চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিচালক- এই শব্দগুলো বললে কারো হয়ত চোখের সামনে ভেসে ওঠে সত্যজিৎ রায় , কারো স্টিভেন স্পিলবার্গ , কারো বা অ্যালফ্রেড হিচকক । যাকেই আমরা কল্পনা করি না কেন, রূপালী পর্দায় আমরা যে শিল্প উপভোগ করি তার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন সেই চলচ্চিত্রের নির্মাতা। চলচ্চিত্রের কাহিনী তা যতই অবাস্তব হোক না কেন, সাহিত্যের মতোই এর মূল অনুপ্রেরণা আসে আমাদের জীবন থেকে, আর তাকেই আমরা নানা রূপে দেখি, নিজেদের মধ্যে ধারণ করি। ইতিহাসের পাতা দেখলে দেখা যাবে যে বিনোদনের এ মাধ্যম কখনও হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা, কখনোবা তাকে ব্যবহার করা হয়েছে মানুষকে প্ররোচিত করতে, কখনো আবার তাদের জাগাতে।
চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠা চলচ্চিত্রগুলো, তাদের চরিত্রগুলো আমাদের অনেক আপন হয়ে যায়। তারা আমাদের হাসায়, কাঁদায় এবং ভাবায়। অথচ আমাদের জীবনের বিশাল অংশ জুড়ে থাকা চলচ্চিত্রশিল্পের শুরুটা হয়েছিল কার হাত ধরে তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? পর্দায় কাহিনীকে জীবন্ত করে তোলার ভাবনাটা প্রথম এসেছিল যার মাথায়, দুঃখজনক হলেও সত্য, ইতিহাসের পাতা থেকে তার নাম প্রায় মুছতে যেতে বসেছে। এই মানুষটির নাম অ্যালিস গাই। পুরো নাম অ্যালিস-গাই ব্লাশ। ফরাসী এই নারী হলেন বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা।
কে এই অ্যালিস গাই?
উনিশ শতক, শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটেছে পশ্চিম বিশ্বে। একদিকে গড়ে উঠছে শিল্প কারখানা, অন্যদিকে স্টিম ইঞ্জিনের প্রভাবে রেলওয়েতে বাড়ছে ট্রেন। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লেগেছে শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া , আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রভাবে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন। এমনই এক সময় পর্দার মাঝে কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্র তৈরীর ভাবনা নিয়ে প্রথম আসেন অ্যালিস গাই। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবর্তক গাই জীবনে ১৮৯৬ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে প্রায় সহস্রাধিক চলচ্চিত্র তৈরী করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং চিত্রনাট্যকার। চলচ্চিত্র জগতের প্রথমদিকের বাঘা বাঘা পরিচালকদের বহু আগেই তিনি কাজ করেছেন স্পেশাল ইফেক্ট নিয়ে। লোকেশনে গিয়ে চিত্রগ্রহণ, অডিও রেকর্ডিংয়ের সমন্বয় থেকে শুরু করে তার চলচ্চিত্রে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপস্থিতি- এ সবই তিনি করেছেন সমসাময়িক পরিচালকদের বহু আগেই। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি তার নিজের স্টুডিও পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । অথচ ইতিহাসের পাতায় লুমিয়ের ব্রাদার্স, জর্জেস মিয়েলেস বা থমাস এডিসনের নামের পাশে গাই এর নাম স্থান পায়নি কেন ? কেনই বা এমন এক ব্যক্তিত্বকে তার কাজের স্বীকৃতি পেতে হচ্ছে আজ এত বছর পরে, এত দেরীতে?
প্রথম জীবন ও কর্মজীবন
১৮৭৩ সালের ১লা জুলাইয় ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহন করেন অ্যালিস ইডা অ্যান্টয়ন্যেট গাই। পঞ্চম সন্তানটি যেন ফ্রান্সের মাটিতেই হয় এজন্য মা ম্যারিয়েট চিলি থেকে ফিরে আসেন ফ্রান্সে, জন্ম হয় অ্যালিসের। বাবা এমিল গাই থেকে যান চিলিতেই, সেখানে তার একটি ছাপাখানা ছিল। নানীর কাছে বহু বছর থাকার পর অ্যালিস চলে আসেন চিলিতে, তার মা-বাবার কাছে। তবে এর অল্প কিছুদিন পরই অ্যালিস তার বোনদের মতো ফ্রান্সের একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন। এরপর বাবার ব্যবসার অবনতি এবং তার কিছুদিন পর তার মৃত্যুর পর অ্যালিস একজন টাইপিস্ট এবং স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৮৯৪ সালে ২১ বছর বয়সে প্রকৌশলী লিওন গাউমন্ট (চলচ্চিত্রশিল্পের অন্যতম কর্ণধার) কর্তৃক পরিচালিত একটি ফটোগ্রাফি কোম্পানিতে সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করা শুরু করেন অ্যালিস। এর এক বছর পর তিনি লুমিয়ের ব্রাদার্সের পর্দার উপর আরোপিত ছায়াছবির প্রথম প্রদর্শনীতে যান। এরপর তিনি নিজে চলচ্চিত্র তৈরী করার জন্য স্টুডিওর ক্যামেরা ব্যবহার করতে গাউমন্টের কাছে অনুমতি চান।
উল্লেখ্য, সে সময়ে যেসব ছায়াছবি প্রদর্শিত হত, তা ছিল মূলত বিভিন্ন জায়গায় ধারণ করা ছোট ছোট কিছু দৃশ্যমাত্র। একটি দালান থেকে কিছু মানুষ বেরিয়ে আসছে বা রেলপথে ট্রেন চলছে– এতটুকুই ছিল তৎকালীন সময়ের চলচ্চিত্র, এতেই মুগ্ধ হত দর্শক।চলচ্চিত্র সেসময়ে এর বেশি কিছু ছিল না, ছিল না কোনো চিত্রনাট্য; ছিল শুধু কতগুলো ধারণকৃত দৃশ্য ।
এ সময়ে অ্যালিস গাই লিখে ফেলেন চিত্রনাট্য, পরিচালনা এবং প্রযোজনা করেন তার চলচ্চিত্র ‘ দ্য ক্যাবেজ ফেয়ারি’। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত এই চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো কোনো কাহিনী থাকে। এক পরী বাঁধাকপির ভাজের মাঝে তার সন্তানদের জন্ম দেয়- রূপকথা নির্ভর এই চলচ্চিত্রের গল্প ছিল অনেকটা এরকম। আর এই চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের পুরোটাই হয় গাউমন্ট স্টুডিওর বহিঃপ্রাঙ্গনে।
পরিচালক অ্যালিস গাই
‘দ্য ক্যাবেজ ফেয়ারি’ এর পর অ্যালিস গাইকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালকের দায়িত্বকে আপন করে নেন। গাউমন্টও স্থির চিত্র থেকে চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গাউমন্টের ফিল্ম স্টুডিওর হেড অফ প্রোডাকশন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন গাই। স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র থেকে গাই ধীরে ধীরে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ চলচ্চিত্র তৈরী করতে শুরু করেন। গাউমন্টে কর্মরত অবস্থায় তার সর্ববৃহৎ চলচ্চিত্র হলো ‘দ্য লাইফ অফ ক্রাইস্ট’ (১৯০৬)।
১৯০৭ সালে অ্যালিস গাই হারবার্ট ব্লাশ নামে গাউমন্টের এক ক্যামেরাম্যানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর কিছুদিন পর গাই গাউমন্ট থেকে অব্যাহতি নেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানির নতুন শাখা প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে গাউমন্টের অডিও ও চলচ্চিত্রের সমন্বয় ব্যবস্থা প্রচারণার জন্য হারবার্টকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলে অ্যালিস গাই তার সাথে ফ্রান্স ত্যাগ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর ১৯১০ সালে অ্যালিস গাই কুইন্সের ফ্লাশিং শহরে তার নিজস্ব স্টুডিও ‘সোলাক্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। সোলাক্সে গাই তার পরিচালকের রূপ আবারো ধারণ করেন, পুরোদমে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সপ্তাহে অন্ততপক্ষে ৩টি চলচ্চিত্র তৈরী করা হত সোলাক্সে। বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রনাট্য, চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর উপস্থিতি- সবকিছু মিলিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টি ।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের উদ্দেশ্যে সোলাক্সের দেয়ালে গাই ছোট একটি বাণী ঝুলিয়ে রেখে দিতেন। সেটি হল- Be Natural । তিনি চাইতেন যেন তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীগণ যথাসম্ভব স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের কাজ করেন।
নির্বিঘ্নে পরিচালনা চালিয়ে যাবার জন্য গাই তার সহধর্মী হারবার্টকে ১৯১৩ সালে সোলাক্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত করেন। কিন্তু দুজনের সম্পর্কের অবনতি ঘটলে একসময় তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। হারবার্ট অ্যালিস এবং তাদের সন্তানদের ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যান। ১৯২০ সালে অ্যালিস তার শেষ চলচ্চিত্র ‘টার্নিশড রেপুটেশন’ পরিচালিত করেন। এর কিছুদিন পর সোলাক্স দেউলিয়া হয়ে গেলে অ্যালিস তা বিক্রি করতে বাধ্য হন। এরপর অ্যালিস তার কন্যা সিমনের কাছে চলে আসেন এবং জীবনের বাকিটা সময় এখানেই কাটান।
মৃত্যু এবং স্বীকৃতি
চল্লিশের দশকের শেষের দিকে যখন অ্যালিস গাই দেখেন যে চলচ্চিত্রের কর্ণধারদের নামের তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়ে গিয়েছে, তখন থেকে গাই তার নিজের অভিজ্ঞতার বয়ান নিয়ে জনসমক্ষে আসেন। ১৯৬৮ সালের ২৪ মার্চে ৯৪ বছর বয়সে তিনি নিউ জার্সির এক নার্সিংহোমে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার কন্যা সিমন তাঁর লেখা একটি অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি উদ্ধার করেন, যাতে তিনি তাঁর পরিচালক-জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা লিখে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সিমন এবং অ্যান্থনি স্লাইড পান্ডুলিপিটি অনুবাদ করে প্রকাশ করেন।
১৯৫৩ সালে ফরাসী সরকার কর্তৃক অ্যালিস গাই ‘লিজন অফ অনার’ পদকে (যা কিনা বেসামরিক নাগরিকদের দেয়া সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ পুরষ্কার) পুরষ্কৃত হন। অ্যালিস গাইকে “ফরাসী চলচ্চিত্রের কর্ণধার যিনি চলচ্চিত্র পরিচালকের পেশা সৃষ্টি করেছেন” বলে অভিহিত করেছেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী বারবরা স্ট্রেইস্যান্ড। তিনি যথার্থই বলেছেন। কিন্তু তাহলে কেন ভুলে যাওয়া হল গাইকে?
এর অন্যতম কারণ হল, অ্যালিস গাইয়ের সৃষ্ট ১,০০০টি চলচ্চিত্রের অধিকাংশই হারিয়ে গিয়েছে। এদের মধ্যে কেবল ১৪০টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবুও ধীরে ধীরে গাই তার কাজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন ।
২০১২ সালে অ্যালিস গাইকে মরণোত্তর ‘ডিরেক্টরস গিল্ড অফ আমেরিকা লাইফটাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ এ পুরষ্কৃত করা হয়। এ সময় পরিচালক মার্টিন স্করসিসে আশা প্রকাশ করেন যে মরণোত্তর এ পুরষ্কার দেয়ার মাধ্যমে জনসাধারণ এই অসাধারণ পরিচালকের সাথে পরিচিত হবে এবং দেরীতে হলেও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নারীদের কাজের স্বীকৃতি প্রদানের নজির স্থাপন করা হবে।
অতীতকে ভুলে গেলে কখনও ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়া যায় না, আর সেই কারণে চলচ্চিত্রজগতের কখনো উচিত হবে না অ্যালিস গাইকে ভুলে যাওয়া। কারণ তার হাতেই জন্ম হয়েছে চলচ্চিত্রের, কেউ কেউ তাকে ‘চলচ্চিত্রের জননী’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। আশার কথা হলো, আজ এত বছর পর অ্যালিস গাই বিশ্বের প্রথম পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন অবশেষে। দেরীতে হলেও প্রাপ্য মর্যাদা পাচ্ছেন ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছতে বসা এই নারী।
ফিচার ইমেজ: mentalfloss.com