সাহিত্যে জগতে সচারচর সাইকোলজি ভিত্তিক যেসব উপন্যাস আছে তাদের প্রায়ই অতিরঞ্জিত কিছু গল্পের ভিত্তিতে শুরু হয়। বেশিরভাগ সময়ই এ ধারা গিয়ে শেষ হয় ক্রাইম থ্রিলারে। তাই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার শুনলে প্রথমেই সাধারণ পাঠকদের মন একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির গল্পগুচ্ছকে অনুমান করে নেয়। সেই অনুমানকে ভেঙে দিয়ে এক নতুন সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের সাথে পরিচয় হওয়া যায় শারমিন আহমেদের লেখা ‘কেইস হিস্ট্রি’ দিয়ে।
মূল গল্প
খুব সাধারণ একটি গল্প কেইস হিস্ট্রি। গল্পের মতোই সাধারণ একজন মেয়েকে কেন্দ্র করে এর ভিত্তি। নাম অবনী। যে মায়ের হত্যাকে প্রত্যক্ষ করেছে সামনে থেকে। হত্যাকারী অন্য কেউ নয়, স্বয়ং তার বাবা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন খ্রিষ্টান মাকে মুসলমান পরিবারে কীভাবে সয়ে যেতে হয়েছে সবকিছু, এবং সবকিছু সয়ে গেলেই যে সমাধান মেলে না, তা খুব কাছ থেকে দেখেছে অবনী। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে নিজের এক আবরণ। যে আবরণের বেষ্টনীতে ঠাই হয় ‘সে’ নামের এক অদৃশ্য সত্ত্বার। যার অস্তিত্ব শুধু অবনীই নয়, টের পায় তার সহচরে থাকা অনেকেই। এমনকি ডাক্তার আহাদ নিজেও।
ডাক্তার আহাদ চৌধুরীর কাছে মানসিক সমস্যার উন্নতির চিকিৎসা নিতে আসতো অবনী। মূল গল্প মূলত তাদেরকে ঘিরেই। ডাক্তারের কাছে নিত্য নতুন চিন্তার খোড়াগ ছিল অবনী। গল্পে স্পষ্ট ফুটে উঠে রোগীর সুস্থতায় একজন ডাক্তারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার কথা। গল্পে দেখা যায় একজন সাইকোলজিস্ট কতটা যত্নের সাথে চেষ্টা করেন একজন রোগীকে সুস্থ করতে। একইসাথে এও দেখা যায় সাইকোলজিস্ট হওয়া সত্ত্বেও তার মনে মাঝে মাঝে বিরূপ প্রভাব পড়ে। দীর্ঘদিনের অর্জিত জ্ঞান আর সারারাত ধরে দেখা ইল্যুশনের মধ্যে আটকে যান তিনি। মানুষ যে মনের নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে।
গল্পে পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে দেখা যায় রেবেকা, সামসু, শওকত, মঞ্জুকে। যারা সকলেই ডাক্তার আহাদের সাথে লুব্ধকে কাজ করে। কাজ করার খাতিরে ডাক্তারের পরপরই রোগীদের সাথে এদেরও একধরনের সখ্যতা আর মান-অভিমান জমে ওঠে। এমনিভাবে অবনীর সাথে রেবেকার বেশ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমে রেবেকা অবনীকে একটু সমীহ করে চললেও পরবর্তীতে রেবেকার কাছে অবনী হয়ে উঠে দেবদূত। খুব সাধারণ প্লটের একটি গল্প রেবেকা ও ডাক্তার আহাদের দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে দিয়ে বেশ দূর্দান্ত হয়ে ওঠে।
পাঠ পর্যালোচনা
থ্রিলার বলতেই আমরা সাধারণত অতিরঞ্জিত কিছু প্রেক্ষাপটকে বুঝি। সেক্ষেত্রে ‘কেইস হিস্ট্রি’ একদমই ভিন্ন ধারার বলা যায়। খুবই সাধারণ একটি গল্প। আর গল্পের এই সাধারণ প্রেক্ষাপটের অবয়বটাই উপন্যাসটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। লেখক শারমিন আহমেদের অন্যান্য উপন্যাসের মতো এখানেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীর প্রতি অবমূল্যায়ন স্পষ্ট হয়েছে। গল্পে এর সমাধানও দেখিয়েছেন তিনি। সমাজ ব্যবস্থায় সবাই যদি একে অন্যকে প্রথমে মানুষ হিসেবে ভাবতো তাহলেই এই সমস্যার খুব সুন্দর সমাধান হয়ে যেত। এতো সাধারণভাবে মানুষ ভাবে না বলেই নানাবিধ বৈষম্য আমাদের সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বৈষম্য, অবমূল্যায়ণ ও নিজেকে রক্ষায় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপের সুবিন্যাস্ত প্রকাশ ‘কেইস হিস্ট্রি’।
এবার আসি গল্পের সমালোচনায়। চাঁদেরও তো কলঙ্ক থাকে। মনে হলো এই উপন্যাসেও কিছু দিক আছে নেতিবাচক। গল্পের ধারাবাহিকতায় রহস্য বজায় রাখার যে নীতি তা কিছু ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। যে পাঠক একনাগাড়ে বই পড়তে পছন্দ করে তার ক্ষেত্রে বইটা পড়তে বেগ পেতে হতে পারে। এক্ষেত্রে গল্পের ভাষার ব্যবহার বেশ প্রভাব ফেলবে। তবে ধৈর্য নিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়লে পাঠক এক ভিন্ন স্বাদ পাবে এতে কোনো দ্বিমত নেই।
লেখক সম্পর্কে
গতানুগতিক ধারাবাহিক লেখকদের মতো শারমিন আহমেদ সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে সামাজিক জীবনে তিনি একজন গৃহিণী হলেও লেখালেখির চর্চাকে ধারণ করেছেন খুব সযত্নে। শুদ্ধ সাহিত্য চর্চার প্রসারে তার হাত ধরে কিবোর্ডিং নামক এক সংগঠনের পথচলা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তার প্রকাশিত উপন্যাস ‘নাগরিক জলপত্র’, ‘ওরা কেউ না’, এবং কাব্যগ্রন্থ ‘আমার কোনো তারা নেই’।
বই: কেইস হিস্ট্রি || লেখক: শারমিন আহমেদ
প্রকাশক: নালন্দা || প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২১