বেশ কিছুদিন আগেও যেখানে ঈদের নাটক মানেই গদবাঁধা কাহিনীর অভিযোগ পাওয়া যেত দর্শকদের কাছ থেকে, সাম্প্রতিক সময়ে সেই চিত্রটা একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে বলা যায়। একই লোকেশনে একই কলাকুলশীদের চিরচেনা অভিনয়, জোর করে দর্শক হাসানোর অপচেষ্টা থেকে সরে এসে ‘আয়নাবাজি অরিজিনাল’, ‘ছবিয়াল রিইউনিয়ন’, ‘ভাই-ব্রাদার এক্সপ্রেস’ ইত্যাদি সহ আরও নানা আয়োজনে নির্মাতাদের সৃষ্টিশীল কাজ পাল্টে দিচ্ছে ঈদ নাটকের চিত্র। এমনই একটি আয়োজনে এবারে নতুন নাটক নিয়ে এসেছেন দেশের আলোচিত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান নির্মাতা, যাকে নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনে রয়েছে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। দেশ-বিদেশের অনেক নামকরা সমালোচকও তার নাটক-চলচ্চিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিভিন্ন সময়। সেই সাথে তার কাজের সমালোচনাও রয়েছে প্রচুর। তবে চড়ুইভাতি, ওয়েটিং রুম, স্পার্টাকাস ৭১ এর মতো টেলিফিল্ম কিংবা ৪২০, ৫১বর্তী বা সিক্সটি নাইন এর মতো সিরিয়াল নির্মাণের জন্য তিনি দর্শকনন্দিত হয়েছেন বরাবরই।
ফারুকীর জীবনের সেরা কাজগুলোর অধিকাংশের পেছনেই যে আরেকজন ব্যক্তির ভূমিকা আছে, তিনি হলেন সাহিত্যিক আনিসুল হক। উপরে উল্লেখিত কয়েকটি টেলিফিল্ম ছাড়াও ফারুকীর প্রথম দিকের প্রশংসিত কাজগুলোর অধিকাংশই হয় আনিসুল হকের উপন্যাস, ছোটগল্প অথবা সরাসরি চিত্রনাট্য অবলম্বনে নির্মিত। এমনকি হুমায়ূন আহমেদ উত্তর বাংলাদেশে সর্বশেষ পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ করার মতো সফল ধারাবাহিক নাটকের নাম বলতে বললেও অনেকেই হয়তো এই জুটির ৫১বর্তী এবং সিক্সটি নাইন এর নাম উচ্চারণ করবেন।
কাজেই দীর্ঘ ১১ বছরের বিরতির পর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যখন সেই আনিসুল হকেরই একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটক নিয়ে ছোটপর্দায় ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই অনেক দর্শকই বেশ উৎসাহিত হয়েছিল। ফারুকী-আনিসুল হক জুটি হয়তো দর্শকদেরকে নিরাশ করেননি। বাংলাদেশে নাটকের রেটিং যাচাইয়ের কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নেই, কিন্তু চ্যানেল আইতে নাটকটি প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা নাটকটির প্রশংসামূলক রিভিউগুলো দেখে বোঝা যায়, বাংলাদেশের দর্শকদেরকে এই নাটকটি শুধু মুগ্ধই করেনি, বরং তাদের হৃদয়ও ছুঁয়ে গেছে।
ফারুকীর আয়েশা নাটকটি নির্মিত হয়েছে আনিসুল হকের আয়েশামঙ্গল উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে। নাটকটি সত্তরের দশকের এক অস্থির সময়ের গল্প। এর শুরু হয় খুবই সাদামাটাভাবে। বিমানবাহিনীর কর্পোরাল জয়নাল (চঞ্চল চৌধুরী) এবং তার স্ত্রী আয়েশা (তিশা) নতুন সংসার শুরু করে। ছোট ছোট খুনসুঁটির মধ্য দিয়েই তাদের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। আয়েশার ভাষায়, তাদের শেকড়ের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি হতে থাকে, যার অন্য নাম ভালোবাসা। কিন্তু এর মধ্যেই একদিন এক ঝড়ের মতো সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। জাসদের অনুপ্রবেশকারীরা আক্রমণ করে বসে ক্যান্টনমেন্টে এবং এয়ারপোর্টে। চিফের সাথে অবস্থান করা জয়নাল চিফের জীবন রক্ষা করে, কিন্তু তারপরেও ভুল বোঝাবুঝির ফলে সে পড়ে যায় সন্দেভাজনদের তালিকায়। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার মুখ থেকে এমন তথ্য বের করার জন্য শুরু হয় তার উপর চরম নির্যাতন, যে তথ্য তার জানা নেই।
গ্রাম থেকে নতুন শহরে আসা আয়েশার সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। প্রতিদিন সে ধর্না দিতে থাকে বিমান বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। তার একটাই অনুরোধ, তার নির্দোষ সহজ-সরল স্বামীকে যেন তার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সে তার স্বামীর চাকরি ফেরত চায় না, শুধু স্বামীর জীবন ফেরত চায়। স্বামীকে ফেরত পেলে সে তাকে নিয়ে সব ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে, তবুও যেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তা সম্ভব না হলেও যেন অন্তত তার উপর নির্যাতন না করা হয়, অন্তত একবার যেন তার সাথে তার স্বামীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র অত্যন্ত নিষ্ঠুর। আয়েশার চোখের পানি আর কাকুতি-মিনতির কোনো মূল্য তার কাছে নেই। নিজের স্বার্থে নিজের নাগরিকদের সাথেই নির্মম আচরণ করতে পিছপা হয় না সে। নাটকের আয়েশা চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করা নুসরাত ইমরোজ তিশার অভিনয় দেখে দর্শকের চোখের কোণে অশ্রু জমা হতে বাধ্য। এই নাটকে যেন ফারুকী বাস্তবতাকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন, আয়েশারা যখন গুম হয়ে যাওয়া কিংবা আইন বহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার হওয়া স্বজনদের মুক্তির দাবিতে চোখের পানি বিসর্জন দেয়, তখন সে আবেগ রাষ্ট্রকে যে বিন্দুমাত্র নাড়া দিতে পারে না।
আনিসুল হকের আয়েশামঙ্গল উপন্যাসটি সত্তরের দশকের পটভূমিতে নির্মিত, ফারুকীর আয়েশা নাটকটির শুরুতেও ১৯৭৭ সালের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কাহিনীর নির্দিষ্ট কোনো কাল থাকে না। এগুলো সকল কালের, সকল যুগের জন্য সমান সত্য। নির্মাতা ফারুকী নিজেই তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না, তবে ইতিহাস কখনো কখনো একই সুরে বাজে পুনরায়। তেমনি এক সময়ের গল্পওতো অন্য সময়ের সুরে বাজতে পারে যদি সেই সময়ে একই অন্যায় বিরাজ করে। প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ সাতাত্তরেও যেমন, এখনও তেমনি। ফলে এই গল্প এখনকারও, এমনকি আগামীরও যদি একই আর্তনাদ সমাজে বিরাজমান থাকে।
ইতিহাসের সকল পর্যায়েই আয়েশাদের নির্দোষ স্বজনরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়, গুম হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। আর আয়েশাদের জীবন কেটে যায় তাদের মুক্তির আশায়, কখনো কখনো তাদের লাশের সন্ধানে। আর নাটকে শেষপর্যন্ত আয়েশাকে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে কাঁদতে কাঁদতে আক্ষেপ করে বলতে হয়:
জীবিত মানুষটারে দেখতে দিলেন না, মৃত মানুষটারেও দেখতে দিলেন না। এখন কবরটা কই আছে সেইটাও কইতেছেন না স্যার। আমরা কি কবর জেয়ারতও করতে পারমু না? এইটা কোন বিচার গো স্যার?
দেশে কিংবা বিদেশে, বর্তমানে কিংবা ‘৭৭ সালের ইতিহাসে, যখন আমরা কোনো গুম হওয়ার সংবাদ শুনি, গ্রেপ্তার অথবা মৃত্যুর সংবাদ শুনি, তখন তা শুধু কিছু নাম এবং সংখ্যা হিসেবেই আমাদের মনের পাশ দিয়ে সামান্য দাগ কেটে চলে যায়। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সদস্যদের আর্তনাদ, তাদের আবেগ-অনুভূতিগুলো আমরা অনুভব করতে পারি না। সেগুলো আমাদের সামনে উপস্থাপন করার দায়িত্ব শিল্পী এবং সৃজনশীল নির্মাতাদের। আয়েশা নাটকের মধ্য দিয়ে ফারুকী, চঞ্চল, তিশা এবং অন্যান্য কলাকুশলীরা সমাজের প্রতি তাদের এ দায়বদ্ধতা কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে পেরেছেন। এদিক থেকে আয়েশা নাটকটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হিসেবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ফিচার ইমেজ: Channel I