শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন সমাপ্ত করে আব্দুর রাজ্জাক পলিটিক্যাল ইকোনমি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার লালিত স্বপ্ন সত্যি হয় তার। সেসময় একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বেতন ছিল মাসে সাতশ থেকে আটশ টাকা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক পেতেন মাসিক মাত্র একশো পঁচিশ টাকা। নিঃস্বার্থ জ্ঞানচর্চাই যে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, সেটা বুঝবার জন্য বিশেষ বেগ পেতে হয় না। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন,

“অসাধারণই বলতে হবে। উচ্চশিক্ষা পেয়েছেন, প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি আছে, মুসলমান মধ্যবিত্ত তখন চাকরিতে কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, সেকালে আমলা না হয়ে শিক্ষক হলেন এবং সরকারি অফিস অভিমুখে যাত্রা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে বেছে নিলেন, দফতরে না গিয়ে বিলেত গেলেন, ফাইল না ধরে বই ধরলেন, এটা নিয়ম ছিল না। ছিল ব্যতিক্রম। আমাদের রাজ্জাক স্যার ব্যতিক্রমই ছিলেন।”

শুধুমাত্র নির্ভেজাল জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যেই নিজের সমকালীন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে দ্বিধা করেন নি আব্দুর রাজ্জাক।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ; Image Source: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্বেই বলেছি, ১৯৩৬ সালে মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষার দিনই পলিটিক্যাল ইকোনমি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আব্দুর রাজ্জাককে। এই নিয়োগ ছিল এডহকভিত্তিক। তার যোগদানের পর পলিটিক্যাল ইকোনমি বিভাগ ভেঙে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৯৩৮ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তৎকালীন বিধি অনুসারে, প্রতিবছর নবায়ন করা হতো চুক্তি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সুপারিশক্রমে বছর বছর নবায়ন করা হতো মেয়াদ। পরবর্তীতে, ১৯৪৬ সালের পহেলা মে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। উপাচার্যসহ পাঁচ সদস্যের কমিটি দুজন শিক্ষকের স্থায়ী নিয়োগের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের একজন ছিলেন অধ্যাপক নিখিলরঞ্জন রায়, অপরজন আব্দুর রাজ্জাক। এ বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষকতার অনুমতি পান আব্দুর রাজ্জাক।

শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক? এ প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রাজ্জাক নিজেই অকপটে স্বীকার করেছেন নিজের সীমাবদ্ধতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের প্রথম ছয় মাসে কোনো ক্লাসই নিতে পারেননি তিনি। এমনকি ক্লাসের আগাগোড়া লেকচারও কখনো কখনো মুখস্ত করতে হয়েছে তাকে। “ক্লাসে বক্তৃতা দিতে কেমন লাগতো আপনার?” হুমায়ুন আজাদের প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন,

“খুব খারাপ। ছাত্রদের মুখের দিকে চাইলেই খুব মায়া হতো। আমার মনে হতো, আহা! ওদের কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই। আমার কথায় তো নয়ই। দু-একটি ছাত্র আমাকে জানিয়েছিল, আমি নাকি এক-আধটি ছাত্রের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে যেতাম। পুরনো কলাভবনে আমার ক্লাসের পাশেই ছিল একটি পুকুর। সেই পুকুরে হাস ভাসতো অনেকগুলো। আমি জানালার বাইরে পুকুরের হাসগুলোর দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘণ্টা শেষ করতাম।”

সরদার ফজলুল করিমও শিষ্যের আসনে বসে উপলব্ধি করেছিলেন গুরুর এই সীমাবদ্ধতা,

“আমার নিজেরও একটি দিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে। আমি এবং আর কয়েকটি ছাত্র তার সঙ্গে টিউটোরিয়ালের স্টুডেন্ট। অধ্যাপক রাজ্জাক কিছুক্ষণ এসে ক্লাসে বসলেন। আমাদের বাড়িতে করা খাতাগুলো সংগ্রহ করলেন। তারপর একটু বসলেন এবং স্মিতমুখে ঢাকাইয়া টোনে বললেন: আর কতো! এবার আপনারা বাড়ি যাইবার পারেন।”

সুতরাং, শিক্ষক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাকের সীমাবদ্ধতা ছিল সর্বজনবিদীত। আব্দুর রাজ্জাক নিজেও সেটা মানতেন। তার সম্পর্কে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে- তিনি একবার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে লিখেছিলেন, “আমি ক্লাস নিতে পারব না, আমার বেতন কমিয়ে দিন!

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান; Image Source: The Proshantika

তবে, সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন ব্যতিক্রম। তার সম্পর্কে সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন,

“মাস্টার হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক সক্রেটিসের মতো ছিলেন বললে কোনোকিছু বাড়িয়ে বলা হয় না। উনি প্রথমে ছাত্রকে বলতে দিতেন, তারপর নিজে যা বলার বলতেন। এই গুণের অধিকারী দ্বিতীয় শিক্ষকটির দেখা আমি পাই নাই। রুমি দার্শনিক কিকেরো বলেছেন- যারা শেখাতে বসেন, তাদের বিদ্যাটা যারা শিখতে এসেছে তাদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। (…) আব্দুর রাজ্জাকের বিদ্যা আমার শেখার পথে কোনো বাধা হয় নাই। আমি টের পাই নাই আমি কোনো বিদ্বানের সঙ্গে আছি। স্যার আব্দুর রাজ্জাকের জাদু এটাই।”

এই জাদুর কারণেই হয়তো ক্লাস না নিয়েও কোনো বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাককে। তিনি ঠিকমতো ক্লাস নেন না শুনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি একবার তাকে তলব করলেন। বললেন, “রাজ্জাক, আমি শুনেছি, তুমি নাকি মাঝে মাঝে ক্লাস নাও না?” এ প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রাজ্জাকের সরল উত্তর ছিল, “স্যার ক্লাস না নিলে আমি তো নোটিশ দিয়ে দিই।

তার উত্তর শুনে দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বলেছিলেন, “এরপর ক্লাস না নিলে আমাকে জানিয়ে দিও, আমি নিজেই নোটিশ দিয়ে দেব।” শুধু প্রশাসনের পক্ষ থেকে নয় ছাত্রদের পক্ষ থেকেও কখনো কোনো বিরূপ আচরণের শিকার হতে হয়নি তাকে। ছাত্ররা বরং তাকে সম্মানের চোখেই দেখতো। এই সম্মানের অপরাধবোধ থেকেই হোক কিংবা পেশাগত দায়িত্ববোধ, একসময় আব্দুর রাজ্জাকের চৈতন্যের উদয় হয়। তিনি বুঝতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসে ক্লাস না নেওয়ার অধিকার তার নেই। ফলে, নিয়মিত ক্লাস নিতে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষকজীবনের সীমাবদ্ধতা।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান; Image Source: Wikimedia Commons

আব্দুর রাজ্জাকের শারীরিক গড়ন ছিল বেশ হালকা-পাতলা, উচ্চতার দিক থেকেও একটু খাটো। ফলে, তিনি যখন ক্লাসে উপস্থিত থাকতেন, দেহের গড়নে ছাত্রদের থেকে সহজে আলাদা করা যেত না- যেন ছাত্রদেরই একজন। একদিন আব্দুর রাজ্জাক পুরনো কলাভবনের একটি তিন-চার সারির ডেস্কের কক্ষে ক্লাস নিচ্ছিলেন। ছাত্রসংখ্যা ছিল খুবই কম। সব মিলিয়ে দশের বেশি হবে না। হাবিবুর রহমান নামের অন্য বিভাগের একজন ছাত্র হঠাৎ ঐ কক্ষেই প্রবেশ করে তাকে ক্লাসের বয়োজ্যেষ্ঠ কোনো ছাত্র ভেবেছিলেন।

হাবিবুর রহমান ক্লাসে প্রবেশ করে ভাঙা সুইচবোর্ডের দুই তারের ফুলকিতে সিগারেট ধরিয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে আব্দুর রাজ্জাক তার উদ্দেশ্যে বলেন, “এদিকে শোনেন!” বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর শুনে হাবিবুর রহমান বুঝতে পারেন তিনি কোনো ছাত্র নন, নিশ্চয়ই শিক্ষক। তিনি এক দৌড়ে কক্ষ ত্যাগ করেন। এই হাবিবুর রহমান ছিলেন ৭ম প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

হাবিবুর রহমানের মতোই আব্দুর রাজ্জাকের অনেক সরাসরি ছাত্র কিংবা ছাত্রতুল্য ব্যক্তি পরবর্তীতে দেশের কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন। শুধু দেশ নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশভূমেও ছিল তার শিষ্যত্বের আবেদন। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে একটি ছেলেকে ডেকে তিনি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “এই ছেলেটি অর্থনীতি খুব ভালো বোঝে।” ছেলেটির নাম ছিল অমর্ত্য সেন!

অমর্ত্য সেন; Image Source: Wikimedia Commons

এছাড়াও বর্তমান প্রজন্ম যাদের কাছে জ্ঞানের তৃষ্ণায় ছুটে যায়, তাদেরও গুরু ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। ড. কামাল হোসেন, মো: আনিসুজ্জামান, সরদার ফজলুল করিম, রওনক জাহান, রেহমান সোবহান, বদরুদ্দীন উমর, আহমদ ছফা, সলিমুল্লাহ খানসহ কে নেই তার গুণগ্রাহীর তালিকায়! এজন্য জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাককে সম্বোধন করা হয় ‘শিক্ষকদের গুরু’ নামে। এমনকি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধু বঙ্গবন্ধু কিংবা তাজউদ্দীন নন, তাদের পূর্বসুরীরাও অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কথা বিশেষ মর্যাদায় রাখতেন। ৫৬’র সংবিধান রচনার কাজে আব্দুর রাজ্জাক পূর্ব বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানেও গিয়েছিলেন তিনি।

শিল্পী মর্তুজা বশির ও আনিসুজ্জামানের সাথে আব্দুর রাজ্জাক; Image Source: আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ
ড. রওনক জাহান ও আব্দুর রাজ্জাক; Image Source: আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকার সময়েই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৩৭ সালের বেঙ্গল আইনসভা নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষা কোটায় একটি সিট বরাদ্দ ছিল, যার ভোটার ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটগণ। সেবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন আইনজীবী পঙ্কজ ঘোষ ও ফজলুর রহমান। আব্দুর রাজ্জাক ঢাকার বাইরে বাইরে ঘুরেছিলেন ব্যালট সংগ্রহের কাজে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটদের মধ্যে তিন থেকে চার হাজার ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আর সাকুল্যে সাড়ে চারশো ছিলেন মুসলিম গ্রাজুয়েট।

সেই নির্বাচনে আইনজীবী পঙ্কজ ঘোষ আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। সাইত্রিশের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আব্দুর রাজ্জাকের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তার ছাপ ফেলে। পরবর্তীতে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। তবে, রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন তার নিজ জীবনের মতোই- পাদপ্রদীপের আড়ালের একজন। পাকিস্তান আন্দোলনকেও বাঙালির মুসলিম জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ মনে করতেন আব্দুর রাজ্জাক। বলা বাহুল্য, পাকিস্তান আন্দোলনেও তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৪০ সালে মজহারুল হককে সাথে নিয়ে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি স্বল্পায়ু পাক্ষিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন তিনি।

This is a bengali article written on Dhaka University life of Professor Abdur Razzaq.

তথ্যসূত্র:
১. আব্দুর রাজ্জাক জীবনীগ্রন্থ- নাজমুল হাসান
২. যদ্যপি আমার গুরু- আহমদ ছফা
৩. সাক্ষাৎকারে সরদার ফজলুল করিম : বিষয় অধ্যাপক আবুদর রাজ্জাক- মোহাম্মদ আলী

Related Articles

Exit mobile version