য: আগের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার স্থলে বহুমুখী বাণিজ্য ব্যবস্থার বিকাশ নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি।
ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধি: সদস্য দেশগুলো বিশেষত অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন পরিকল্পনায় সাহায্য করে সংস্থাটি।
পুঁজির বিনিয়োগ: আইএমএফ উন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে।
জরুরি সাহায্য: সদস্য কোনো দেশ যদি সাময়িক অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাহলে সংস্থার জরুরি তহবিল থেকে ওই দেশকে সাহায্য করে আইএমএফ।
সদস্যপদ
আইএমএফ-এর দুই ধরনের সদস্য দেশ রয়েছে। মূল সদস্য (Original Members), ব্রেটন উডস সম্মেলনে যেসব দেশ অংশগ্রহণ করেছিল, এবং ১৯৪৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যেসব দেশ সদস্য হতে রাজি হয়েছিল, সেসব দেশ আইএমএফের মূল সদস্য। সাধারণ সদস্য (Ordinary Members), মূল সদস্য বাদে বাকি সদস্য দেশগুলো এই কাতারে পড়ে।
গঠন
বোর্ড অভ গভর্নরস (Board of Governors): আইএমএফ-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটি হচ্ছে এই বোর্ড অভ গভর্নরস। সদস্য দেশ থেকে সংস্থাটির গভর্নর বা মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। সাধারণত উক্ত ব্যক্তি ওই সদস্য দেশের অর্থমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হন। একইভাবে বাকি গভর্নরদেরকেও নিয়োগ দেওয়া হয়। বোর্ড মেম্বাররা বিভিন্ন বিষয়ে বাৎসরিক মিটিংয়ে একত্রিত হন।
আইএমএফ-এর দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করেন ২৪ জন নির্বাহী পরিচালকের আরেকটি বোর্ড। এদের মধ্যে আট জন পরিচালক চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিযুক্ত হন। বাকি ১৬ জন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
কার্যনির্বাহী পরিষদ (Ministerial committees): বোর্ড অভ গভর্নরসকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য দ্য ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল কমিটি (আইএমএফসি), ও দ্য ডেভেলপমেন্ট কমিটি নামে দুটি কার্যনির্বাহী পরিষদ রয়েছে। ২৪ জন সদস্যবিশিষ্ট আইএমএফসি বছরে দুবার একত্রিত হয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ নিয়ে আলোচনা করে। এই কমিটি আইএমএফকে এর কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে পরামর্শ দান করে। প্রতি মিটিং শেষে এটি মিটিংয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্তসার নিয়ে একটি যৌথ প্রজ্ঞাপন জারি করে থাকে। এই প্রজ্ঞাপনে পরবর্তী ছয় মাসের কর্মপরিকল্পনার কথা উল্লেখ থাকে।
বাংলাদেশে আইএমএফ
রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিরাষ্ট্রীয়করণ: বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে। তবে তার সাথে কিছু শর্তও জুড়ে দেয় সংস্থাটি। এগুলোর মধ্যে একটি শর্ত হলো, রাষ্ট্রের মালিকানাধীন শিল্প, সেবামূলক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান, ও ব্যাংকসমূহের ব্যক্তিগতকরণ অথবা বন্ধ করে দেওয়া। উদারবাদী অর্থনীতির একটি অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ সমূহকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করা। সেজন্য স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক রাষ্ট্র নিজের অধীনে আনলেও পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে এসব ব্যাংকের অনেকগুলোকে (প্রায় দুইটি) ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ে যাওয়া হয়, এবং পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন বেসরকারি ব্যাংক (Private Commercial Bank) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এবং শর্ত মোতাবেক সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয়।
সংকোচনমূলক মুদ্রাব্যবস্থার সূচনা: আইএমএফ-এর পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রাব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ভ্যাট ও সস্পূরক শুল্ক সংস্কার: ২০১৬ সালে আইএমএফ ঋণ প্রদানের জন্য দেশের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক সংস্কারের শর্ত জুড়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে, সে বছর বাংলাদেশ সরকার ভ্যাট ও সস্পূরক শুল্ক আইন প্রণয়ন করে।
বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের জন্য আইএমএফ-এর অন্যান্য শর্ত হলো, ব্যবসায়-বাণিজ্যে মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করা, ব্যক্তি উদ্যোগের ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন আরও শিথিল করা, এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে করের হার কমানো। এছাড়া, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ভর্তুকি কমানো, সরকারি ব্যাংকগুলোর বেসরকারিকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আইএমএফ-এর শর্ত কাজ করে।
বিশ্বব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপ
বিশ্বব্যাংক বলতে কিন্তু শুধু একটি ব্যাংককে বোঝায় না বরং কতগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাংক বা বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী নামে পরিচিত। এগুলো হলো:
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি): এ সংস্থাটি মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রসমূহকে ঋণ প্রদান করে থাকে। তবে কখনো কখনো রাষ্ট্র ছাড়াও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাকেও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ প্রদান করে।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ): ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আইডিএ। প্রয়োজনে অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহকে সুদমুক্ত বা স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে সংস্থাটি। কারণ এসব দেশ আইবিআরডি’র উচ্চ সুদবিশিষ্ট ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা রাখে না। দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা করলেও আইডিএ’র পুঁজির উৎস হলো বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের প্রদত্ত অনুদান।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি): বিশ্বের বৃহত্তম এ উন্নয়ন সংস্থাটি বেসরকারি খাত নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করে। আর্থিক বিনিয়োগ, পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ, ব্যবসায় বা সরকারকে পরামর্শদান ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে এ সংস্থাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে সাহায্য করে।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটলমেন্ট অভ ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (আইসিএসআইডি): বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিনিয়োগের আইনি সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করে এ সংস্থাটি।
দ্য মাল্টিল্যাটেরাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (এমআইজিএ/মিগা): ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো উন্নয়নশীল দেশসমূহে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করে ওই দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্যের হার হ্রাসকরণ, এবং জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদি নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে মিগা বিনিয়োগকারীদের পলিটিক্যাল রিস্ক ইন্স্যুরেন্স বা গ্যারান্টি প্রদান করে।
আইবিআরডি আর আইডিএ- মূলত এ দুটো প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বিশ্বব্যাংক গঠিত। বাকি তিনটি সংস্থা বিশ্বব্যাংকের অঙ্গ হলেও এগুলো আইনগত, ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন। মোট এ পাঁচটি সংগঠন একত্রে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী নামে (World Bank Group) পরিচিত।
বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য
১৮৯ সদস্য রাষ্ট্রবিশিষ্ট বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য হলো ধনী ও দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা। আর তার জন্য বিশ্বব্যাংকের চেষ্টা থাকে ধনী রাষ্ট্রের সম্পদকে দরিদ্র রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধিতে রূপান্তর করা। সংস্থাটির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো, টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন। এ লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বব্যাংক বেশকিছু ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে। যেমন:
- প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে দারিদ্র্য দূরীকরণ, বিশেষত আফ্রিকান অঞ্চলের দেশসমূহে।
- দারিদ্র্যের সবচেয়ে বড় কারণ, যুদ্ধ। তাই সদ্য যুদ্ধ থেকে মুক্তি লাভ করা দেশসমূহকে পুনর্গঠনে সাহায্য করে বিশ্বব্যাংক।
- মধ্যম আয়ের দেশসমূহকে দারিদ্র্যমুক্ত থাকার পথ দেখানো।
- জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে রাষ্ট্রসমূহকে সাহায্য করা।
- এইডস থেকে মুক্তি।
- মুক্তবাণিজ্য সম্প্রসারণ।
- স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান করা; সুদমুক্ত ধার দেওয়া; অনুদান প্রদান; শিক্ষা, অবকাঠামো ইত্যাদির উন্নয়ন; রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, কৃষি ইত্যাদি খাতের আধুনিকায়ন; প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজও করে থাকে বিশ্বব্যাংক।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য
দুটো প্রতিষ্ঠানের নাম বা ধরন দেখে কাছাকাছি মনে হলেও আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যথেষ্ট মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংক মূলত একটি উন্নয়ন সংস্থা। অন্যদিকে আইএমএফ একটি সমবায়মূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেটি মূলত বিভিন্ন দেশসমূহের দেনাপাওনার আন্তর্জাতিক হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করে। বিশ্বব্যাংকের সদস্য হতে হলে কোনো দেশকে আগে আইএমএফ-এর সদস্য হতে হয়। তবে দুটোরই উদ্দেশ্য ভিন্ন, গঠন আলাদা, আর পুঁজির উৎসও ভিন্ন ভিন্ন। দুটো সংস্থাই তাদের লক্ষ্যসমূহ অর্জনে নিজ নিজ পন্থায় কাজ করে থাকে।
আকৃতিতে আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের চেয়ে ক্ষুদ্র। আবার বিশ্বব্যাংকের মতো এর কোনো অধীনস্থ শাখা বা অন্তর্ভুক্ত সংগঠন নেই। আইএমএফের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা দুই থেকে আড়াই হাজার হলেও বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর অধীনে প্রায় ৭০০০-এর মতো কর্মী কাজ করে। এসব কর্মীদের কাজের ধরন, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতেও দুটি সংস্থার যোজন যোজন পার্থক্য রয়েছে।