স্পেনের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কিন্তু কেন পারেনি এ উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, স্পেনের জনগণের অসতর্কতাই সবচেয়ে বেশি দায়ী করোনা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য। সেই সাথে দ্বিধান্বিত সরকারের হঠকারিতা তো আছেই!
স্পেনে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় এ বছরের ৩১ জানুয়ারি ক্যানারি দ্বীপে। একই দিনে উহান থেকে স্পেনের কিছু নাগরিক মাদ্রিদে চলে আসে। ধারণা করা হয়, এদের থেকেই মাদ্রিদে করোনাভাইরাস বিস্তার লাভ করছে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে স্পেনে করোনা তথা কোভিড-১৯ আক্রান্ত সংখ্যা ৪৩০-এর আশপাশে ছিল, কিন্তু এক সপ্তাহের ব্যবধানে কীভাবে সারা স্পেনের ছাড়িয়ে পড়ল করোনাভাইরাস?
করোনাভাইরাস স্পেনে ছড়িয়ে পড়ার জন্য তিনটি ঘটনা বেশী দায়ী –
১. ৮ মার্চ ছিল বিশ্ব নারী দিবস। এ উপলক্ষে কর্মক্ষেত্রসহ সকল স্থানে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে দু’টি সংগঠন দেশব্যাপী গণপদযাত্রা কর্মসূচির ডাক দেয়। দু’ ঘণ্টার সে বর্ণাঢ্য গণপদযাত্রায় কেবল মাদ্রিদেই অংশ নেয় এক লক্ষ বিশ হাজার মানুষ! ধারণা করা হচ্ছে, এ বিপুল জনসমাগমের মধ্যে দিয়ে বিপুলভাবেই সংক্রমিত হয়েছে করোনাভাইরাস।
২. পরের ঘটনাটিও মাদ্রিদেই। ফুটবল উন্মাদনায় মার্চের প্রথম সপ্তাহেও কোনো ভাটা পড়েনি শহরটিতে। তাই অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ঘরের মাঠের ম্যাচটিতে দর্শকও হয়েছিল প্রায় ৬০ হাজার। করোনা ছড়াবেই বা না কেন!
৩. মাদ্রিদে স্পেনের তৃতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল ‘ভক্স’ নয় হাজার সমর্থক নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনজন মন্ত্রী, যারা সকলেই পরে দেখা যায়, করোনা-পজেটিভ ছিলেন।
ফলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে স্পেনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ৪০০ থেকে লাফিয়ে ৪,২০০ হয়ে যায় এবং মারা যায় ১২০ জন। গবেষকরা মাদ্রিদের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষেরই করোনা-আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন ।
তবে মার্চের ১১ তারিখে যখন জানা যায়, স্পেনের ১,১৪৬ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তখন মাদ্রিদের সরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কাতালুনিয়া সরকার ও কাতালুনিয়ার চারটি এলাকার ৭০ হাজার অধিবাসীকে দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে অবস্থানের আদেশ দেয়। লা লিগা কর্তৃপক্ষও লা লিগা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে!
লা লিগা বন্ধ করে, দুই প্রদেশ আংশিক বন্ধ করে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পারেনি স্পেন। কারণ স্পেনে ৮ তারিখের পর থেকেই মূলত সারা দেশে করোনা বিস্তার লাভ করে। ভয়াবহ অবস্থার পরেও স্পেন সরকার সমগ্র দেশ ‘লকডাউন’ করতে রাজি হয়নি।
স্পেন সরকারের দায় ও লকডাউন করতে না চাওয়ার কারণ?
দীর্ঘদিন ধরে চলা জাতিগত সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট- সব কিছু মিলিয়ে স্পেন-সরকার খুব কঠিন সময় পার করছিল গত কয়েক মাস ধরে। এত সংকটের মধ্যে স্পেনের সরকার প্রধান পেদ্রো সানজেস পুরো দেশ বন্ধ করে নতুন করে সংকট বাড়াতে চাননি।
তার সরকারের ধারণা ছিল করোনাভাইরাস বেশি ভয়ংকর হবে না। ওদিকে ২০০৮ এর অর্থনৈতিক ধ্বসের ধাক্কা ঠিক এখনো সামলে উঠতে পারেনি স্পেন। তাই এই টালমাটাল সময়ে লকডাউনের মাধ্যমে পুরো দেশের উৎপাদন-কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে অর্থনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করার মানেই দেখেনি সরকার! ওদিকে স্পেনের বিরোধী দলগুলোও পুরো দেশ অবরুদ্ধ করার জন্য সরকারকে চাপ দেয়নি।
এসব কারণে স্পেনের সরকার জনসাধারণকে করোনা পরিস্থিতিতে সতর্ক তো করেইনি, বরং লুকিয়েছে ভয়াবহতার অনেক তথ্য। জনগণের সুরক্ষার চেয়ে যেন অর্থনৈতিক সুরক্ষাই বড় হয়ে গিয়েছিল সরকারের কাছে!
পরিস্থিতি বুঝতে না চাওয়ায় প্রস্তুতিও ছিল লেজেগোবরে! করোনা-আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত কিট এবং পিপিই সংগ্রহের ব্যবস্থাও সরকার করেনি। বরং করোনা পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন চিকিৎসাকর্মীদের জন্য এসব সুরক্ষা-সরঞ্জামাদি ছাড়াই তড়িঘড়ি করে করোনা-আক্রান্তদের জন্য হাসপাতাল চালু করে তারা!
স্পেন লকডাউন করতে দেরি হয়ে যাওয়ায় করোনাভাইরাস অত্যন্ত দ্রুতবেগে বাড়তে থাকে স্পেনে। প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে ৮-১০ হাজার আর মারা যাচ্ছে ৫০০-৬০০’র মতন। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিকে বলা যায় প্রায় নিয়ন্ত্রণের একদম বাইরে! এমনকি হতাহতের সংখ্যাও এখন হিসেব করাও দুরূহ হয়ে গেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, কেন্দ্রস্থল মাদ্রিদ থেকে করোনা বাস্ক ও কাতালুনিয়াসহ সারা স্পেনে ছড়িয়ে গেছে। পুরো স্পেনে করোনায় আক্রান্তের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই অবশ্য মাদ্রিদের। স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার তিন সদস্য করোনা-আক্রান্ত।
রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক সভাপতি লরেঞ্জো সাঞ্জ গত সপ্তাহে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দুঃসংবাদ যেন পিছু ছাড়ছে না ক্লাবটির! আরেক সাবেক সভাপতি ফার্নান্দো মার্টিন আলভারেজও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। স্পেনের দ্বিতীয় বিভাগের একজন কোচও মারা গেছেন। অসংখ্য খেলোয়াড় ও মিডিয়া সেলিব্রেটি আক্রান্ত করোনাভাইরাসে। সবমিলিয়ে পুরো স্পেন এখন মৃত্যুকূপ।
স্পেনের জনগণের দায়
স্পেনের জনগণ করোনাভাইরাস বিস্তারের জন্য কম দায়ী নয়। পুরো স্পেনে মহামারী আকারে সংক্রমণ করা সত্ত্বেও ২০ শে মার্চ স্পেন সরকারের লকডাউন ঘোষণার আগপর্যন্ত দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ-কর্ম,সামাজিক অনুষ্ঠান, গণপরিবহন ব্যবহার, অফিস, বার, নাইট ক্লাব, রেস্টুরেন্ট কিংবা পার্কে যাওয়া কিছুই বন্ধ করেনি গত সপ্তাহ নাগাদ। স্পেনের জনগণের খামখেয়ালিপনা ও সচেতনতার অভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি।
পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রীর সংকট
স্পেনের চিকিৎসা ব্যবস্থা ইউরোপের অন্যতম সেরা হলেও সরকারের যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে পুরো স্পেন জুড়ে বর্তমানে গ্লাভস,মাস্ক, কিটসহ ডাক্তারদের নিরাপত্তা সামগ্রীর প্রচুর সংকট। স্পেনের বড় হাসপাতালগুলোর অবস্থাই সবচেয়ে নাজুক। পর্যাপ্ত কিটের অভাবে রোজ ৪০০’র বেশি টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। আল জাজিরা‘র কাছে স্পেনের এক ডাক্তারের ভাষ্য-
স্পেনের জনগণ খুব সাধারন সমস্যাগুলোর জন্য হাসপাতালে যাচ্ছে না ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে, কিন্তু এই দুর্যোগের সময়ে হাসপাতালগুলোতে প্রচুর পরিমাণে স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য উপকরণের প্রচুর সংকট, যা স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এটি (সংক্রমণের) অনেক বড় কারণ হতে যাচ্ছে।
বর্তমান অবস্থা
পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে স্পেনের সরকার মার্চের ২০ তারিখে পুরো স্পেন ১৫ দিনের জন্য লকডাউন করে দেয়, কিন্তু ততদিনে স্পেনে করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করে, ফলশ্রুতিতে স্পেনে সে ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
বর্তমানে স্পেনে করোনা আক্রান্ত সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে ,সর্বমোট মৃত্যু সাত হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে আবার শুধু স্বাস্থ্যকর্মীরাই আক্রান্ত হয়েছেন দশ হাজারের মতো।
সবমিলিয়ে পুরো স্পেনের বেসামাল অবস্থা। করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর তালিকায় আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইতালির পরে এখন স্পেনের অবস্থান; অন্যদিকে মৃতের সংখ্যার দিক থেকে ইতালির পরেই রয়েছে স্পেন।
স্পেনের সরকার করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করার আগে দুমাস সময় পাওয়া সত্ত্বেও কোনো পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করেনি মহামারী মোকাবেলা করার জন্য, পর্যাপ্ত চিকিৎসা-সামগ্রীও মজুদ করেনি, হাসপাতালও প্রস্তুত করেনি। এমনকি করোনা যখন পুরো স্পেনে মহামারীরূপে ছড়াতে শুরু করে, তখনো লকডাউন না করে পুরো স্পেনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতে বাধ্য করেছে। সেই অবহেলারই মাশুল গুনছে স্পেন।