‘মার্টিন স্করসেসি’, সিনেমাপ্রেমী মাত্রই এই নামটির সাথে পরিচিত। ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘গুডফেলোস’, ‘উলফ অফ ওয়াল স্ট্রীট’ এর মতো একইসাথে ব্যবসাসফল ও শৈল্পিক সিনেমার নির্মাতা তিনি। তবে আজকের আলোচনা তুলনামূলক ভাবে তার একটু কম জনপ্রিয় সিনেমা ‘আফটার আওয়ারস’ নিয়ে। ডার্ক কমেডি, থ্রিলার জনরার এই সিনেমা অনেকটা ইন্ডি-আর্ট ফিল্ম ধরনের ‘ভাইব’ দেয়। এত উপভোগ্য একটা সিনেমা নিয়ে আলোচনা কম কেন এটা একটা রহস্যই বটে!
সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮৫ সালে, কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘পল হ্যাকেটের’ রূপায়ন করেছেন ‘গ্রিফিন ডান’, এই সিনেমার প্রাণভোমরা তিনি। মূলত পেশায় প্রযোজক হলেও এই সিনেমাতে গ্রিফিন ডান নিজেকে উজাড় করে অভিনয় করেছেন। তার বিশ্বাসযোগ্য অভিব্যক্তি ও সংলাপ বলার ধরনে অনেক আপাত অদ্ভুত ঘটনা, কাজকর্মকেও স্বাভাবিক মনে হয়।
সিনেমা শুরু হয় পল হ্যাকেটের কর্মস্থলে, স্করসেসির স্বভাবসুলভ লং টেক থেকে আমরা পল হ্যাকেট সম্পর্কে যা যা জানা প্রয়োজন সেগুলো জেনে যাই। তার বিরক্তিকর কাজ, বর্ণহীন ঘর, জামা-কাপড় সব কিছু থেকে তার নিজের নীরস জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। পল হ্যাকেট তার নিস্তরঙ্গ জীবনেই অভ্যস্থ ছিল, কিন্তু সবকিছু গোলমাল হয়ে যায় একটি রাতে। এবং, শুধু ঐ একটি রাতেই; এর আগেও নয়, পরেও নয়। সেই রাত থেকেই মূলত ‘আফটার আওয়ারস’ নামকরণ।
ঘটনার সূত্রপাত একটি রেস্তোরায়, যেখানে পল কাজ শেষে তার রাতের খাবার খাচ্ছিল। সেখানে খুবই স্বল্প সময়ের পরিচয়ে সে একটি মেয়ের সাথে ফোন নম্বর বিনিময় করে এবং সেই রাতেই সে ফোন করে মেয়ের আবাসস্থলে গিয়ে পৌঁছোয়। হ্যাঁ, কোনো ডেট বা চেনা-জানা ছাড়াই! উদ্ভট ঠেকছে তো? সবে তো শুরু, এরপরে পুরো সিনেমা জুড়েই পল একের পর এক এমন সিদ্ধান্ত নিতে থাকে যার ফলে তাকে পরতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগে। পলের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো যে খুব বেশি অযৌক্তিক ছিল এমনও নয় কিন্তু। তবুও তার ফলাফল হয় ভয়াবহ, এমনকি পলের জীবন নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি শুরু হয়ে যায়।
সিনেমায় পল ব্যতীত অন্য সকল চরিত্র- মার্সি, কিকি, জুন, জুলি, টম বা অন্য যেকোনো চরিত্র, ঠিক ঐ অর্থে স্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এমন সব পরিস্থিতিতে তাদের ফেলা হয়েছে যে অদ্ভুত সব কর্মকান্ড করলেও সেটা চোখে লাগে না। পুরো রাত জুড়ে নানাবিধ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঘটনাচক্রে পল শেষপর্যন্ত তার নীরস কর্মস্থলেই পৌঁছোয়। মানে যেখান থেকে সে শুরু করেছিল, সেখানেই এসে পৌঁছোয় এক রাতের বর্ণিল অভিজ্ঞতার পর।
এই সিনেমার সর্বেসর্বা হলেন ‘মার্টিন স্করসেসি’। একে যদি সিনেমা হিসেবে না দেখে শুধুমাত্র একটি গল্প বা উপন্যাস কিংবা নাটক হিসেবেও পড়া হতো, তাহলে পাঠকের মনে হতো, “এসব কী ছাই-পাশ লিখেছে! কী হচ্ছে কেন হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যাই তো নাই!” কিন্তু এখানেই স্করসেসির মুন্সিয়ানা। আপাতদৃষ্টিতে ‘ননসেন্স এবং অ্যাবসার্ড’ একটা চিত্রনাট্যকে তিনি মাস্টারপিস সিনেমায় রূপান্তরিত করেছেন। পুরো সিনেমা জুড়ে অযৌক্তিক সব কর্মকান্ডের ছড়াছড়ি থাকলেও পরিচালনার গুণে সবই হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য।
সিনেমা শুরুর কিছু সময় পরে থেকেই দর্শকের মনে চাপা অস্বস্তি তৈরি করতে থাকে এবং যত সময় গড়ায়, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে উত্তেজনা, অস্বস্তির মাত্রাও। সিনেমাতে কোনো কমিক রিলিফ নেই, তবুও প্রতিটি সংলাপের মধ্যে সূক্ষ্ম ডার্ক হিউমার, চরিত্রগুলোর পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া মিশে প্রতি মুহুর্তের চাপা অস্বস্তির মাঝেও হাস্যরসের সৃষ্টি করে। সাধারণত কোয়েন ব্রাদার্সের সিনেমাগুলোতে এই ধরনের চরিত্রের অহরহ দেখা মেলে। এই চরিত্রগুলো আমরা চিরায়ত ‘ফানি’ চরিত্র বলতে যেমন বুঝি তেমন হয় না কিন্তু তাদেরকে বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের সাথে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যে সমঝদার দর্শকের কাছে সেই চরিত্রগুলোই প্রিয় হয়ে ওঠে। এ ধরনের ‘সিচুয়েশনাল কমেডি’ খুব বেশি সিনেমায় পাওয়া যায় না। যাদের সূক্ষ্ম ডার্ক হিউমার পছন্দ, তাদের কাছে এই সিনেমা হীরের খনি!
পল হ্যাকেটের পরে এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো আশির দশকের ‘নিউ ইয়র্ক’। হ্যাঁ, ইট, কাঠ, পাথরের শহর স্করসেসির হাতে পড়ে বলতে গেলে জীবন লাভ করেছে। এই নিউ ইয়র্ক এখনকার উন্নত, বিলাসবহুল মেগা সিটি নয়। স্করসেসি দেখিয়েছেন আশির দশকের অন্ধকারাচ্ছন্ন, থকথকে কর্দমাক্ত এবং উদ্ভট সব মানুষকে বুকে ধারণ করে রাখা ডাউনটাউন নিউ ইয়র্ককে। শহীদুল জহিরের লেখায় যেমন পুরান ঢাকা, দক্ষিণ মৈশুন্দি জেগে ওঠে; শুধুমাত্র একটি স্থানের ভূমিকা ছেড়ে, স্বতন্ত্র্যতা নিয়ে আবির্ভূত হয় তেমনি এই সিনেমায় নিউ ইয়র্ক বিরাজমান তার স্বমহিমায়।
মার্টিন স্করসেসি যে সিনেমার ডিরেক্টর সেখানে টেকনিক্যাল দিক তো নিখুঁত হবেই! এই সিনেমাতেও তার স্বভাবজাত লং শটগুলো রয়েছে সাথে আছে মাইকেল বলহাউজের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি। তিনি রাতের অন্ধকার নিউ ইয়র্কের চরিত্র খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছে সিনেমার আবহ সংগীত। স্করসেসি খুব কম সিনেমাতেই অরিজিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ব্যবহার করেছেন, এই সিনেমা তন্মধ্যে একটি। সিনেমার সঙ্গীতায়োজনের দায়িত্বে ছিলেন, লর্ড অফ দ্য রিংস ও হবিট সিনেমার সংগীত পরিচালক হাওয়ার্ড শোর। আবহ সংগীত এই সিনেমার উত্তেজনা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে, পর্দায় চলমান ঘটনার সাথে উপযুক্ত বিজিএম মিশে সবসময় একটা চাপা মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখে দর্শকদের।
মার্টিন স্করসেসির সিনেমা নির্মাণের নিজস্ব এক ধারা রয়েছে। এই সিনেমা সেই ‘সিগনেচার’ স্করসেসি সিনেমাগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা। সাধারণত তিনি তার নির্মাণে প্রতীকিবাদের ব্যবহার না করলেও এই সিনেমায় কিছু ক্ষেত্রে এর উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে দর্শক সিনেমাটির সাথে গ্রীক পুরাণ ‘ওডেসি’র আন্ডারওয়ার্ল্ড ভ্রমণের বর্ণনার সামঞ্জস্য খুঁজে পাবেন। পল হ্যাকেটের এক রাতের অভিজ্ঞতা, ‘উইজার্ড অব ওজ’ সিনেমায় ‘ডরোথি’র স্বপ্ন দেখার সাথেও অনেকটাই মিলে যায়। ডরোথি যেমন ঘুম ভেঙে উঠে তার নিজের নিস্তরঙ্গ জীবনকেই দু’হাতে আলিঙ্গন করে এবং বুঝতে পারে বর্ণিল না হলেও তার জীবন দুঃখের নয়, তেমনই এক রাতের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার পর পলকেও নিজের অফিস কিউবিকলে বসে হাসতে দেখা যায়, হয়তো সে বুঝতে পারে তার স্থান এখানেই, ডাউনটাউন নিউ ইয়র্কের কোনো গলিতে নয়। ধারণা করা হয়- ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া স্ট্যানলি কুব্রিকের সিনেমা ‘আইজ ওয়াইড শাট’ এ যেরকম অদ্ভুত ‘গ্রিটী’ নিউ ইয়র্ক দেখানো হয়েছে, তার ধারণা কুব্রিক প্রথম ‘আফটার আওয়ারস’ থেকেই পেয়েছিলেন। সবমিলিয়ে আফটার আওয়ারস সিনেমাটি হয়তো সর্বস্তরের দর্শকদের ভালো লাগবে না, তবে যারা ডার্ক কমেডি পছন্দ করেন তাদের অবশ্যই মনে ধরবে।