গল্পের শুরুটা হয় এক ছোট্ট ছেলেকে দিয়ে। বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাণবন্ত আর মেধাবী সে। শেকড় সে প্রায় ভুলতে বসেছে। কেবল চার্চের ফাদারের কাছে রাখা এক টুকরো কাগজে আছে তার ছেড়া শেকড়ের একটা অংশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় হারিয়ে যায় সে, এপার ছেড়ে ওপারে আশ্রয় পায়। নিজের আসল নাম ভুলে সে হয়ে ওঠে আলবার্ট পিন্টো। কিন্তু এটা কি তার আসল নাম?
সেই ফাদার মারা যাবার পর পিন্টো হলো আশ্রয়হারা। বিশ্বনাথ নামে এক স্বর্ণকারের সাথে পিন্টো এসে ওঠে লক্ষীবাজারের এক বাড়িতে। এখানে এসে তার নাম হলো গৌরহরি সাহা। এ নামের পেছনেও আছে রহস্য। এখানে এসে ভেবেছিল- তাকে বোধহয় এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, আবার পালাতে হবে। কিন্তু তার ভাবনাকে বদলে দিয়ে সে ওই বাড়ির সদস্য হয়ে ওঠে।
কিন্ত একদিন তাকে এই আশ্রয় ছেড়েও পালাতে হয়, কারণটা হয় আগ্রহী পাঠকদের জন্যই তোলা রইল। এদিকে চৌধুরী পরিবারের সন্তান পিন্টুর আসল নাম আবু সালেহ চৌধুরী পিন্টু। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে বা দোষে কিংবা নিয়তির কারণে আজ তার নাম গৌরহরি বা আলবার্টো।
খুব অদ্ভুত জীবন, বার বার তাকে পালাতে হচ্ছে, বদলে ফেলতে হচ্ছে নাম। কিন্তু কেন? কেন সে নিজের আসল নামে পরিচিত না? কেন নিজের শেকড় আর নাড়ী খুঁজে পেয়েও ফিরে গেল না? কেন সে আবার পালিয়ে গেল?
অন্যদিকে, পূরবী নামের এক মেয়ে, তার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার। পেশায় সে স্বর্ণকারের মেয়ে। স্কুল-কলেজে বেশ ভালো ছাত্রী হিসেবেই পরিচিত। একদিন পূরবীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। দাদীর মৃত্যু, বাবার স্ট্রোকসহ আরো কিছু ঘটনা। অন্যদিকে সুন্দর হওয়ায় বার বার তাকে উত্যক্ত করে এলাকার মাস্তান।
একদিন এই গল্পে আসে গৌরহরি সাহা। এখানে তার জীবন চলতে থাকে, কিন্তু একদিন ময়মনসিংহের এক স্থানে পাওয়া যায় একটি দগ্ধ লাশ। যে লাশের গায়ে লেগে আছে একটা চিরকুট- আবু সালেহ চৌধুরী পিন্টু।
শরীফুল হাসানের লেখা ‘বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ’ সামাজিক থ্রিলার ঘরনার একটি উপন্যাস। অমর একুশে বইমেলা ২০২২-এ প্রকাশিত এই বই ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বেশ কিছু টার্নিং পয়েন্টের জন্য বইটি পাঠকহৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম।
প্রথমেই বলি, বইটির নামকরণ যথাযথ আর সার্থক। বৃষ্টির ঘ্রাণের সাথে মিশে আছে রক্তের ঘ্রাণ, শূন্যতার ঘ্রাণ, আর প্রিয়জন হারানোর কষ্ট। পিন্টো বা পিন্টু চরিত্রটি বেশ শক্তিশালী। একটা বাচ্চা ছেলে নিজেকে যেভাবে সমাজের সাথে, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে সেটা অবাক করা ব্যাপার। আমাদের আশেপাশেই হয়তো এমন অনেক পিন্টো আছে।
একদিকে তার জীবনে ছোটখাট কিছু ভুল ছিল, নাহলে হয়তো তার জীবন আরো অন্যরকম হতে পারত। তবে নিজের দর্শন একটু অন্যরকম ছিল তার, কৃতজ্ঞতাবোধ আর শ্রদ্ধাবোধ ছিল বলেই নিজের রাঙ্গামা-কে ছেড়ে, ঢাকার সেই পরিবার ছেড়ে পালিয়েছিল।
সেলিম খান চরিত্রটি আমাদের আশেপাশের। এরকম সেলিম খানের জন্য প্রতিদিন কত পূরবী ঝরে পড়ে স্কুল থেকে, ঝরে যায় তাদের স্বপ্ন। একে একে গল্প থেকে সব চরিত্র হারিয়ে গেল, আর কেউ তাদের অস্তিত্ব কোনোদিনও খুঁজে পেল না। কোথায় আর কেনই বা হারাল? একবার কেউ হারালে তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়?
পিন্টুকে প্রথমদিকে মনে হবে খুব চেনা একজন মানুষ, কিন্তু প্রতি অধ্যায়ে মনে হবে, “এ কী! আমি তো এই চরিত্রকে বুঝতেই পারলাম না!” খুব শান্ত অথচ যেন এক আগ্নেয়গিরি সে। প্রচন্ড মেধা আর বুদ্ধি আছে তার; শান্ত, কিন্তু কোথাও সে বেশ অশান্ত। নিজের বিবেকের দংশনে প্রতিনিয়ত সে পুড়েছে। কিন্তু তার কি ভুল ছিল? নাকি সব নিয়তি?
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো পূরবী। এটা যে সময়ের গল্প, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে এত প্রাণবন্ত আর শক্তিশালী ছিল, সেটা বেশ অবাক করার মতো। এমন চরিত্র হয়তো অনেক আছে আমাদের আশেপাশে, কিন্তু আমরা এড়িয়ে যাই। অথবা মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই না। কারণ, পূরবী সাহার আত্মবিশ্বাস আর মননের কাছে আমরা যেন তুচ্ছ।
অন্য আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল সুস্মিতা। আজ থেকে এত বছর আগে এরকম শক্তিশালী আর স্বপ্নবাজ মেয়ের দেখা এই যুগে এসে হয়তো মিলবে। কিন্তু সেই আশির দশকে এমন ঘটনা অসম্ভব না হলেও সাধারণ ছিল না।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক অনেক ঘটনা লেখক বর্ণনা করেছেন, অনেক অজানা তথ্য হয়তো জানতে পারবেন। অনেক কিছুই হয়তো আমরা জানতাম, তবু নতুন করে আরো একবার চোখের সামনে চলে আসবে।
সাম্ভালা-খ্যাত শরীফুল হাসানের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ তার বর্ণনাভঙ্গী। নিখুঁত বর্ণনায় সব পরিস্থিতি তিনি এমনভাবে তুলে ধরেছেন, মনে হয়েছে সব যেন চোখের সামনে ঘটেছে। একবার শুরুর পর শেষ না করে ওঠা যায় না।
বইটির প্রচ্ছদ চমৎকার। জলরঙে আঁকা বৃষ্টি আর সবুজ পাতার মিশেলে এই প্রচ্ছদ যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে যায়। প্রচ্ছদ দেখলে মন ভালো হয়ে যাবে, তবে প্রচ্ছদের এই মন ভালো করার মধ্যে কোথাও আছে বিষণ্নতা। ঠিক তেমনই বিষণ্নতা আছে বইজুড়ে। বইটির সবচেয়ে চমৎকার দিক হলো টুইস্ট। একটি অধ্যায় আছে, যা মুহুর্তে বদলে দেয় সমস্ত অনুভূতি। সেই মন খারাপ করা অধ্যায় পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাবে সমস্ত দিন, আর সমস্ত মন। লেখকও বলেছেন, বিষণ্নতায় মোড়ানো সেই অধ্যায় পড়ে তিনিও নাকি কিছু লিখতে পারেননি কিছুদিন।
বইটি বিশাল কলেবরের হলেও এতটুকু খারাপ লাগবে না পাঠকের। স্লাইস অব টাইম আর সমান্তরালে চলছে অনেকগুলো সময়ের গল্প। সাল কিংবা দিন-তারিখের ভিন্নতা থাকলেও অধিকাংশ পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না। বইটির বাঁধাই যেমন চমৎকার ছিল, পেজগুলোর হলুদাভ রঙও যেন অতীতের কোনো অধ্যায় ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে এলো। বই পড়া শেষে আক্ষেপ ছিল- কেন এমন হলো? যদি সেই ঘটনা না ঘটত, তবে কি গল্প অন্যরকম হতো না?
তবে সব ভালোর মধ্যে কিছু না কিছু আক্ষেপ রয়ে যায়। যেমন- সুস্মিতার পরিণতি উল্লেখ করলে বোধহয় ভালো হতো। কিছু কিছু বই অথবা মুভি রয়েছে, যেগুলো পড়লে মন খারাপ হলেও অন্য রকম ভালো লাগার রেশ রেখে যায়। সেরকম রেশ রেখে যাওয়া বই এটি। এত দ্রুত এগোবে সব কিছু যে বইটি শেষ না করে ওঠার উপায় নেই।
আচ্ছা, বলুন তো- আমরা কীসের জন্য বাঁচি? টাকা না ক্ষমতা? কোনটা চিরস্থায়ী? এই দোর্দণ্ড প্রতাপ? নাকি ব্যাংকের লকারে জমানো টাকার বান্ডিল? দিন শেষে কেন সবাই এক না আমরা? কেন রক্তক্ষরণ ছাড়া কোনো সমাধান হয় না। কেন সোদা মাটির আর বৃষ্টির ঘ্রাণ সব সময় প্রশান্তি বয়ে আনে না? কেন বৃষ্টির ঘ্রাণে রক্তের ঘ্রাণ মিশে থাকে?