সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, সভ্যতার অনেক উপাদানই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। শুধু টিকে আছে তাদের শিল্পকর্ম। এ শিল্পকর্মগুলো তাদের প্রয়োজনীয়তা, রুচি,ও সভ্যতার উচ্চমানের পরিচয় বহন করছে। আর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস ছিল শিল্পকলায় সমৃদ্ধ।
মিশরীয় ইতিহাস নিয়ে চর্চা করলে তাদের শিল্পকলা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা লাভ যায়। যদিও মিশরীয় সভ্যতার শিল্পকলা মূলত গড়ে উঠেছিলো ধর্মীয় বিশ্বাস আর রীতিনীতিকে কেন্দ্র করে। আধ্যাত্মিকতা ও বাস্তবতার সংমিশ্রণে মিশরীয় শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছিল। মিশরীয় ধর্মের মূলকথা ছিল, মৃতদেহকে সংরক্ষণ করে রেখে দিলে বহু বছর পরে মানুষ পুনরায় জীবন ফিরে পায়। তারা মনে করতো, মৃত্যু হচ্ছে সাময়িক সুপ্তিকাল আর আত্মা হলো অবিনশ্বর। এবং এ ধারণা থেকেই তারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আবাসস্থল হিসেবে পিরামিড তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। পিরামিড নির্মাণের বৈশিষ্ট্য স্থাপত্য বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক যুগের পথ অতিক্রম করে। স্থাপত্যশিল্পে দক্ষতার পাশাপাশি চিত্রকলা ও ভাস্কর্য শিল্পে তারা সমান পারদর্শী হয়ে উঠেছিল।
প্রাচীন মিশরে চিত্রকলা চর্চা
মিশরের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্র কায়েম ছিল। সময়ের ভিত্তিতে মিশরীয় রাজ্য শাসনকালকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়, পুরাতন রাজ্য (খ্রি:পূ: ২৬৮৬-২১৬০), মধ্যবর্তী রাজ্য (২০৫৫-১৬৫০ খ্রি:পূ:), এবং নবরাজ্য (১৫৫০-১০৬৯ খ্রি:পূ:)। ফারাও ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে গণ্য করা হতো। সবকিছুর উপর ছিল ফারাওয়ের একাধিপত্য। সুতরাং মিশরের স্থাপত্য, চিত্রচর্চা ও ভাস্কর্য নির্মাণ সব ফারাওয়ের ইচ্ছেমতো হতো। সেখানে শিল্পীদের নিজস্ব অভিমত বা তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা ছিলো না। পুরাতন রাজ্য ও মধ্যবর্তী রাজ্যের সময়কার চিত্রগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মিশরীয় শিল্পীরা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে বাস্তব জীবনকে উপস্থাপিত করেছিলেন। মিশরীয়রা তিন পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কন করতেন। যেমন- পাথরের বা দেয়ালের গায়ে খোদাই করে বা কেটে কেটে চিত্রাঙ্কন, যাকে আর্টের পরিভাষায় বলা হয় Petroglyph। দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিলো পাথর বা দেয়ালের গায়ে রং দিয়ে চিত্রাঙ্কন, যাকেPictograph বলা হয়। আর তৃতীয় পদ্ধতি ছিলো প্যাপিরাসের পাতায় চিত্রাঙ্কন।
মিশরীয় চিত্রকলায় কোনো মনমাতানো সৌন্দর্য, মাধুর্য লক্ষ্য করা যায় না, তবে এতে একধরনের পূর্ণতা ছিল। শিল্পীরা প্রকৃতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কেমন দেখায়, তা হুবহু আঁকার চেষ্টা করেননি, বরং প্রচলিত কঠোর নিয়ম অনুসারে তারা ছবি আঁকতেন। যেমন- তাদের বেশিরভাগ চিত্রে একটা বিষয় দেখা যাবে যে তাদের অঙ্কিত প্রতিকৃতিগুলোর মাথাটি একপাশ থেকে সহজেই ভালোভাবে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে একপাশ থেকে কখনোই তা এত স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব না। যদি আমরা প্রতিকৃতিগুলোর চোখ সম্পর্কে চিন্তা করি, তবে সামনে থেকে যেরূপ দেখা যায়, ঠিক অনুরূপভাবে প্রতিকৃতিগুলোর মুখমণ্ডলের একপাশে একটি সম্পূর্ণ চোখ আঁকা হয়েছে, অথচ বাস্তবে মানুষের চোখ একপাশ থেকে এমনভাবে দেখা সম্ভব নয়। আবার একপাশ থেকে শরীরের উপরের অংশ কাঁধ ও বুক ভালোভাবে দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে একপাশ থেকে কখনোই সম্পূর্ণভাবে দেখা সম্ভব নয়। নিচের চিত্রটির দিকে লক্ষ্য করলে তা বোঝা যাবে।
উপরের চিত্রটিতে দুটি প্রতিকৃতির একপাশের পট আঁকা হয়েছে, অথচ একপাশ থেকে তাদের যেভাবে আঁকা হয়েছে, তা বাস্তবতার সাথে মিল নেই। এমনকি তারা একপাশের পায়ের বৃৃদ্ধাঙ্গুল হতে শুরু করে উপরের দিক পর্যন্ত বহিঃরেখা এঁকে দিতেন। ফলে মনে হতো, মানুষের পা দুটি একসাথে আছে। মিশরীয় শিল্পীদের মতে, বাইরের দিক থেকে উভয় পা দেখানো অসুবিধাজনক, তাই তারা এমন করে আঁকতেন বলে মনে করা হয়।
উপরের ছবিটিতে ওসাইরিস আসনে বসে আছেন এবং বাইরের দিক থেকে তার উভয় পা দেখা যাচ্ছে না, কেননা ছবিটিতে দেবতা ওসাইরিসের একপাশের পায়ের বৃৃদ্ধাঙ্গুল হতে শুরু করে উপরের দিক পর্যন্ত বহির্রেখা দিয়ে আঁকা হয়েছে। তবে এসব চিত্র দেখে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে মিশরীয় শিল্পীরা মানুষ দেখতে এমন বলে ধারণা করতো বিধায় এভাবে ছবি আঁকা হতো! এ চিত্রগুলো থেকে তাদের চিত্র আকাঁর পদ্ধতি সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। এখানে একটা বিশেষ নিয়মের প্রতিফলন দেখা যায়। এ নিয়ম অনুযায়ী, তারা মানুষের দেহের প্রয়োজনীয় অংশগুলো একত্র ও সম্পূর্ণভাবে আঁকতেন। এর পেছনে ছিল তাদের পরজন্মের প্রতি গভীর বিশ্বাস।
অর্থাৎ তারা মনে করতেন যে, পরকালে মানুষ সম্পূর্ণ হাত, পা, চোখ নিয়ে হাজির হবে। তাই মানুষের হাত, পা, চোখ এসব কিছুই পূর্ণাঙ্গভাবে আঁকা প্রয়োজন। এ থেকে মনে করা হয়, মিশরীয় চিত্রকলার ভিত্তি ছিল শিল্পী কীভাবে অবলোকন করছে তার উপর নয়; বরং বস্তুটি বা দৃশ্যটি সম্পর্কে তিনি কী জানেন, তার উপর। এ সকল বস্তু বা প্রতিকৃতি সম্পর্কে তিনি যা বুঝেছিলেন এবং যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, অনুরূপভাবেই তিনি তা প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করেছিলেন। যার ফলে প্রাচীনকালের শিল্পীরা যেভাবে মূর্তি নির্মাণ করেছেন ও চিত্র এঁকেছেন, পরবর্তীকালেও সে ঐতিহ্য অনুসরণ করা হয়েছে। চিত্রে শুধু আকার এবং গঠনই যোগ করা হতো না, শিল্পীরা তার তাৎপর্যও যোগ করতেন; যেমন প্রভুকে তার স্ত্রী ও ভৃত্যদের চাইতে আকারে বড় করে আঁকা হতো।
রঙের ব্যবহার
রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তারা ধর্মীয়ভাবে সচেতন ছিলেন। কোথায় কোন রঙের ব্যবহার হবে, তা নির্দিষ্ট থাকতো। যেমন লাল রঙ ব্যবহৃত হতো ছেলেদের প্রতিকৃতিতে, বিশেষত ফারাওদের দেহের রঙে ব্যবহার হতো। লাল রঙ সূর্য, মন্দ ও শক্তির প্রতিনিধিত্ব করতো। সাদা ছিল পবিত্রতার রঙ। সাদা রঙ তারা চুন এবং সমপরিমাণ জিপসামের সাহায্যে তৈরি করতেন। কালো রঙ কাঠকয়লা থেকে তৈরি হতো। কালো রং পাতালপুরীর দেবতা ওসাইরিসকে বোঝাতে ব্যবহার করা হতো। মিশরে রৌপ্য খুব বিরল ছিল। এটি সোনার থেকেও মূল্যবান বলে ধরা হতো। এ থেকে যে রঙ তৈরি করা হতো, তা অত্যন্ত বিরল ছিল। তামা থেকে তৈরি করা হয়েছিল সবুজ রঙ। এই রঙ পুনর্জন্ম এবং উর্বরতা প্রতিনিধিত্ব করে বিধায় একে দেবী হাথোরের নিকট পবিত্র রঙ বলে ধরে নেওয়া হতো। নীল রঙটি স্বর্গ, গাছপালা, পানি, নীলনদকে প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহার করা হতো। কোয়ার্টজকে গরম করে, ম্যালাকাইট পিষে এবং ক্যালসিয়াম কার্বনেটের মিশ্রণে মিশিয়ে মিশরীয় নীল রঙ তৈরি করা হয়েছিল।
তবে এত বছর পরেও তাদের রঙের উজ্জ্বলতা ও স্থায়িত্ব দেখলে অবাক হতে হয়। দেয়ালচিত্রগুলোর ক্ষেত্রে অংশবিশেষ ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও এর বাকি অংশগুলোতে রঙের উজ্জ্বলতা এখনো দৃশ্যমান। এর পেছনের রহস্য হলো মিশরীয় শিল্পীরা রঙের চূর্ণের সাথে উদ্ভিজ্জ আঠা এবং মৌমাছি থেকে প্রাপ্ত মোমের (beeswax) সাথে ভুসাজাত কালি (soot) মিশিয়ে দেয়ালে রঙ করতেন। ফলে রঙের স্থায়িত্ব বহুকাল ধরে বজায় থাকতো। মিশরের চিত্রকলার নিয়ম-কানুন ছিল অত্যন্ত কঠোর। একজন শিল্পীকে শৈশবকাল হতে এসব শিখতে হতো।
বর্ণে চিত্রের ব্যবহার
মিশরের প্রত্যেক শিল্পীকে সুন্দর হস্তাক্ষর অভ্যাস করতে হতো, দেয়ালে ছবির সাথে ছবির বর্ণনাও দেয়া হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দ থেকেই মিশরে হায়ারোগ্লিফিক ভাষার সূচনা ঘটে, যা নবরাজ্যেও টিকে ছিল। হায়ারোগ্লিফিক লিপি ছিল চিত্রনির্ভর। দেয়াল কিংবা প্যাপিরাসের পাতায় হায়ারোগ্লিফিক ভাষায় যে বর্ণনা থাকতো, তাতে ছোট ছোট ছবির মাধ্যমে, যেমন- পেঁচার প্রতিকৃতি, হাতের ছবি, কখনো বা ছোট সিংহের ছবি কিংবা পাখির ছবি প্রভৃতি একেকটি বর্ণের প্রতিনিধিত্ব করতো।
আবার বর্ণনায় নারী বা পুরুষকে নির্দেশ করতে ছোট ছোট করে পুরুষ বা নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কন করে বর্ণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এসব চিত্রে আবার অলঙ্করণও থাকতো। চিত্রগুলো ছিল অনেকটা বাস্তবধর্মী। আর এসব চিত্র নির্ভর ভাষায় সিদ্ধহস্ত হতে শিল্পীদেরকে শৈশব থেকেই শিক্ষা দেয়া হতো। যখন সে এ ব্যাপারে দক্ষতা লাভ করতেন, তখন থেকে তার শিক্ষা সমাপ্ত হতো। কেউই ব্যতিক্রমী বা মৌলিক কিছু চেষ্টা করতেন না। বরং তিনিই শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলে গণ্য হতেন, যিনি পূ্র্বের এতিহ্য বজায় রাখতেন। সম্ভবত এ কারণেই কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মিশরীয় শিল্পকলার অতি অল্পই পরিবর্তন হয়েছে।
পিরামিড বা সমাধিকক্ষের দেয়ালচিত্র
প্রকৃতপক্ষে মিশরীয় চিত্রকলা জীবিত মানুষদের আনন্দদান করবার জন্য সৃষ্টি হয়নি। মমির আবাসস্থল হিসেবে পিরামিডে চিত্রকলার সৃষ্টি হয়। ফারাওদের নির্দেশে তাদের জীবদ্দশাতেই চলতো পিরামিড নির্মাণের কাজ। আর পিরামিডের দেয়ালে থাকতো ফারাওদের ছবি, রানী এবং তাদের দাসদাসীদের ছবি, ফারাওদের কর্মকাণ্ডের ছবি, বিভিন্ন দেব-দেবীর ছবিও এতে চিত্রিত হতো। এমনকি মৃত্যুু পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি হিসেবে পরজন্মের বিষয় সংবলিত নানা প্রকার চিত্র সমাধিকক্ষের দেয়ালে এঁকে দেয়া হতো। এসব খোদাই করা ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্র মিশরের হাজার বছরের পুরনো জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে। পিরামিড বা সমাধিস্মারকের দেয়াল ছবিগুলো পরজন্মের ধারণাকে কেন্দ্র করে চিত্রিত হতো। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে দেবতাদের সাথে মৃত ব্যক্তির সাক্ষাৎ, কিংবা স্বর্গ সম্পর্কিত ধারণা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন চিত্রে দেখা যায়। যেমন- ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের সমাধিকক্ষের দেয়ালে এ ধরনের বিভিন্ন রকমের ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
আবার রানী নেফফারতিরির মমি পাওয়া না গেলেও তার সমাধিকক্ষের দেয়ালে দেখা যায়, পরজন্মে রানীর সাথে দেবদেবীর সাক্ষাৎ হচ্ছে এবং রানী দেবী হাথোর, দেবী আইসিস ও দেবী মা’তকে অর্ঘ্য প্রদান করছেন।
মন্দিরের দেয়ালচিত্র
মিশরীয় চিত্রকলায় তাদের মন্দিরের দেয়াল চিত্রগুলোর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। মন্দিরগুলোর দেয়ালে দেব-দেবীদের ছবি থাকতো। মিশরীয়রা বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিলো। তবে প্রত্যেক নগরের আলাদা আলাদা নিজস্ব স্থানীয় নগর দেবতা বা দেবী ছিলো। এবং এই নগর দেবতা কিংবা দেবীর নামে নগরের মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা করা হতো। উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন মিশরের দেনদেরা প্রদেশের একটি মন্দিরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, সেটি হলো দেবী হাথোরের মন্দির। দেবী হাথোরকে প্রায়শই একটি গাভী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যা তার মাতৃত্ব এবং আধ্যাত্মিক দিককে প্রতীকী করে তুলেছিল। যদিও তার সবচেয়ে সাধারণ আকার ছিল একজন মহিলার প্রতিকৃতি এবং মাথায় সূর্যের চাকতির শিরস্ত্রাণ পরা, এবং মাথার দু’পাশে গরুর শিংয়ের মতো। তবে সূর্য দেবতা আমুন-রা সর্বত্রই পূজনীয় ছিলেন।
পুরাতন রীতিনীতির পরিবর্তন
নবরাজ্যের আমলে (New kingdom) অষ্টাদশ রাজবংশের চতুর্থ আমেনহোটেপে, যিনি অবশ্য ইখনাটন নামেই অধিক সমাদৃত; মূলত তার সময় থেকেই পুরাতন ঐতিহ্য ভঙ্গ করা হয়। পূর্বে মিশরীয় শিল্পীরা চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্যে পুরাতন ঐতিহ্যকে মেনে চলতেন। তাই শিল্পীদের কঠোর নিয়মের মধ্য দিয়ে তাদের চলতে হতো। মিশরের পুরাতনরাজ্য ও মধ্যরাজ্যে শিল্পকলার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তা চতুর্থ আমেনহোটেপের রাজত্বকালে বাতিল হয়ে যায়। কারণ চতুর্থ আমেনহোটেপ ধর্মের ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন। তিনি মিশরের প্রধান দেবতা ‘আমন-রা’ কে বাদ দিয়ে ‘এটনকে’ শ্রেষ্ঠ দেবতা বলে ঘোষণা করেন। তিনি প্রচলিত ধর্মমতের পরিবর্তন আনেন। মিশরীয় শিল্পকলাকে জড়তা ও গতানুগতিক হতে মুক্তি দেন। কিছু সময়ের জন্য হলেও তার উত্তরাধিকারী তুতেনখামেনের রাজত্বকালেও এ ধারা বহাল ছিল।
চতুর্থ আমেনহোটেপ এবং তার স্ত্রীর প্রাসাদের দেয়ালে উৎকীর্ণ ভাস্কর্যগুলো ও চিত্রগুলো তার ধর্ম সংস্কারের চেয়ে কম বৈপ্লবিক ছিল না। চতুর্থ আমেনহোটেপ শিল্পীদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন। তখন থেকেই মিশরীয় শিল্পকলায় বাস্তবতার সূচনা হয়। এতদিন মিশরীয় চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল দেবতা ও রাজাদের কার্যকলাপ। কিন্তু ইখনাটনের আমল থেকে এর পরিবর্তন শুরু হয় এবং দৈনন্দিন জীবনের অনেক বাস্তব ঘটনা তখন চিত্রকলায় স্থান লাভ করে। শিল্পীরা তখন হতে চেষ্টা করতে থাকে একটি বস্তুকে যেমন দেখায়, ঠিক সেভাবেই আঁকতে। যেমন- ইখনাটনের চেহারা ছিল অসুন্দর, তিনি শিল্পীকে তেমনভাবেই আকাঁর অনুমতি দেন। একটি চিত্রে দেখা যায় তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানাদির সাথে বসে রয়েছেন এবং তিনি তার কোলে কন্যাকে তুলে ধরেছেন। অন্য একটি চিত্রে দেখা যায় তিনি তার স্ত্রীর সাথে বাগানে ঘোরাফেরা করছেন।
তার রানী নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তিটি এতটাই বাস্তবধর্মী যে, তা দেখে বুঝবার উপায় নেই এটি কয়েক হাজার বছর পূর্বে মিশরে নির্মিত। কিন্তু মিশরে শিল্পকলার এই উৎকর্ষ ততদিন টিকে ছিল, যতদিন আমেনহোটেপ বেঁচে ছিলেন।
সামাজিক জীবনযাত্রার চিত্র
ইখনাটনের আমলে মিশরের সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবনযাপনের ছবিও আঁকা হতো। জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, শিকারের দৃশ্য, ধান কাটার দৃশ্য, গম, আঙুর ফলনের দৃশ্যসমূহ দেয়ালে আঁকা হতো এবং রঙের ব্যবহার করে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হতো।
নবরাজ্যের আমলে এমনি একজন খ্যাতিমান চিত্রকর ও কারিগর সেননেডজেমের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি দেইরএলমেদিনা গ্রামে বসবাস করতেন। নবরাজ্যের বেশিরভাগ ফারাওদের পিরামিড তৈরি ও দেয়ালচিত্র অঙ্কনে তার ভূমিকা ছিল মুখ্য। এমনকি তার নিজের সমাধিকক্ষেও কিছু দেয়ালচিত্র দেখা যায়, যা জীবিত অবস্থায় তিনি করে রেখে গিয়েছিলেন। তার সমাধিস্মারকে দেখা যায় ফসল কাটার দৃশ্যসহ আরো নানা ধরনের দৃশ্য। তার সমাধিস্মারকে দেখা যায়, তিনি ও তার স্ত্রী দেবতাদের স্তুতি নিবেদন করছেন এবং ফসল রোপন ও কাটার দৃশ্যে সেননেডজেম নিজেকেই আঁকেন। তিনি পরজন্মে শস্য ও ফসলে সমৃদ্ধ হবেন বলে কল্পনাপ্রসূত নিজেকেই এঁকেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, মিশরীয়রা এ জন্মের সুখ-সমৃদ্ধি আর পরজন্মের সুখ-সমৃদ্ধি তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে একইরকম চিন্তা করতেন।
কিছু কিছু পিরামিড বা সমাধিস্মারকের দেয়ালচিত্র দেখে ধারণা করা হয়, মিশরীয়রা সম্ভবত নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। এসব অনুষ্ঠানে নাচ ও গানের আয়োজন করা হতো। যেহেতু তাদের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড দেবতাদের খুশি করার জন্য সংগঠিত হতো, তাই ধারণা করা যায়, এসব নাচ-গান দেবদেবীকে উৎসর্গ করে করা হতো।
প্যাপিরাসের পাতায় চিত্র অঙ্কন
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে নীলনদের তীরে উৎপন্ন নলখাগড়া জাতীয় গাছের বাকল থেকে মিশরীয়রা লেখার মাধ্যম হিসেবে প্যাপিরাস তৈরি করে। তবে ধীরে ধীরে মিশরীয়রা লেখার সাথে সাথে প্যাপিরাসে চিত্র আঁকতে শুরু করে। আর নবরাজ্যের আমলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল এই প্যাপিরাসের পাতায় চিত্র অঙ্কন। মূলত মৃতের সাথে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা, নিয়মকানুনের বর্ণনা ও মৃতের নৈতিক চরিত্রের সুপারিশমূলক বর্ণনা লিপিবদ্ধ ও চিত্রিত এমন অসংখ্য প্যাপিরাসের সন্ধান পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। এর ফলে মিশরীয় চিত্রকলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের মোড়ক উন্মোচন হয়।
বুক অব দ্য ডেড
বুক অব দ্য ডেড হচ্ছে প্যাপিরাসের পাতায় রচিত ও চিত্রিত যাদুর মন্ত্র ও মৃত ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কিত বর্ণনামূলক বই। মৃত্যুর পর মৃতব্যক্তির মমির সাথে ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র সম্বলিত সুপারিশমূলক বর্ণনা এতে লিপিবদ্ধ করা হতো। ধারণা করা হতো, বিচারের সময় মৃত ব্যক্তি যখন বিচারক ওসাইরিসের সামনে উপস্থিত থাকবে, তখন তার চরিত্র সম্পর্কে সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা হবে এই বইটি। এই বইয়ে মৃতের চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে প্রায় সময়ই বেশ বাড়িয়েও লেখা হতো, যাতে করে সে বিচারকার্যের ধারায় উত্তীর্ণ হতে পারে। একে অনেকটা বলা যায় ‘স্বর্গের সার্টিফিকেট’।
এছাড়াও এই বইতে বিভিন্ন যাদুমন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো এই যাদুমন্ত্র তাদেরকে বিচারকার্যে সাহায্য করবে। এই বইতে দেব-দেবীদের বিচারকার্যের ধরন, পুরোহিতদের কার্যাবলীও সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। নিচের ছবিটি বুক অব দ্য ডেড এর একটি অংশবিশেষ। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর দেবতা আনুবিস মৃত ব্যক্তির হৃদয় কতটা সৎ ও পবিত্রতা যাচাই করছেন একটি দাঁড়িপাল্লার সাহায্যে। দাঁড়িপাল্লার একটি পাল্লায় হৃৎপিণ্ড ও অপরটিতে সত্যের দেবী মা’তের পাখা থেকে পালক নিয়ে তা পরিমাপ করছে। যদি পালকের চেয়ে হৃৎপিণ্ডের পাল্লা ভারি হয়, তাহলে সেই মৃত ব্যক্তিকে পাপী বলে গণ্য করা হবে। এবং তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। চিত্রের ডানদিকে দেবতা আ’মিতকে দেখা যাচ্ছে (যার মাথা কুমিরের শরীর অন্য প্রাণীর সমন্বয়ে গঠিত), তারপাশে দেবতা থথকে দেখা যাচ্ছে, যিনি মৃতের বিচার সংক্রান্ত তথ্য লিখে রাখছেন, এরপর শেয়ালমুখো দেবতা আনুবিসকে দাঁড়িপাল্লায় পরিমাপ করতে দেখা যাচ্ছে। এখানে দেবী মা’তসহ মৃত ব্যক্তি ও পাতালপুরীর অন্যান্য দেবতাকেও দেখা যাচ্ছে।
বুক অব দ্য গেটস
বুক অব দ্য গেটস বা দরজাগুলোর বই হলো নব রাজ্যের আমলে মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্যের জন্য প্যাপিরাসের পাতায় চিত্রিত বই। তারা বিশ্বাস করতো, মৃত আত্মাকে পরকালের যাত্রাপথে বিভিন্ন দরজা অতিক্রম করতে হয়। প্রতিটা দরজাতে ভিন্ন দেবীর সাথে মৃতের সাক্ষাৎ হবে আর সেই দেবীদেরকে চিনতে হবে। গ্রন্থে আরো উল্লেখ করা হয়, এ যাত্রায় সবাই সফল হয় না। যারা অসফল হবে, তাদেরকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। এছাড়াও এই বইয়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এতে মানবজাতির জাতিভেদ দেখানো হয়েছে। এই বইয়ের একটি চিত্রে দেখা যায় চারজন মানুষের চার রকমের প্রতিকৃতি অঙ্কন করা হয়েছে। মিশরীয়রা এই চারটি প্রতিকৃতি দ্বারাই মূলত চার রকমের জাতিভেদ বোঝাতে চেয়েছে। এদের মধ্যে প্রতিকৃতিগুলোকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছে। যেমন- রাথ (মিশরীয়), আমু (মিশরের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের মরুভূমি থেকে এশিয়াটিক লোকেরা), নেশেউ (নুবিয়ান এবং অন্যান্য জাতি), থেমু (লিবিয়ান)। তাছাড়া এতে পরকালের দেব-দেবীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিবরণীসহ নানা চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।
বুক অব দ্য আর্থ
বুক অফ দ্য আর্থ এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় নবরাজ্য ও এর পরের রাজবংশে। এটিও প্রাচীন মিশরীয়দের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তবে গবেষকগণ একে নানাভাবে অভিহিত করেছেন। পিয়ানকোফ একে ‘গোলক সূর্যের সৃষ্টি’, হার্টওয়েক আল্টেনম্যালার একে ‘বুক অব আকের’ নামে অভিহিত করেছেন। এতে সূর্যদেবতার ও সৃষ্টিবিষয়ক মিশরীয়দের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে বলে এরিক হোরনিং একে ‘পৃথিবীর বই’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এতে ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে এ সকল বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
তুতেনখামেনের সময় চিত্রকলার অবস্থান
চতুর্থ আমেনহোটেপের মৃত্যুর পর তুতেনখামেন ফারাও হন। তার রাজত্বকালেও চতুর্থ আমেনহোটেপের আমলের শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যগুলো টিকে ছিল। তুতেনখামেনের সিংহাসনে যে চিত্রটি আছে, তাতে দেখা যায়- রাজা সিংহাসনে বসে আছেন, রানী সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি উচ্চতায় ফারাও এর চেয়ে ছোট নন। পূর্বে ফারাওকে সবচাইতে বড় করে আঁকা হতো, কিন্তু এসময় এ ধারার পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া তুতেনখামেনের সময়কালে চিত্রকলার রঙের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন আসে এবং এসময় শিল্পীরা চিত্রকলাকে শুধু ধর্মের মধ্যে আটকে না রেখে এর শৈল্পিকতার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখেন। আর এর প্রমাণ মেলে তুতেনখামেনের সমাধির দেয়ালে। তার সমাধির দেয়ালে অঙ্কিত প্রতিটি ছবির রঙের বৈচিত্র্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। পূর্বের নিয়মানুযায়ী ফারাও এর চেয়ে স্ত্রী ও ভৃত্যকে উচ্চতায় বড় আঁকা যাবে না, এই নিয়মের লঙ্ঘন হয় তুতেনখামেনের সময়ে। তা তুতেনখামেনের সিংহাসনে অঙ্কিত তুতেনখামেন ও তার স্ত্রীর ছবিটি দেখলেই অনুমান করা যাবে। শুধু তা-ই নয়, তুতেনখামেন তার বাক্সতেও শৌখিনতার বশে চিত্র আঁকতেন।
কিন্তু এ ধারা বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর আবার পুরনো পদ্ধতি প্রচলিত হয়। তবে চতুর্থ আমেনহোটেপের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মিশরের শিল্পকলার উন্মেষ সাধন স্থগিত হয়ে যায়। বিশেষত তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর তার পরবর্তী শাসকগণ পুরানো মিশরীয় ধর্ম এবং শিল্পকলার ক্ষেত্রে পুরাতন ঐতিহ্যে ফিরে যান। অবশ্য ধীরে ধীরে মিশরে নবরাজ্যের প্রভাব কমতে থাকে এবং মিশরে টলেমী শাসনকালে মিশরীয় চিত্রকলা তার স্বাতন্ত্র্য হারাতে থাকে, যদিও এর শুরুটা হয়েছিল আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মিশর অভিযানের মধ্য দিয়ে। অবশেষে মিশরের রানী ক্লিওপেট্রার মৃতুর মধ্য দিয়ে মিশরে রোমানদের প্রতিপত্তি বাড়ে আর শিল্প-সংস্কৃতিতে মিশরে হেলেনেস্টিক সভ্যতার প্রাচুর্য বৃদ্ধি পায়। তবে এসময় মিশরের চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য একেবারেই মুছে গিয়েছিল, এমনটা নয়। বরং রোমানরা শিল্পকলা চর্চায় মিশরীয়দের দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিল বলা যায়।