বাংলাদেশি বিজ্ঞানী কিংবা অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন এরকম বিজ্ঞানীর সংখ্যা খুব কি বেশি? ফজলুর রহমান খান, কুদরত-ই-খুদা, ওয়াজেদ মিয়া, জামাল নজরুল ইসলাম, মাকসুদুল আলম এবং আর হাতে গোনা কয়েকজনের নাম বললেই তালিকা শেষ। অনেকে ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেওয়া জগদীশ চন্দ্র বসুকেও আমাদের বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদেরই নিজেদের বিজ্ঞানী, আমাদের দেশেই লেখাপড়া করেছেন, পরবর্তীতে আমেরিকা গিয়ে নানামুখী গবেষণা করে বিজ্ঞানসমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই লোকটির নাম আমরা সকলেই ভুলে যেতে বসেছি। প্রাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকা এ বিজ্ঞানীর নাম আবদুস সাত্তার খান।
১৯৭৩ সালে সংকর ধাতু নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য দেশ ত্যাগ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এএমএস গবেষণাগারে ২ বছরের জন্য যোগ দেন। সে সময়টা ছিল জেট ইঞ্জিনের উন্নয়নকাল। জেট ইঞ্জিন তৈরির খরচ কমাতে এবং বিমানকে আরো গতিময় করতে তখন প্রচুর গবেষণা হচ্ছিল। তিনিও যোগ দিলেন সে ধারায়। সে সময় জেট ইঞ্জিনের বড় একটি সমস্যা ছিল ঘর্ষণের ফলে এর পিস্টন ক্ষয়ে যাওয়া। ইঞ্জিনে জ্বালানির দহনে যে উচ্চ তাপ উৎপন্ন হয়, অধিকাংশ ধাতুই সেটিতে সহনশীল নয়। ফলে দরকার পড়ছিল উপযুক্ত সংকর ধাতুর ব্যবহার। আর তাই অধিকাংশ গবেষণার মূল উপজীব্য ছিল শক্তিশালী সংকর ধাতু উৎপাদন, যা কি না বিমান তৈরি এবং জেট ইঞ্জিনের জন্য উপযোগী হবে।
গবেষণায় দুর্দান্ত সাফল্য পান সাত্তার খান। আইওয়াতে আড়াই বছরের গবেষণায় দশের অধিক অ্যালয় তথা সংকর ধাতু তৈরি করেন। পুরো ক্যারিয়ারে তার তৈরি অ্যালয়ের সংখ্যা ৪০। বৈচিত্র্যময় এসব অ্যালয় উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যবহার উপযোগী। গ্যাস টারবাইনের ব্লেডের প্রান্ত কিংবা জেট ইঞ্জিনে এসব অ্যালয় বেশ উপযোগিতার প্রমাণ দেয়।
১৯৭৬ সালে নাসার লুইস রিসার্চ সেন্টারে গবেষণা শুরু করেন সাত্তার খান। এখানে এসে মহাকাশযানে ব্যবহারোপযোগী সংকর ধাতু নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার গবেষণার ফলস্বরূপ তৈরি হয় নিকেল ও অ্যালুমিনিয়ামের একপ্রকার অত্যন্ত উন্নতমানের সংকর। এই ধাতু বিমানের জ্বালানী সাশ্রয় করে, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে, বাড়ায় কার্যক্ষমতা। তাছাড়া এর ব্যবহার ছিল রকেটেও।
অন্যদিকে মার্কিন বিমান বাহিনীর জন্য দ্রুতগতির এফ-১৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তৈরির কাজে সরাসরি নিযুক্ত হন তিনি। ৭০’এর দশকে বিমান তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা তিনটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের একটি প্রাট অ্যান্ড হুইটনি সাত্তার খানের গবেষণায় ভবিষ্যৎ সাফল্য দেখতে পায়। তাই এ কোম্পানিটি খানকে গবেষণার জন্য অর্থায়ন করে। অর্থায়নের ফলে তার জন্য কাজ করাটা সহজ হয়ে যায়। তার গবেষণা থেকে উৎপন্ন নিকেল ও তামার মিশ্রণই ব্যবহৃত হয় বিমানের ইঞ্জিন তৈরিতে। এই ধাতু হালকা হওয়াতে ইঞ্জিনের ওজন কমে যায়, কর্মদক্ষতা এবং গতি বৃদ্ধি পায়। এ আবিষ্কারের জন্য সাত্তার খান ‘ইউনাইটেড টেকনোলজিস স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। নাসা ইউনাইটেড টেকনোলজি একে ২০ শকতের বিমান গবেষণায় শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে আখ্যায়িত করে। বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘পপুলার সায়েন্স’ একে বিংশ শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারগুলোর একটি বলে অভিহিত করে।
একুশ শতকের আগমনের সাথে সাথে কর্মস্থল পরিবর্তন করেন আবদুস সাত্তার খান। প্রাট অ্যান্ড হুইটনিতে যথেষ্ট সুখেই ছিলেন। তথাপি তিনি বলেছিলেন, একস্থানে কাজ করে একঘেয়েমি ধরে গিয়েছিল তার। যোগ দিলেন সুইজারল্যান্ডের আলস্টম কোম্পানিতে। জ্বালানি উৎপাদনের জন্য এটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে মাত্র পাঁচ বছর কাজ করেই নামের পাশে যোগ করেন ২৫টি পেটেন্ট। আলস্টমে তার প্রধান সাফল্য ছিল টারবাইনের জন্য অধিক কার্যকরী ব্লেড এবং দ্রুতগতির ট্রেনের জন্য সংকর ধাতু তৈরি। বিভিন্ন বাণিজ্যিক পণ্যে তার গবেষণার অবদান অপরিসীম। তার কল্যাণে উন্নত রূপ লাভ করা কিছু বাণিজ্যিক পণ্যের কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
- কাটিং-এজ জেট ইঞ্জিনের জ্বালানি বাষ্পে তার তৈরি ন্যানো-ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করা হয়, যা অর্থসাশ্রয়ী।
- তার গবেষণা যুদ্ধ বিমানের ইঞ্জিনকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী করে তুলেছে। ফলে যুদ্ধবিমান অধিক দূরত্ব অতিক্রম করতে পারছে।
- প্রাট অ্যান্ড হুইটনিতে থাকাকালীন তার গবেষণার কল্যাণে তাপীয় অবসাদ ও ক্ষয়রোধী প্রলেপ দেয়ার পদ্ধতি চালু হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সাফল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
- আলস্টম কোম্পানির ব্যবহৃত গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন উন্নয়নে তার অবদান সবচেয়ে বেশি।
- আলস্টমের অত্যাধুনিক জি-১১ গ্যাস টারবাইনে ব্যবহৃত হচ্ছে আবদুস সাত্তার খানের আবিষ্কৃত জারণরোধী প্রলেপযুক্ত যন্ত্রাংশ।
এত আবিষ্কার উদ্ভাবনে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার গড়া এ মানুষটির জন্ম বাংলাদেশে, তা জেনেও আজ আমাদের গর্ব হয়। ১৯৪১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খাগাতুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সাত্তারের জন্মের নির্দিষ্ট তারিখটিও সংরক্ষিত নেই। মাত্র আট বছর বয়সে বাবা মারা গেলে অকূল পাথারে পড়েন খানের মা। ফলে খানকে নিয়ে তিনি বাধ্য হয়েই পিত্রালয়ে চলে যান। নানাবাড়িতেই খানের কৈশোর কাটে। আট দশটা গ্রামীণ শিশুর মতোই বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার। স্কুলে যাওয়া আসা ছাড়াও বাল্যকালে সাত্তার খানের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ঘুমাতে যাবার পূর্বে নানা-নানীর কাছে গল্প শোনা। এ ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, নানা-নানীর মুখে সৎ আর নীতিবান রাজাদের কিচ্ছা কাহিনীই নৈতিক হবার জন্য তার জীবনের প্রাথমিক অনুপ্রেরণা।
নানা-নানীর কাছে যদি চারিত্রিক দৃঢ়তা পেয়ে থাকেন, তাহলে মায়ের কাছে পেয়েছেন জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই তাই প্রতিদিন ২ মাইল কাদা-বালুর পথ কখনো বৃষ্ঠি, কখনো প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে অনায়াসে পাড়ি দিতেন, স্কুলের ভাঙা বেঞ্চটাকেই কল্পনা করতেন আরামদায়ক কোনো কেদারা। এ কারণে ফলাফলটাও পেয়েছেন হাতেনাতেই। রতনপুর আবদুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে বোর্ড স্ট্যান্ড করেন মাধ্যমিকে। আর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ালেখা শেষ করে সুযোগ পান দেশ সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। আর তাই পেয়ে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্কলারশিপ।
অক্সফোর্ড থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফেরেন আবদুস সাত্তার খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। আর এরই মাঝে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। ২৫শে মার্চের কালো রাতে যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হাজারো নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে, সেদিন হানাদার বাহিনীর নির্মম আক্রোশের শিকার হতে পারতেন সাত্তার নিজেও। তবে বেঁচে গেছেন অলৌকিকভাবেই। পাক সেনারা চলে এসেছে যখন বুঝতে পারলেন, ততক্ষণে বাইরে পালানোর আর কোনো উপায় নেই। তাই হতবুদ্ধি হয়ে খাটের নীচে ঢুকেই চুপচাপ শুয়ে রইলেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে পাকিস্থানি সৈন্যরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে কাউকে না পেয়ে চলে যায়! একজন সৈন্য যদি সেদিন হাঁটু গেড়ে বসে খাটের নীচটা দেখার চেষ্টা করতো, তাহলে কী হতো ভাবা যায়?
দেশ স্বাধীন হবার পরও কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন আবদুস সাত্তার খান। পরবর্তীতে উচ্চতর গবেষণার জন্য, যার সুযোগ বাংলাদেশে নেই, তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে প্রাথমিকভাবে অধ্যাপনাও করেছেন। এরপর আইওয়া, লুইস রিসার্চ সেন্টার, নাসার ইউনাইটেড স্পেস আর আলস্টমের ধারাবাহিকতা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। বাকি জীবনটা তিনি আমেরিকাতেই কাটিয়েছেন সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে। তথাপি দেশের টানে মাঝে মাঝেই এসেছেন বাংলাদেশে। দেশের বিপদেও সাধ্যমতো সাহায্য করতে চেষ্টা করেছেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের মানুষ এক ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। তখন আবদুস সাত্তার খান একক প্রচেষ্টায় ৬১ হাজার ডলার সংগ্রহ করে রেড ক্রসের মাধ্যমে বন্যাদুর্গতদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশে প্রেরণ করেন।
২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি, আমেরিকার ফ্লোরিডায় ৬৭ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আবদুস সাত্তার খান। অসংখ্য আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের জন্য জীবনকালে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। তিনি ব্রিটেনের ‘রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি’র চার্টার্ড বিজ্ঞানী এবং ফেলো ছিলেন। আমেরিকার ‘সোসাইটি অব মেটাল’ এর ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হন। ইউনাইটেড টেকনোলজিস থেকে প্রাপ্ত ‘স্পেশাল’ অ্যাওয়ার্ডের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। দ্রুতগতির বিমান ও মিসাইল প্রপালসনে ব্যবহৃত হাইড্রোকার্বন ক্যাটালিস্ট আবিষ্কার করে পেয়েছেন নাসার ‘অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স’। আর প্রাট অ্যান্ড হুইটনি কোম্পানি তো তাকে ‘প্রাট অ্যান্ড হুইটনিস স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের পাশাপাশি দিয়েছে আজীবন সম্মাননা।
আবদুস সাত্তার খানের কর্মজীবন ও সাফল্যের বিবেচনায় তাকে নিয়ে আলোচনা কোথায়? একেবারেই প্রচারের বাইরে থাকা এ মানুষটিকে নিয়ে গর্ব করার জন্য না হলেও, অন্তত আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার জন্য হলেও প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকেও যে এত উচ্চ অবস্থানে পৌঁছানো যায়, তা তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন। অথচ তাকে দেশের মানুষ তো না-ই, তার নিজের গ্রামের মানুষজনও খুব একটা মনে রাখেনি! গাজী টিভির সাংবাদিক অরিন্দম মুখার্জী বিংকুর একটি ডকুমেন্টরিতে তার গ্রামের কয়েকজন বয়োঃবৃদ্ধের সাথে কথা বলা হয় সাত্তার খান সম্পর্কে। সাত্তার খানকে এভাবে ভুলে যাওয়ায় তাদের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন দাবি করেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার গ্রামে যেন তার নামে একটি পাঠাগার অন্তত নির্মিত হয়। দাবিটি একেবারেই অযৌক্তিক নয়। গর্ব করার মতো মানুষ আমাদের খুব বেশি নেই। যারা আছেন তাদের যদি ভুলে যাই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কার মাঝে অনুপ্রেরণা খুঁজবে?